নতুন ভাইরাস এইচএমপিভি : ঝুঁকিতে শিশু ও প্রবীণরা
নাভিদ সালেহ
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উত্তর চীনের বেইজিং ও তদসংলগ্ন এলাকায় হিউম্যান মেটানিউমোনিক ভাইরাস বা এইচএমপিভি নামের একটি ভাইরাস মানবদেহের ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ার খবরে উদ্বিগ্ন এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ায় এবং আক্রান্তদের মাঝে ঠান্ডা-জ্বর বা ফ্লু-র উপসর্গ দেখা দেয়। ৫ বছর ও এর চেয়ে ছোট শিশুরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে বেশি। প্রবীণ ও ইমিউনোকম্প্রোমাইজড রোগীরাও এর ঝুঁকির আওতায় পড়ে। রোগটিতে আক্রান্তদের হাসপাতালে নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চ চাপে অক্সিজেন ও রক্তে স্টেরয়েড অনুপ্রবেশ ছাড়া শ্বাসকষ্ট কমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমস্যা হলো, এই ভাইরাসের কোনো কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। চীনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আক্রান্তদের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়ার বিষয়েও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে আশার কথা হলো, চীন রোগটি এখনো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। হংকং, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন এশীয় গণমাধ্যমে এ মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটে যায়নি বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
এইচএমপিভি বার্ডফ্লু ভাইরাসের সমগোত্রীয়। এটি প্রথম ২০০১ সালে একদল ডাচ বিজ্ঞানী শনাক্ত করেছিলেন। এই ভাইরাসটি কোভিড-১৯-এর মতোই একটি এনভেলপড আরএনএ ভাইরাস। তবে এর গায়ের প্রোটিন কোভিড-১৯-এর স্পাইক প্রোটিন থেকে ভিন্ন। অন্যান্য ভাইরাসের মতো এইচএমপিভি শরীরে প্রবেশ করার পর এর গ্লাইকোপ্রোটিন একে কোষে স্থানান্তর করে। মানবদেহের কোষে আশ্রয় নিয়ে কোষের ক্রিয়াকর্মকে হাইজ্যাক করে ভাইরাস তার বৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এ ভাইরাসটিও কোষের ভেতর তার আরএনএ অর্থাৎ জেনেটিক পদার্থ ছেড়ে দেয়, যা তার এফ-প্রোটিন কপি করে এবং ভাইরাস লোড শরীরে বাড়াতে সক্ষম হয়। কোভিড-১৯-এর মতো এ ভাইরাস শরীরে সাইটোকাইনের ঝড় তোলে না এবং শরীরের নানা অঙ্গকেও আক্রান্ত করে না। এ ভাইরাসের কারণে ফুসফুসের নিচের দিকে ইনফ্লামেটরি রেসপন্স দেখা যায় এবং শ্বাসকষ্টের উপসর্গ বাড়তে থাকে।
রোগটিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে ২ বছর ও এর কম বয়সি শিশুরা। ২০১৩ সালে খ্যাতনামা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন পত্রিকায় প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, বছরে প্রতি ১০০০ শিশুর (৬ মাস ও এর কম বয়সি) মাঝ থেকে তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আবার ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সল্টলেক সিটিতে সংঘটিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এইচএমপিভি সংক্রমিত ২ বছর ও এর কম বয়সি শিশুদের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। অন্যদিকে ৬৫ বছর বা এর বেশি বয়েসের রোগীদের মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি এইচএমপিভি থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের এক্ষেত্রে করণীয় কী? জাতীয় পর্যায়ে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে চীন, জাপান, হংকং ও অন্যান্য দেশে রোগটি কতটা ছড়াচ্ছে। যেহেতু এ ভাইরাসটি শনাক্ত করতে হলে ল্যাবরেটরিতে পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়, তাই দেশব্যাপী সারভিলেন্স এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয়। তবে এশিয়ার অন্যান্য দেশের গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে লিয়াজোঁ তৈরি করার এখনই সময়। স্থানীয় হাসপাতালে অক্সিজেনের প্রতুলতা নিশ্চিত করা দরকার।
ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা কী কী করতে পারি? নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি। যেহেতু এইচএমপিভি একটি এনভেলপড ভাইরাস, তাই সাবান ব্যবহার করে এ ভাইরাসটির ইন্টেগ্রিটি নষ্ট করা যায় সহজে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসি ঘন ঘন চোখে হাত দেওয়া এবং রোগীর ব্যবহৃত থালা-বাটি ব্যবহার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ২ বছর ও এর কম বয়সি শিশুদের আক্রান্তদের সঙ্গে মেলামেশা না করতে দেওয়াই সমীচীন। ১ বছরের কম বয়সি শিশুদের বিশেষ যত্নে রাখা দরকার। যেহেতু শিশুরা এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় এবং যেহেতু এই বয়সি রোগীদের ক্ষেত্রে রোগটির ভয়াবহতাও বেশি, তাই তারাই টার্গেট পপুলেশন হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রবীণদের মাস্ক পরে চলাফেরা করা প্রয়োজন। তাদের যারা সেবা প্রদান করেন, তাদেরও মাস্ক পরে থাকা ও নিয়মিত হাত ধোয়া দরকার।
এইচএমপিভি এখনো মহামারির পর্যায়ে পৌঁছেনি, এটি আশার কথা। তবে যেহেতু শিশু ও প্রবীণদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি এবং রোগটির কোনো প্রতিষেধক নেই ও নিরাময়ের জন্য বিশেষ কোনো ওষুধও নেই, তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ও ব্যক্তি পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখনই কাম্য।
নাভিদ সালেহ : যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিন-এ পুরঃ, স্থাপত্য ও পরিবেশ কৌশল অনুষদের অধ্যাপক