Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ব্রিজ অন দ্য রিভার তুরাগ

Icon

মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রিজ অন দ্য রিভার তুরাগ

ফাইল ছবি

ঢাকা-আরিচা রাস্তা তৈরির ইতিহাস দেড়শ বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ ভারতে রেল ও স্টিমার সার্ভিস চালুর যুগে তৈরি হয় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। একদিকে ঢাকার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সংযোগ সাধনের জন্য ফরাশগঞ্জে খালের ওপর নির্মিত হয় লোহার পুল ১৮৩২ সালে, অন্যদিকে ঢাকার সঙ্গে আরিচার সংযোগ সাধনের জন্য তুরাগ নদীর ওপর নির্মিত হয় আমিনবাজার লোহার ব্রিজ। হালকা যানবাহন চলাচলের যুগে, সেতুটি ছিল ব্রিটিশ ইস্পাতের অনন্য নিদর্শন। এটি ছিল ঘোড়ার গাড়ি এবং যান্ত্রিক যান-উভয় যান চলাচলের জন্য সমান উপযোগী। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সে সময়টাকে বলা হতো, ঘোড়ার গাড়ির যুগ। তবে এ ব্রিজ, ভারী যান চলাচলের উপযোগী ছিল না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারী যান চলাচল শুরু হয় পাকা রাস্তায়। ঢাকার পঞ্চায়েত সরদার পেয়ার বখ্শের ছেলে মাওলা বখ্শের হাত ধরে ঢাকায় গণপরিবহণের সূচনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত ট্রাক জনসাধারণের উপযোগী করে এক ধরনের যান চালু করেন মাওলা বখ্শ অ্যান্ড সন্স। কাঠের ফ্রেমে টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি হয় বলে, এসব গাড়ির নামকরণ করা হয় ‘মুড়ির টিন’। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত জিপগুলোকে গণপরিবহণের উপযোগী করে একই ধরনের গাড়ি তৈরি করা হয়েছিল, যার নামকরণ করা হয় ‘চান্দের গাড়ি’। শুধু পার্থক্য এই-ঢাকার গাড়িগুলো ছাদবিশিষ্ট আর চট্টগ্রামের গাড়িগুলো ছাদখোলা। ঢাকার গাড়ি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে ওঠে একজন সরদারের উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে। কারণ মাওলা বখ্শ কলকাতা ও ঢাকায় ইংরেজদের মোটর ওয়ার্কসে কাজ করে বিশেষ কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি নতুন ধরনের ২০টি গাড়ি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ঢাকা শহরে গাড়িগুলো চলত গুলিস্তান-নবাবপুর-চকবাজার-সদরঘাট রুটে। ঢাকার বাইরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-আরিচা রুটে। মাওলা বখ্শের গাড়িগুলো ঢাকা-কালিয়াকৈর, ঢাকা-নায়ারহাট ও ঢাকা-মিরপুর রুটে যাত্রী বহন করত। এসব গাড়িগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল পুকার (১৯৩৯), কিসমত (১৯৪৩), আজাদ (১৯৫৫) ইত্যাদি হিন্দি সিনেমার নামানুসারে। সরদার মাওলা বখ্শের গাড়িগুলো ঢাকা-আরিচা রুটে ছুটত পুকার সিনেমার সরদার সংগ্রাম সিংয়ের ঘোড়ার মতোই দুলকি চালে। শুধু ১৯৬৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে মিরপুর ইপিআরটিসি বাস ডিপোতে দোতলা বাস সার্ভিসের যাত্রা শুরুর পরই শেষ হয়ে যায় তার সুবর্ণকাল। ঢাকা-আরিচা রুটে ভারী যান পারাপারের জন্য ছিল ফেরি সার্ভিসের ব্যবস্থা। ১৯৭১ সালে সেতুটি ছিল পাকবাহিনীর জিপ চলাচলের উপযোগী, তবে তাদের ভারী যান পারাপার হতো রো-রো ফেরিতে। মেজর জেনারেল গন্ধর্ব সিং নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী হেলিকপ্টারে করে এসে নেমেছিলেন এ ব্রিজের কাছেই। ব্রিজটি ছিল মিত্রবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে অলঙ্ঘনীয় সীমান্ত। আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে নাগরার অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন নির্ভয় শর্মা এগিয়ে যান ক্যাপ্টেন হিতেশ মেহতাকে নিয়ে এ ব্রিজের ওপর দিয়েই। ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে তাদের সঙ্গে যোগ দেন মেজর শেঠি এবং লেফটেন্যান্ট তেজিন্দর সিং। পাকিস্তানি একজন ক্যাপ্টেন সবাইকে নিরস্ত্র করে নিয়ে যান মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদ, এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে আসার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর ব্রিজের উন্মুক্ত মঞ্চে। সেখান থেকে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে সদর দপ্তরে পৌঁছার পর, আবদুল্লাহ নিয়াজি মেজর জেনারেল জামশেদকে অনুরোধ করেন নাগরাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসার জন্য। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিরপুর ব্রিজে তিনি এসেছিলেন ভারতীয় সৈন্যদের জিপে করে, এবার ব্রিজে ফিরে আসেন রাজকীয় মার্সিডিস গাড়িতে চড়ে। গাড়ির পেছনের সিটে বসে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হন ব্রিগেডিয়ার সান সিং, ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ার ও কাদের সিদ্দিকী।

