Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

খেলাপি ঋণ রোধে প্রয়োজন বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন

Icon

এম এ খালেক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খেলাপি ঋণ রোধে প্রয়োজন বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন

একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে ধমনিতে রক্ত প্রবাহের মতো। ধমনিতে রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে যেমন মানবজীবন বিপন্ন হতে পারে, ঠিক তেমনি কোনো কারণে ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে, সেই দেশের অর্থনীতি সংকটে পতিত হতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টর প্রত্যাশা মতো চলছে না। নানা সমস্যা এ সেক্টরের স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করে চলেছে। বিশেষ করে, পর্বত প্রমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য নানা জটিল সমস্যার সৃষ্টি করছে। প্রদত্ত ঋণের কিস্তি সুদসমেত নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে না পারলে, পরবর্তীকালে ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। ব্যাংক তারল্য সংকটে পতিত হয়। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যায়। ব্যাংকের মুনাফার পরিমাণ কমে যায়। গত সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারের হিসাব মোতাবেক, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এটি এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ; কিন্তু এটি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়। এর বাইরে ঋণ হিসাব অবলোপন, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবিকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যোগ করলে মোট খেলাটি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলেও খেলাপি যাতে সৃষ্টি না হয়, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কোনো ইস্যু নিয়ে আলোচনার চেয়ে ঘটনাটি যাতে না ঘটে, তা নিয়ে আলোচনা করাই যৌক্তিক। কথায় বলে, কার্যোত্তর সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যা যাতে সৃষ্টি না হয়, তার ব্যবস্থা করাই উত্তম। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকাররা নিজস্ব বিবেচনা মোতাবেক ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারছেন না। বরং বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে তাদের অনেকটা বাধ্য হয়ে অযৌক্তিক প্রকল্পের অনুকূলে ঋণদানের জন্য প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হয়। অথচ ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব আইন প্রচলিত আছে, তা যদি সঠিকভাবে পরিপালিত হতো, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই কমে যেত। কোনো ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকে আসার পর একজন ব্যাংকার বুঝতে পারেন, সেই প্রকল্পে ঋণদান করা যৌক্তিক হবে কিনা এবং পরবর্তীকালে নির্ধারিত সময়ে সঠিকভাবে ঋণের কিস্তি আদায় করা সম্ভব হবে কিনা।

খেলাপি ঋণ সৃষ্টির প্রবণতা প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অথচ উপেক্ষিত একটি ইস্যু হচ্ছে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনকালে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক ভ্যালুয়েশন করা। অনুমোদিত ঋণ যাতে পরবর্তীকালে খেলাপিতে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি ঋণ প্রস্তাবের সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থাবর সম্পদ ব্যাংকের কাছে রেজিস্ট্রিকৃতভাবে বন্ধক দিতে হয়। যদি ঋণগ্রহীতা ঋণের কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ হন অথবা অন্য ঋণপত্রের অন্য কোনো শর্ত ভঙ্গ করেন, তাহলে ব্যাংক চাইলে সেই বন্ধকীকৃত সম্পদ বিক্রি করে ঋণের অর্থ আদায় করতে পারেন। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনকালে আরও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও সঠিকভাবে বন্ধকী সম্পদ মূল্যায়ন করা হলে, সেই ঋণের অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে খুব একটা জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। সাধারণভাবে ঋণদানকালে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিতে চান, তাহলে তাকে ক্ষেত্রভেদে ১২৫ অথবা ১৫০ টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধক দিতে হয়। যদি ব্যাংক কর্মকর্তারা বন্ধকীযোগ্য সম্পদ সঠিকভাবে ভ্যালুয়েশন করেন, তাহলে পরবর্তীকালে সেই ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ, কেউই ১০০ টাকা ঋণের জন্য তার ১২৫ অথবা ১৫০ টাকা মূল্যের সম্পদ হারাতে চাইবেন না। কিন্তু এখানেই সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি হয়।

কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ব্যাংকে ঋণের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করার পর ব্যাংক কর্মকর্তারা সেই সম্পদের ভ্যালুয়েশন করে থাকেন। বন্ধকীযোগ্য সম্পদ যাতে অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়, সে ব্যাপারে ঋণগ্রহীতা ব্যাংক ম্যানেজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এজন্য তারা ম্যানেজারকে উৎকোচ প্রদানসহ নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকেন। ব্যাংকের যে টিম বন্ধকীযোগ্য সম্পদ ভ্যালুয়েশনের জন্য গমন করেন, ম্যানেজার তাদের আগেই বলে দেন কত টাকা ভ্যালুয়েশন দেখাতে হবে। ভ্যালুয়েশন টিমের সদস্যদের পক্ষে ব্যাংক ম্যানেজারের নির্দেশনা উপেক্ষা করা অধিকাংশ সময়ই সম্ভব হয় না। সাধারণত ভ্যালুয়েশন টিম একটি নির্দিষ্ট দিনে বন্ধকীযোগ্য সম্পদ ভ্যালুয়েশনের জন্য গমন করেন। ঋণ আবেদনকারীকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, কোন দিন কখন তারা বন্ধকীযোগ্য সম্পদ পরিদর্শনে যাবেন। এ সময় ঋণ আবেদনকারী তার নিজস্ব কিছু লোক অকুস্থলে উপস্থিত রাখেন। টিমের সদস্যরা গিয়ে আশপাশের লোকজনের কাছে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের মূল্য কেমন হতে পারে, তা জানতে চান। উপস্থিত লোকজন সম্পদের মূল্য বাড়িয়ে বলেন। ভ্যালুয়েশন টিমের সদস্যরা সেভাবেই মূল্যায়ন করে থাকেন। তাদের কাছে বিকল্প পন্থায় সম্পদ মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা থাকে না।

