Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কালের পরিক্রমায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার

Icon

ড. আবদুল আলীম তালুকদার

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালের পরিক্রমায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার

ছবি: সংগৃহীত

ফ্যাসিবাদের অর্গল ভেঙে পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশে এসেছে নতুন বছর। পুরোনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে স্বাগত জানানোর উৎসবকেই নববর্ষ হিসাবে পালন করা হয় সারা বিশ্বে। নতুনের প্রতি মানুষের সবসময়ই থাকে বিশেষ আগ্রহ। কালের পরিক্রমায় নতুনের মধ্যেই নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়ণ করার সুযোগ করে দিতে আসে নতুন বছর। আমরা সাধারণত যাকে ইংরেজি সাল বা খ্রিষ্টাব্দ বলে থাকি, আসলে তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। দেশ, জাতি ও সংস্কৃতিভেদে প্রত্যেকের আলাদা বর্ষপঞ্জি রয়েছে। তবে একমাত্র গ্রেগরিয়ান বা ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনেই চলে বিশ্ববাসীর প্রায় সব হিসাবনিকাশ ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে উৎসবের আমেজে সাড়ম্বরে ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসাবে পালিত হয়। তবে বহুকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি তাদের নিজ নিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করে থাকে।

মানুষ আদিকাল থেকেই কোনো না কোনোভাবে দিন-ক্ষণ, মাস-বছরের হিসাব রাখতে প্রয়াসী হয়েছে চাঁদ দেখে, নক্ষত্র দেখে, সূর্য দেখে অথবা রাত-দিনের আগমন-নির্গমন অবলোকন করে বা ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করে। সাধারণত কোনো বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিন, মাস, বছর গণনার রীতি কালক্রমে চালু হয়েছে। তিথি, নক্ষত্র বিশ্লেষণ করার রীতিও আবিষ্কার হয়েছে, উদ্ভাবিত হয়েছে রাশিচক্র। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী যে বছর গণনার রীতি চালু হয়, তা চান্দ্র সন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ চান্দ্র সনে বছর হয় কমবেশি ৩৫৪ দিনে; আর সূর্যের হিসাবে যে বছর গণনার রীতি চালু হয়, তা সৌর সন নামে পরিচিত হয়। সৌর সনের বছর হয় সাধারণত ৩৬৫ দিনে।

ইতিহাসবেত্তাদের মতে, বিশ্বব্যাপী পালিত উৎসবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমীয় সভ্যতায় (যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সে সময়কার দজলা ও ফোরাত নদীর তীরে) প্রথম বর্ষবরণ উৎসব পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমান ইরাকের প্রাচীন নাম ছিল মেসোপটেমিয়া। এ মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা আবার চারটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল-সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসেরীয় ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এগুলোর মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন শুরু হয় ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো বর্ষবরণ উৎসব। তবে তা এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না, বরং তা পালিত হতো বসন্তের প্রথম দিনে। কারণ, শীতের রুক্ষতা ঝেড়ে ফেলে প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজতে শুরু করে বসন্তে। গাছে গাছে নতুন পাতা, বাহারি রঙের ফুল আর পাখিদের কলকাকলিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই নতুন বছরের শুরু হিসাবে পালন করত ব্যাবিলনীয়রা। অবশ্য তখন বছর গণনা করা হতো চাঁদের ওপর নির্ভর করে। যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো নতুন বছর আর বর্ষবরণ উৎসব। চলত টানা ১১ দিন। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমকভাবে বর্ষবরণ উৎসব পালন করত রোমানরাও। তবে তাদের ছিল নিজস্ব ক্যালেন্ডার। যদিও সে ক্যালেন্ডারও রোমানরা তৈরি করেছিল চাঁদ দেখেই। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের নববর্ষ ছিল মার্চের প্রথম দিন। প্রথমদিকে তাদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল ১০টি। ছিল না জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাস। পরবর্তী সময়ে ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমের সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। এরপর রোমান রাজের ইচ্ছানুযায়ী বছরের প্রথম মাস মার্চ থেকে জানুয়ারিতে পরিবর্তন করা হয়। তবে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসাবে চালু করতে বেশ সময় লাগে। এটি প্রথম চালু হয় ১৫৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমে। তখন এটি অনিয়মিতভাবে পালিত হতো। কারণ তখনো বিভিন্ন স্থানে জনগণ মার্চের ১ তারিখকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসাবে ব্যবহার করত। কিন্তু ৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার যখন সূর্যকেন্দ্রিক ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ চালু করেন, তখন জানুয়ারির ১ তারিখকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

মাস থাকলেও রোমানদের ক্যালেন্ডারে ছিল না কোনো তারিখ। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করত রোমানরা। চাঁদ উদয়ের সময়কে বলা হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে তারা বলত ইডেস, আর চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলা হতো নুনেস। পরবর্তী সময়ে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এ ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের পরিবর্তে যোগ করেন দিন-তারিখ। চান্দ্র মাসের হিসাবে সে সময় বছরের মোট দিন দাঁড়ায় ৩৫৫। এভাবে বছর হিসাবের ফলে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকে রোমের চাষিরা। সমস্যার সমাধানের জন্য হোঞ্চাস হেডাস ফেব্রুয়ারির পর অতিরিক্ত আরও একটা মাস যুক্ত করেছিলেন ক্যালেন্ডারে। সমস্যা কমার বদলে আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল সে সময়। পরবর্তী সময়ে জুলিয়াস সিজার চান্দ্র হিসাবের বদলে সৌর মাসের ব্যবহার প্রবর্তন করেন। ফলে ৩৫৫ দিন থেকে বছর হয়ে গেল ৩৬৫ দিনের (তবে অনেকের মতে, তিনি সৌর হিসাবে ৩৬৫ দিনের নয়, বরং ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন!) কথিত আছে, রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার লিপইয়ার বছরেরও প্রচলন করেন। যদিও এ নিয়ে বিতর্কও আছে।

