নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
নতুন বছরে মন্দা কাটবে কি?
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
আজ ২০২৫ সালের ৪ জানুয়ারি, শনিবার। চারদিকে খবর আর খবর। রাজনীতির খবর, সমাজ ও কৃষির খবর। রয়েছে অর্থনীতির, ব্যাংকের বড় বড় খবর। সমস্যা হলো, কোনটা রেখে কোনটার ওপর লিখি। ২০২৪ সালের অর্থনীতির ওপর লিখতে হলে শুরু করতে হবে ২০২০ সাল থেকে-করোনা পরবর্তীকাল থেকে। করোনার পরপরই আসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ। সবকিছুর প্রভাব পড়েছে ২০২৪ সালে। একেবারে অর্থনৈতিক উত্তপ্ত অবস্থা। অর্থনীতির কোনো সূচকই নেই যা আক্রান্ত হয়নি। জিডিপি, আমদানি-রপ্তানি, ডলারের মূল্য, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, খারাপ ঋণ, আমদানি সংকোচন, রপ্তানির হিসাবে গরমিল থেকে শুরু করে সবকিছুই হয়ে যায় এলোমেলো। মুদ্রা সংকোচন নীতি গৃহীত হয়। ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পায়। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস পায়। এসব দ্বারা অর্থনীতির সব ক্ষেত্র প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল কয়েক বছর ধরে চলমান মূল্যস্ফীতি, যা এখন আকাশচুম্বী। এসবের প্রভাব থাকে সারা বছর। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সাল সেই অর্থে ছিল ঘটনাবহুল।
বছরটি ছিল সরকারের জন্য ‘ফায়ার ফাইটিং ইয়ার’, সর্বত্র অস্বাভাবিক অবস্থা। ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল জাতীয় নির্বাচন দিয়ে, যেখানে সব দল অংশগ্রহণ করেনি। আবার বছরের মাঝামাঝিতে ঘটে অভ্যুত্থান-ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় আরোহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে। নতুন সরকার, সবকিছুতেই তার নতুনত্ব।
ধরতে গেলে, ২০২৪ সালের অর্ধেক হচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অর্ধেক এবং জুলাই-ডিসেম্বর হচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অর্ধেক। কিন্তু আমরা আলোচনা করছি ২০২৪ সালের অর্থনীতি সম্পর্কে। যদি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখা যায়, তাহলে সবার প্রথমে আলোচনায় আসবে মূল্যস্ফীতি। যেহেতু বিষয়টি বহুল চর্চিত, তাই এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি। মূল্যস্ফীতি বাদে অর্থনীতির আলোচনায় আসে বড় বড় সূচক যেমন-আমদানি-রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক মুদ্রা, ডলারের মূল্য, খাদ্য সরবরাহ ইত্যাদি। রপ্তানির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় ৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ৯০ লাখ ডলারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার ২০২৪ সালের নভেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে বেশি। মুশকিল হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় শ্রমের মজুরি বাড়েনি; মজুরির সূচক বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এতে ৭০-৮০ লাখ পরিবার নতুন করে দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে।
এবার যদি আসি পুঁজিবাজারে, গত এক বছরের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ২৪৬.৫০ পয়েন্ট। আর ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স সূচক অবস্থান করে ৫ হাজার ২১৬.৪৪ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ১ হাজার ৩০.০৬ পয়েন্ট বা ১৬.৪৯ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় পুঁজিবাজার, বিনিয়োগ এবং বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা।
আসা যাক বহুল আলোচিত ব্যাংক খাতে। সবাই জানি, খুবই খারাপ এই খাত। ২০২৪ সালে ব্যাংক খাতে শ্রেণি বিন্যাসিত ‘ঋণের’ পরিমাণ বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। ২০২৩-এর শেষে খারাপ ঋণ ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে তা হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এবং আশঙ্কা, এই খারাপ ঋণ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যাংকে ‘ক্যাশের’ অভাব। আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। ঋণে কড়াকড়ি। ঋণের ওপর সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উঠেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ঋণের ওপর সুদের হার বাড়লেও আমানতকারীদের আমানতের ওপর সুদের হার সেভাবে বাড়েনি। তারা ঠকছে আগের মতোই। এ কারণে সঞ্চয়ের বাজার খুব খারাপ। মানুষ এখনো আস্থার সংকটে ভুগছে। টাকা হাতে রাখতেই পছন্দ করছে।
রাজস্ব খাতে কোনো বড় ধরনের খবর নেই। বরাবরের মতোই রাজস্ব ঘাটতি চলছে। রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম। এতে সরকারের ঋণ বাড়ছে। বাড়ছে সুদের বোঝা। এর মধ্যে মারাত্মক হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের সুদ। এটা বাড়ছে দিন দিন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা টার্গেটের মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এটা বরাবরের ঘটনা। বেসরকারি বিনিয়োগ জুলাই-অক্টোবরে বেড়েছে মাত্র দশমিক ৯১ শতাংশ, যা পূর্বতন সময়ে ছিল ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ডলারের দাম ১২০-৩০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এটি এখনো দুর্মূল্য। সরকার এখন রিজার্ভ থেকে আর ডলার বিক্রি করে না। আমদানি ঋণপত্র খোলাতেও রয়েছে বাধা-নিষেধ। ফলে ডলারের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। গত ২৮ ডিসেম্বর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ঋণের ওপর সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৩-২৪-এ এর পরিমাণ ছিল ৭৭০ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫-এ হবে ১ হাজার ৫৬ মিলিয়ন ডলার। এই বোঝা ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করবে।
রেমিট্যান্সে এবার যথেষ্ট সাফল্য আছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের প্রথম ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪২ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এসেছিল মাত্র ১৯৯ কোটি ডলার। ফলে গ্রামাঞ্চলে ‘ক্যাশের’ আমদানি ভালো আছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। সরকার ভোগ্যপণ্যের আমদানি ঠিক রাখতে গিয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির দিকে নজর দিতে পারছে না। সরাসরি বিনিয়োগও আসছে কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এফডিআই এসেছিল ১৪৭ কোটি ডলার। অথচ এর আগের বছর এসেছিল ১৬১ কোটি ডলার। এদিকে বেকারের সংখ্যা ২০২৪ সালে হয়েছে ২৬ লাখ ৪০ হাজার। আগের বছর ছিল ২৫ লাখ। বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির অবস্থা খুবই খারাপ। ঋণ এখন ব্যবসায়ীদের কাছে অভিশাপ। গত অক্টোবর মাসে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ধান-চালের বিষয়টি দেখা যাক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বোরো ও আমন দুটিরই এবার ফলন কম হবে। সরকার আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এবার করেছে মোট ১০ লাখ টন। এর জন্য অবশ্য অর্থের সংগ্রহ কঠিন কাজ হবে। খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে, অবস্থা মোটামুটি সন্তোষজনক। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, সরকারের গুদামে এখন ১৩ দশমিক ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আছে, যা তিন মাসের জন্য যথেষ্ট। তবে বলা দরকার, এ স্টক গত বছরের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম। এবার দুই-দুইটি বন্যায় আমাদের ফসলের ক্ষতি করেছে। এখন দেখার বিষয় আগামী বোরো ও আউশের ফলন কেমন হয়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ২০২৪ সাল আমাদের গেছে মন্দার মধ্য দিয়ে। উৎপাদন যেমন কম হয়েছে, বেচাকেনাও হয়েছে কম। মেগা প্রকল্পে খরচ কমার ফলে সিমেন্ট, বালি, রড, ইস্পাত, লোহা ইত্যাদির চাহিদা কমেছে। আবার বছরের শেষের দিকে অনেক বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছে। আগামীতে উৎপাদন ও রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে। ব্যাংকে লেনদেন কম হয়েছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে মানুষ উৎপীড়িত। মূল্যস্ফীতির এ ‘অত্যাচার’ ২০২৪ সালের নয়, এটা শুরু হয়েছে ২০২১-২২-এ। এখন পর্যন্ত তা জারি রয়েছে। এবং মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পেতে পারে, এমন কোনো আভাস নেই। আমরা এখন অর্থনীতির ভার দিয়েছি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওপর। তাদের অনেক শর্ত পালন করে চলেছি আমরা। দীর্ঘদিন যাবৎ ‘টাইট মানিটারি পলিসি’ অনুসরণ করছি। টাকা এখন বেশ মূল্যবান। আমদানি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল নই। এখন বলা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী ‘সিন্ডিকেটে’, চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজি মাঝখানে একটু কমেছিল। কিন্তু চারদিকের খবর, তা এখন যথারীতি চালু হয়েছে। এর থেকে কবে মুক্তি মিলবে, আমরা কেউ জানি না।
এদিকে খবর হচ্ছে, অর্থ পাচারের ওপর একটা ভালো শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এতে কত টাকা ১৫ বছরে পাচার হয়েছে, কারা কারা করেছে এবং কোন কোন দেশে তা পাচার হয়েছে, তার বর্ণনা রয়েছে। সরকার এখন ব্যস্ত তা আদায়ে। এদিকে বড় বড় খেলাপির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। এ অবস্থায় বোঝা যায়, ২০২৫ সাল হবে খুবই চ্যালেঞ্জের। এখনো ভোগ্যপণ্যের অভাব রয়েছে প্রচুর। চালের অভাব রয়েছে। আলুর মৌসুমেও আলুর সংকট।
সামনে পবিত্র ঈদ। এ উপলক্ষ্যে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ। এসবের আমদানি ঋণপত্র খুলতে শুরু করেছে ব্যাংক। এর জন্য ডলারের চাহিদা বেড়েছে এবং তাই এর দামও বাড়ছে। এভাবে ডলারের দাম বাড়লে ভোগ্যপণ্যের দামও বাড়বে। এর থেকে আমাদের পরিত্রাণ কী? এখন ভোগ্যপণ্য বেশকিছু পরিমাণে টিসিবির মাধ্যমে বণ্টন করা হয়। কিন্তু টিসিবি ইতোমধ্যেই দেনায় জর্জরিত। ২০২৪-২৫-এ দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এসব দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা অপ্রতুল। সরকার এমনিতেই বড় বড় দেনা এবং তার সুদ পরিশোধে অপারগ হচ্ছে, যা ভালো খবর নয়। এখন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত টিসিবির লাইনে থাকে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কেনার জন্য। এ থেকেই বোঝা যায় প্রকৃত অবস্থা কী।
মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর ব্যবস্থা কী? বর্তমান মন্ত্রিসভায় অর্থনীতিবিদ আছেন; বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পারদর্শী লোক। তারপরও যদি কিছু না হয়, তাহলে আর ভরসা কী? এদিকে এবার পাটের বাজারও খারাপ, কৃষকের হাতে পয়সা আসবে কোত্থেকে? সবকিছুর ফল আইএমএফের ভাষায় আমাদের অনুকূল নয়। তাদের ভাষ্যমতে, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হবে মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এক সময় ছিল ৭ শতাংশের ওপরে। মন্দা অনেক বড়!
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়