বড় আকারের ঋণের ক্ষেত্রে বাইরের ভ্যালুয়েশন ফার্ম দিয়ে বন্ধকীযোগ্য সম্পদ মূল্যায়নের বিধান রয়েছে। ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ভ্যালুয়েশন ফার্ম দিয়ে বন্ধকীযোগ্য সম্পদ মূল্যায়ন করা হয়; কিন্তু বাইরের ভ্যালুয়েশন টিমের পক্ষে ম্যানেজারের মতামত উপেক্ষা করে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। ম্যানেজার যেভাবে বলে দেন, তারা ঠিক সেভাবেই বন্ধকীযোগ্য সম্পদের মূল্যায়ন করে থাকেন। যদি কোনো ভ্যালুয়েশন ফার্ম ম্যানেজারের মতামত উপেক্ষা করে সঠিকভাবে সম্পদের মূল্যায়ন করতে চান, তাহলে পরবর্তীকালে সেই ফার্মকে আর কোনো কাজ দেওয়া হয় না অথবা কাজ দিলেও তার বিল পেতে নানা ঝামেলা সৃষ্টি করা হয়। ফলে কোনো কর্তৃপক্ষই সঠিকভাবে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন না। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটাই হচ্ছে। আবার কোনো একটি ভালো ঋণ প্রস্তাবও ম্যানেজারের বিরূপ মনোভাবের কারণে বাতিল হয়ে যেতে পারে। হয়তো কোনো কারণে ঋণ আবেদনকারীর প্রতি ম্যানেজার অসন্তুষ্ট। তিনি ভ্যালুয়েশন টিমকে বলে দিলেন, এমনভাবে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে ঋণ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এভাবে ব্যাংক ম্যানেজারের রোষানলে পতিত হয়ে ভালো ভালো অনেক প্রকল্প প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। সঠিকভাবে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের মূল্যায়ন না করা হলেও কাউকে এজন্য জবাবদিহি করতে হয় না।

কিভাবে বন্ধকী সম্পদের অতিমূল্যায়ন করা হয়, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের একটি শাখা থেকে জনৈক ব্যক্তিকে ৩০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৬৩ লাখ টাকা মূল্যমানের একটি জমি বন্ধক গ্রহণ করা হয়। দু’বছর পর হেড অফিস থেকে একটি পরিদর্শক টিম বর্ণিত জমির পুনঃমূল্যায়ন করে। টিম দেখতে পায়, যে জমির মূল্য দু’বছর আগে ৬৩ লাখ টাকা দেখানো হয়েছিল, সেই জমির প্রকৃত মূল্য কোনোভাবেই তিন লাখ টাকার বেশি নয়। এ ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ম্যানেজার যদি সৎ এবং নিষ্ঠাবান হন, তাহলে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের অতিমূল্যায়ন রোধ করা সম্ভব। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন উদ্যোক্তা রাজধানীর একটি এলাকার তার একখণ্ড জমি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণের জন্য আবেদন করেন। তিন শতাংশ জমির মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি শতাংশ জমির মূল্য দেখানো হয় ৬০ লাখ টাকা করে। কিন্তু জমির মূল্য অস্বাভাবিক রকম বেশি মনে হওয়ার কারণে নিকটস্থ জোনাল অফিসকে জমিটি পুনঃমূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জোনাল অফিসের ম্যানেজার একজন ইঞ্জিনিয়ারসহ জমিটি পরিদর্শন করেন। তিনি বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান করে জানতে পারেন, জমিটি সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ২ বছর আগে প্রতি শতাংশ ৩০ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করেছেন। এরপর জমি থেকে আধা শতাংশ রাস্তার জন্য দিতে হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য জমির পরিমাণ হচ্ছে আড়াই শতাংশ। এ জমির প্রতি শতাংশের মূল্য কোনোভাবেই ৩০ লাখ টাকার বেশি হবে না। পরিদর্শক টিম সেভাবেই প্রতিবেদন দাখিল করে। এ ঋণ প্রস্তাব পাশ করানোর জন্য ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার পেছনে থেকে তদবির করছিলেন। কিন্তু জোনাল অফিস প্রধানের দৃঢ়তার কারণে জমির মূল্য বেশি দেখানো সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার ঋণ প্রস্তাবকারীসহ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিস প্রধানের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে জমির ভ্যালুয়েশন কম দেখানোর অভিযোগ করেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিসের প্রধানকে তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের ভ্যালুয়েশন কম দেখানোর জন্য গালমন্দ করেন। কিন্তু জোনাল অফিস প্রধান তার বক্তব্যে স্থির থাকার কারণে ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদিত হতে পারেনি।

ঋণদানকালে যদি বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা হতো, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অন্তত ৫০ শতাংশ কমে যেত। কেউ যদি বাঁধের উজানে পানি ঘোলা করে, তাহলে ভাটিতে ঘোলা পানিই প্রবাহিত হবে। কাজেই ভাটিতে ভালো পানি পেতে হলে প্রথমেই উজানে যে বা যারা পানি ঘোলা করছে, তাকে সরিয়ে দিতে হবে। খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পর তা আদায় বা প্রতিরোধের চেষ্টা করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। অযোগ্য গ্রাহককে যাতে ঋণ প্রদান করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা ঋণদান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আর যারা ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, তাদের কোনো না কোনোভাবে ঋণ আদায় কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

এম এ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম