রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার কয়েকটি উপায়
মো. মাসুদ চৌধুরী
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রমজান মুসলিম জাতির এক মহিমান্বিত মাস। এ মাসে মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের হেদায়াতের জন্য পবিত্র কুরআন নাজিল করেছেন। এ মাসে রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য ফরজ বা অবশ্যপালনীয় ইবাদত। আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদিত হওয়া এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এ মাসের মূল উদ্দেশ্য। এ মাসে মুসলমানরা রোজা পালন, ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে রহমত, মাগফিরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। এছাড়া রমজান থেকে আত্মবিশ্লেষণ, ধৈর্য, সহানুভূতি ও আত্মসংযমের শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন। এটি ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনার এক বিশেষ মাস। রমজানের শেষ দশকের যে কোনো বেজোড় রাতে রয়েছে শবেকদর বা লাইলাতুল কদর, যার অর্থ মর্যাদার রাত। এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। কারণ এ রাতের ইবাদতে রয়েছে প্রচুর সওয়াব এবং আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার নিশ্চয়তা।
রমজানে ইবাদতের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি হলেও পণ্যের অতিরিক্ত দাম ও বাজার অস্থিরতার কারণে দরিদ্র বা মধ্যবিত্তরা এ মাসে মানসিক অশান্তিতে থাকেন। এ মাসে ইফতার ও সেহরির জন্য বাজারে পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়, যার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে থাকে। আবার পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটি বা দেরি হওয়া, যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের অভাব, রমজানে কিছু পণ্যের যেমন-খেজুর, ফলমূল ও বিশেষ খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ডলার রেট ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এ পরিস্থিতি মানুষের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে থাকে। অনেক সময় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পক্ষে খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেক পরিবারের পক্ষে রোজা রাখা এবং ইবাদত করা অনেক কঠিন ও কষ্টকর হয়ে পড়ে।
বিগত রমজানগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে বেড়ে গিয়েছিল। রমজানে যে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে; যেমন-চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, ফলমূল ও খেজুরের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। বিগত বছরগুলোতে যদিও বাজার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু সরবরাহ সমস্যা, আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব এবং সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার কারণে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্যের, বিশেষত তেল, চাল ও মাংসের দাম প্রায় ৩০-৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাছাড়া শাকসবজি, মাছ, মৌসুমি ফল, চিনি ও অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে গিয়েছিল, যে কারণে সাধারণ মানুষের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে ওঠে।
তাই রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগাম পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। পবিত্র রমজান আসার আগেই বাজার পরিস্থিতি ও চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে মূল্যবৃদ্ধি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, সেগুলোর চাহিদা ও সরবরাহের পূর্বাভাস তৈরি করতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহের পূর্বাভাস অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হলে পণ্য আমদানির প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির অনুমতি ও শুল্ক ছাড়পত্র দ্রুত দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং আমদানি প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতা যেন না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী গুদামে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিতে হবে।
রমজান সামনে রেখে এখনই ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য একটি বিশেষ যৌথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ এবং সেই মূল্য অনুসরণ করার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত রাখতে ব্যবসায়ীদের দায়িত্ববোধ তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে কোনো ধরনের মজুতদারি বা কৃত্রিম সংকট রমজানে সৃষ্টি না হয়। এরপরও যদি বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর চেষ্টা থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধের উপায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে এখনই নির্ধারণ করতে হবে। মজুতদারদের সর্বোচ্চ জরিমানা ও শাস্তি দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া সরকারকে ব্যবসায়ীদের চাওয়া-পাওয়াগুলো শুনতে হবে এবং রমজানের জন্য তাদের দাবিগুলো বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।
আমরা আরব দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই, রমজান উপলক্ষ্যে তারা পণ্যের বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্য বা অফার চালু করে। সেসব দেশের ব্যবসায়ীরা বস্তুত সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ীই বিশেষ রমজান অফার প্রদান করে থাকে, যাতে সবাই কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারে। আরব দেশগুলোয় বিভিন্ন হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বিশেষ ইফতার ও সেহরির আয়োজন করা হয়ে থাকে, যাতে সাধারণ মানুষ সাশ্রয়ী দামে ইফতার ও সেহরি খেতে পারে। আমাদের দেশের সরকারও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতে পারে। এছাড়া, সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষভাবে কর প্রণোদনা দিতে পারে, যাতে তারা পণ্যের দাম বৃদ্ধি না করে। রমজান সামনে রেখে টিসিবির মাধ্যমেও ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের পরিকল্পনা নিতে হবে এবং যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, সেগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য সঠিক সময় ও সঠিক পরিমাণে পণ্য সংগ্রহ এবং বিতরণব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে বাজারের ওপর চাপ অনেকাংশে কমে যাবে। জনগণকে বুঝতে হবে, বাজারে বেশি দাম দিয়ে পণ্য ক্রয় করলে শুধু তারই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এটি বাজারের মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতাকেও উৎসাহিত করবে, যা দেশের সব মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে ক্যাম্পেইন এবং স্থানীয় কমিউনিটি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতামূলক ইভেন্ট আয়োজন করে এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। এতে জনগণ পণ্যের সঠিক দাম এবং দাম বাড়ানোর প্রবণতা রোধ করার উপায় জানতে পারবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারিভাবে বাজারে বৈধ বিক্রেতার নাম ও সঠিক পণ্যের দামের তালিকা ইলেকট্রনিক বোর্ডের মাধ্যমে প্রদর্শন করা যেতে পারে। ইলেকট্রনিক বোর্ডটিকে প্রতিটি বাজারে সবসময় সচল রাখতে হবে এবং বোর্ডটিতে প্রতিদিনের মূল্যতালিকা প্রকাশ করতে হবে। সরকারের জেলা বা থানা পর্যায়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে ইলেকট্রনিক বোর্ডটি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত করতে হবে। তাছাড়া চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য ক্রয়ে জনগণকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, যাতে বাজারে পণ্য সংকট সৃষ্টি না হয়। একইসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে একটি হটলাইন চালু করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে দ্রুত অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে একত্রিতভাবে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের সচেতন এবং ইসলামি শিক্ষা অনুযায়ী অতিরিক্ত মুনাফা ও মজুতদারি থেকে বিরত থাকার কথা প্রচার করতে পারে। এবার আরও সংগঠিত ও ব্যাপক পরিসরে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিতরণ, ফ্রি ইফতার ও সেহরি সরবরাহ করে দরিদ্রদের সহায়তা করতে পারে। এছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে পারে।
পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা বা ভর্তুকি দিয়ে পণ্য পরিবহণের খরচ কমানো গেলে ব্যবসায়ীরা কম খরচে পণ্য বাজারে আনতে পারবে, যা পণ্যের দাম কমাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে। এ নীতিমালা দীর্ঘমেয়াদে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে এবং রমজান ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের সময়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। সরকারের তদারকি, ব্যবসায়ীদের দায়িত্বশীলতা এবং ভোক্তাদের সচেতনতা এ নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
সবার সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমেই রমজানে পণ্যের দাম ও বাজার অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মুসলমানরা মানসিকভাবে শান্তিতে থাকবেন এবং স্বস্তিতে রোজা পালন, ইবাদত ও সৎকর্মের মাধ্যমে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবেন।
মো. মাসুদ চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