এত কিছুর পরও সমস্যা ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে। সে সমস্যার সমাধান করেন অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস নামের একজন ডাক্তার। তিনি তৈরি করেন নতুন আরেকটি ক্যালেন্ডার। পরবর্তী সময়ে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যাটিকানের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরামর্শক্রমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটির সংস্কার করে তার নামানুসারে প্রচলন করেন, যা বর্তমানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সব জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করে। ফলে আগে যারা নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব পালন করত, তারাও এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসাবে পালন করে। এ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে ‘এডি’ লেখা হয়, তা ল্যাটিন অ্যানো ডোমিনির সংক্ষিপ্ত রূপ। এ অ্যানো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভুর বছর। ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াস নামক এক পাদরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশুখ্রিষ্টের জন্মবছর থেকে হিসাব করে এ খ্রিষ্টাব্দ লিখন রীতি চালু করেন।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আধুনিক বিশ্বে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসাবে প্রচলন করার ক্ষেত্রে ‘রিপাবলিক অফ ভেনিস’ (দেশটি ১৭৯৭ সালে বিলুপ্ত হয়) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ তারা ১৫২২ সাল থেকে এ দিনকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে গণনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে যেসব দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে সিভিল ক্যালেন্ডার হিসাবে গ্রহণ করেছে, তারা সবাই ১ জানুয়ারি তারিখেই ইংরেজি নববর্ষ পালন করে থাকে; যেমন ১৫৫৬ সাল থেকে স্পেন, পর্তুগাল; ১৫৫৯ সাল থেকে প্রুশিয়া, সুইডেন; ১৫৬৪ সাল থেকে ফ্রান্স; ১৬০০ সাল থেকে স্কটল্যান্ড, ১৭৫১ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলো নববর্ষের রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। আর এ ক্যালেন্ডার আমাদের দেশে নিয়ে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। ১৭০০ সাল থেকে রাশিয়া এ রীতি অনুসরণ করতে শুরু করে।

যেহেতু প্রাচীন রোমানদের হাতেই এ ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি, তাই ইংরেজি বছরের বারো মাসের বেশিরভাগেরই নামকরণ করা হয়েছে রোমান দেবতা বা সম্রাটের নামানুসারে। যেমন: জানুয়ারি রোমান দেবতা জানোসের নামানুসারে, ফেব্রুয়ারি ল্যাটিন শব্দ ফেব্রুয়া থেকে, মার্চ রোমানদের যুদ্ধ দেবতা মার্স থেকে, এপ্রিল ল্যাটিন শব্দ এপ্রিলিস থেকে, মে বসন্তের দেবী মায়াসের নামানুসারে, জুন বিবাহ এবং নারী কল্যাণের দেবী জুনোর নামানুসারে, জুলাই রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে, আগস্ট জুলিয়াস সিজারের পুত্র অগাস্টাস সিজারের নামানুসারে, সেপ্টেম্বর ল্যাটিন সপ্তম সংখ্যা সেপ্টেমের নামানুসারে, অক্টোবর ল্যাটিন অষ্টম সংখ্যা অক্টোর নামানুসারে, নভেম্বর ল্যাটিন নবম সংখ্যা নভেমের নামানুসারে এবং ডিসেম্বর ল্যাটিন দশম সংখ্যা ডিসেমের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে।

আগেকার দিনে ‘নিউ ইয়ারে’র আগের রাতকে বলা হতো ‘নিউ ইয়ার ইভ’, বর্তমানে যা ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ নামে প্রচলিত। ইংরেজি নতুন বর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, ইসরাইল রাষ্ট্রটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। কারণ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী অ-ইহুদি উৎস থেকে উৎপন্ন এ রীতি পালনের বিরোধিতা করে থাকে। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। যেমন: সৌদি আরব, নেপাল, ইরান, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তান। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। তবে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করে বেশ জাঁকজমকভাবে। পশ্চিমা বিশ্বের এ উৎসবকে স্বাগত জানিয়েছে আমাদের দেশও। পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে পালনের পাশাপাশি নানা আয়োজনে পালন করা হয় ইংরেজি নববর্ষও।

পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি বীরের জাতি। যুগে যুগে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি কর্তৃক তাদের ওপর চালানো জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে; এমনকি প্রয়োজনে অস্ত্র ধারণ করে বিজয়ী হয়েছে, যা আমাদের সবারই জানা। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লব। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা যে বীরত্ব দেখিয়েছে, তা অনন্তকাল বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এ মহাবিজয় তখনই সত্যিকারার্থে অর্থবহ হবে, যখন আমরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই সব ধরনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে ধর্ম-বর্ণ, দলমতনির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে কাজ করব। যদি আমরা এ কাজে পিছপা না হই, তাহলে আমরা হব বিশ্ববাসীর বিস্ময়।

নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা-হিংসা-বিদ্বেষের পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার পথে দেশ এগিয়ে যাবে বীরদর্পে। যুগে যুগে বিভিন্ন উৎসব পালন নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও উৎসব হোক সর্বজনীন। নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনুক সুখ, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও অগ্রগতি। শুভ হোক আমাদের আগামী দিনগুলো। শুভ নববর্ষ।

ড. আবদুল আলীম তালুকদার : সহযোগী অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম