ঐকমত্য বাড়িয়ে নির্বাচন অর্জনের বছর
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
একটি চরম স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে এদেশের মানুষ এক নতুন পথে যাত্রা করেছে গত বছরের ৫ আগস্ট। পথটা একেবারে নতুন, তাও বলা যাবে না। ১৯৭১, এমনকি ১৯৯০ সালেও মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-আন্দোলনে জয়ী হয়ে মানুষ যাত্রা করেছিল গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে। সে অভিজ্ঞতা অবশ্য সুখকর হয়নি। গণতন্ত্র যদি হয়ে থাকে এদেশের মানুষের ন্যূনতম প্রত্যাশা, সেটিও পূরণ হয়নি। স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ তার কাছেই ছিল সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা; তাদের দায়িত্বই ছিল বেশি। দ্বিতীয় দফায় চব্বিশে তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে একটি নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে। গণ-অভ্যুত্থানকারীদের ইচ্ছায় একটি অন্তর্বর্তী সরকার এখন দেশ পরিচালনা করছে।
নতুন বছর এসে গেছে এর মধ্যে। নতুন সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হতেও বেশি দেরি নেই। এ সরকারের মেয়াদ অবশ্য সুনির্দিষ্ট নয়; যদিও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট। সেটি হলো-প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোয় সংস্কার এনে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়া। এর কোনোরকম বিকল্পের কথা কল্পনাও করা যাবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিহার করে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের দিকে যেতে পারব না আমরা। হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে সেটাই কিন্তু বিরামহীনভাবে করা হয়েছিল, যা ছিল জাতির সঙ্গে অপরাধ। ‘উন্নয়নের’ নামেই আবার করা হচ্ছিল সবকিছু, যা ছিল একধরনের তামাশা। ২০৪১ সাল অবধি এটা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতা অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে তা বানচাল করে দিয়েছে। জুলাই-আগস্টে তারা রাজপথে নেমেছিল অব্যাহত আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধেও। মানুষ দেখতে পাচ্ছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’সহ বাহারি স্লোগানের আড়ালে দেশটি লুট হয়ে যাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়া রুখে দিতে সক্ষম বলে মনে করা হয়, সেগুলোর পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞও চূড়ান্ত হতাশ করেছিল তাদের।
এ অবস্থা থেকে আমাদের এখন দ্রুত উত্তরণের দিকে যেতে হবে। ২০২৫ এক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হবে, সে প্রশ্নই এ মুহূর্তে জরুরি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার কদিন পর, সেটি কতটা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে-এ প্রশ্নও রয়েছে। দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত পরিবেশ কতটা পাচ্ছে, সে প্রশ্নও কি নেই? সত্যি বলতে, পরিবেশটাও তৈরি করে নিতে হচ্ছে সরকারকে। ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা এ ধরনের পরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুতদের দিক থেকে প্রত্যাঘাতও কিন্তু চলতে থাকে। তার আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক মিত্র থাকলে তারাও যোগ দেয় এতে। ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে সেটি কম ঘটছে না। হাসিনা সরকার প্রশাসনকে সুদীর্ঘ সময় অব্যাহতভাবে দলীয়করণ করায় তাদের নিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজ করাও বলা যায় অসম্ভব। পুলিশকে তো এখনো যথেষ্ট সক্রিয় করে তোলা যায়নি। এতে অর্থবহ সংস্কার আনার আগে পুলিশকে নিয়মিত কাজে সক্রিয় করে তুলতেও বেগ পেতে হচ্ছে। তাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতির ধারা রোধ করা স্বভাবতই সহজ হচ্ছে না। অর্থনীতিও যে অবস্থায় হাতে পেয়েছে সরকার, তাতে শৃঙ্খলাটুকু ফিরিয়ে আনাও কঠিন। ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নিতে গেলে আবার কর্মসংস্থানে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি সহনীয় করে আনার কাজেও অগ্রগতি নেই। তবে শীতে ‘উৎপাদন মৌসুম’ শুরু হওয়ায় কৃষিক্ষেত্র থেকে কিছু সুখবর আসছে। আলু, পেঁয়াজসহ সবজির দাম কমে আসার ঘটনা জনগণ ও সরকার উভয় পক্ষের জন্য স্বস্তির।
এদিকে সরকার শুরু থেকে বলছে, ‘সংস্কারবিহীন নির্বাচন’ হবে অর্থহীন। মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও এর বিপরীতটি বলছে না। তবে সংস্কারের ক্ষেত্র ও গভীরতা নিয়ে আছে মতপার্থক্য। ‘সংস্কারের অধিকার’ নিয়েও কথাবার্তা কম হচ্ছে না। নির্বাচিত সরকারই সংস্কার করবে বলে বিশ্বাস থাকলে অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে হাত দিতে হতো না এ কাজে। আগেকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর মতো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেই তারা চলে যেতে পারতেন। সত্যি বলতে, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতেও এ সংক্রান্ত কিছু সংস্কার করতে হবে। বিদায়ি বছরের শেষদিকে নতুন নির্বাচন কমিশনাররা দায়িত্ব নিয়েছেন। নতুন বছরে তাদের একটি বড় কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা প্রস্তাব করেছেন ১৭ বছর হওয়া মাত্র একজন নাগরিককে ভোটার করার। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এ ব্যাপারে অবশ্য একমত হতে হবে, এটাও তার মত। সব পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই তিনি জোর দিচ্ছেন ‘ঐকমত্যের’ ওপর। যেসব সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলোর সুপারিশ এলে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সরকার জোর দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে। ঐকমত্য ছাড়া কোনো সংস্কারে তারা হাত দেবেন না। কোনো সংস্কারের বিষয়েই এটি অর্জন করা না গেলে ‘অপরিহার্য সংস্কার’ সেরে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাবে সরকার। অপরিহার্য সংস্কার হলো নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার। হাসিনা সরকার নির্বাচনব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিল। স্থানীয় আর পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন বলেও কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। এ ক্ষেত্রটির সংস্কার তাই করতেই হবে সরকারকে। নইলে বিশেষ করে উপযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের পথ সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে।
সংস্কার ও নির্বাচনের যে ‘রোডম্যাপ’ দাবি করা হচ্ছিল, সেক্ষেত্রে কিন্তু একটা অগ্রগতি হয়েছে এর মধ্যে। তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে বলে জোরালো ধারণা জন্মেছে রাজনৈতিক মহলে। সন্দেহ নেই, একটি বড় রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন চাইছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাওয়া তো দোষের কিছু নয়। সেটাই বরং স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো, নির্বাচন না করে কিংবা ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যেতে চাওয়া এবং এর ভেতর দিয়ে অপশাসন চাপিয়ে দেওয়া। গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কোনো দল বা গোষ্ঠী এ পথে যেতে চায় বলে আমরা মনে করতে চাইছি না। কিছুটা বিলম্বে হলেও নির্বাচন হতেই হবে এবং তা হতে হবে পক্ষপাতহীন। আমাদের মনে আছে ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথা, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। একজন ন্যায়পরায়ণ জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে তিনি থেকে যাবেন আমাদের স্মৃতিতে। এবার অবশ্য অনেক জটিল পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তার কোনো বিকল্পও ছিল না। শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে তাকে অবশ্য সহায়তা করে যেতে হবে চব্বিশের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সব পক্ষকে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ‘হাসিনা রেজিম’ অবসানের শেষ মুহূর্তে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের ভূমিকা ছিল চমকপ্রদ। বর্তমানে তারা এমনকি পুলিশের কিছু দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন। দেশরক্ষা বাহিনী হিসাবেও তারা সদাজাগ্রত বলে জনগণ বিশ্বাস করে। সেনাপ্রধানও মাঝে সংস্কার ও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার বিষয়ে নিজ অভিমত জানিয়ে বলেছিলেন, এক্ষেত্রে ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে’ তারা সরকারের পাশে আছেন।
বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোকেও সরকারের পাশে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্য মতপার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সরকারকেই আবার উদ্যোগী হয়ে সেটা দূর করতে হচ্ছে। বিভিন্ন প্রশ্নে ‘জাতীয় ঐক্য’ প্রতিষ্ঠায় আসতে হচ্ছে এগিয়ে। এক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য বলতে অবশ্য আওয়ামী লীগ ও তার সহযাত্রীদের বাদ দিয়েই বুঝতে হবে। এটা হলো গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাস্তবতা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ বিষয়ে সিদ্ধান্তও সরকার নেবে মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত ইচ্ছায়। নিষিদ্ধ না হলে আওয়ামী লীগও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। তবে এ দলের নেতাদের বিরাট অংশকেই যেতে হচ্ছে বিচারের মধ্য দিয়ে। নতুন বছরে এ প্রক্রিয়া কতটা এগিয়ে নেওয়া যাবে, সে প্রশ্নও রয়েছে। ‘আওয়ামী লীগের বিচার শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন নয়’-এমন একটা দাবি অবশ্য উচ্চারিত হচ্ছে একটি পক্ষ থেকে। গণ-অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা অসাধারণ হলেও এ দাবি সম্ভবত সিংহভাগ মানুষ মেনে নেবে না। কেননা নির্বাচন সেক্ষেত্রে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে যাবে। সংবিধান সংস্কার না করে নির্বাচন নয়, এমন বক্তব্যেও সবাই একমত হবে না। সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার নির্বাচিত সংসদে হতে হবে, এ দাবিই বরং জোরালো। সংবিধান সংস্কার কমিশন অচিরেই যে সুপারিশ দেবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ অবশ্য আকর্ষণীয় বিষয় হবে নতুন বছরে। বিদ্যমান সংবিধানেই ‘ফ্যাসিবাদ কায়েমের সুযোগ’ রয়ে গেছে বলে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দল এখন মোটামুটি একমত। এ বক্তব্য জোরালোভাবে সামনে আনা অব্যাহত রেখেছেন গণ-অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা শিক্ষার্থীরা। আশা করা যায়, এমন সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ‘প্রতিশ্রুতিতে’ অন্তত পৌঁছাতে পারবে নতুন বছরে।
শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও সরকার-এ পক্ষগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকা বিচিত্র নয়। তবে অনড় অবস্থান থেকে মতভেদ ও সংঘাত বেড়ে উঠলে মুশকিল। তাতে নতুন পথে যাত্রাটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে সতর্ক থাকতে হবে সরকারকে। সরকার কোনো বিশেষ আদর্শের দল বা গোষ্ঠীর দিকে হেলে থাকলে সেটা সংশোধন করতে হবে নতুন বছরের শুরুতেই। ছ মাস পর তার কাজের আরেক দফা মূল্যায়ন কিন্তু করবে জনগণ। এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও রয়েছে। দ্রুত মনোভাব না বদলালেও তারাও যেন কিছুটা অনুভব করতে পারে-সরকার ব্যাপক মানুষের প্রত্যাশা পূরণে একটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায়’ রয়েছে। চব্বিশের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা কোনো দলও যেন অনুভব না করে, সরকারের চোখে তারা হয়ে পড়েছে বিরোধী দল। এতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থাও বিনষ্ট হবে। শুধু সামনের নির্বাচন তো নয়; ইউনূস সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করে যেতে হবে। নতুন বছরে সেক্ষেত্রে পাকা অগ্রগতিই সবচেয়ে বেশি কাম্য।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, কলামিস্ট