১৬ ডিসেম্বর সকালে এইচ এস ক্লেয়ার মিরপুর রোড দিয়ে চললেন পদত্যাগপত্রের দলিল স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে সাক্ষী হতে। সাদা পতাকা না থাকায়, সাদা শার্ট উড়িয়ে গাড়িবহর চলল এমন একটি রাস্তা দিয়ে, যে রাস্তায় ১৯৬৯ সালে আসাদের রক্তমাখা শার্ট উড়িয়ে এগিয়ে চলেছিল আইয়ুব পতনের মিছিল। ১৬ ডিসেম্বর বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছিল, তাদের প্রবেশপথ ছিল রুদ্ধ। তুরাগ নদের তীরে তখন এ লোহার ব্রিজটি হয়ে উঠেছিল ঢাকা অভিযানের প্রথম প্রবেশদ্বার। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ব্রিজটি অযত্নে, অবহেলায় শেষাবধি মুখ থুবড়ে ভেঙে পড়ে ২০২১ সালে, যখন দেশে পালিত হচ্ছিল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। পুরোনো লোহার ব্রিজটি ভেঙে পড়ে একটি বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায়। বালুবাহী বাল্কহেড প্রচণ্ড স্রোতের কারণে ব্রিজ অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়ে পিলারে আঘাত হানে। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আটকে থাকা জলযানটিকে তারপর আরও দুটি বাল্কহেড পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। এতে উপর্যুপরি আঘাতে সেতুটির জীবনাবসান নিশ্চিত হয়ে যায়। বাল্কহেডের মতো প্রবল একটি শক্তি জরাজীর্ণ সেতুর ওপর আঘাত হেনে তাকে পর্যুদস্ত করে দেয়-আমিনবাজারের সলিল সমাধির ঘটনা তার একটি বহিঃপ্রকাশ হিসাবেই গণ্য হতে পারে। টি এস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডে এমনি একটি ব্রিজের বর্ণনা আছে, যে ব্রিজ ভেঙে পড়ে নিচে। যার মানে হয়, পাশ্চাত্য সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত লোহার ব্রিজটির হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। ব্রিজটি অমরত্ব পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আশীর্বাদে। মুক্তিযুদ্ধের শেষে কংক্রিটের সেতু উদ্বোধিত হওয়ার পর শুরু হয় লোহার সেতুর প্রত্নজীবন। তার পূর্ণ যৌবনকাল ছিল ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। তারপরই শুরু হয় বিস্মৃতির কাল। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর ধরে বিগত যৌবনা ব্রিজটি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল।

১৯৬৩ সালের পুরোনো আইন অনুযায়ী প্রত্নসম্পদ বলতে বোঝায় ১০০ বছরের পুরোনো সম্পদকে। সে আইন দিয়ে রক্ষা করা সম্ভব হলো না পুরোনো ব্রিজটি। নতুন ‘প্রত্নসম্পদ আইন-২০২১’ জারি থাকা সত্ত্বেও রক্ষা করা সম্ভব হলো না একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। অথচ এটি রক্ষা করা সম্ভব ছিল এ নতুন সংযুক্তিতে যে, শতবর্ষের সময়সীমার আওতাভুক্ত না হলেও বিশেষ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু প্রাচীন হিসাবেই গণ্য (যুগান্তর, ১০-০৯-২০২১)। শুধু তাই নয়, প্রত্নসম্পদ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তার সীমানা ও আশপাশে বলয় তৈরি ও রক্ষার জন্যও নির্দেশনা রয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, স্থাবর প্রত্নসম্পদের সর্বোচ্চ সুরক্ষিত এলাকা বা প্রপার্টি জোন এবং বিশেষ সুরক্ষিত এলাকা বা বাফার জোন সুরক্ষিত থাকবে। ব্রিজের বলয়ে এ আইন কার্যকর করা অধিকতর বাধ্যতামূলক হবে এ কারণে যে, মোগল আমল থেকেই এ এলাকা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ। তুরাগের ওপর এটি এমন একটি ব্রিজ, যাকে তুলনা করা যায় ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’-এর সঙ্গে। ব্যাংকক ও রেঙ্গুনের মধ্যে সংযোগসাধক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ব্রিজটি এখন থাইল্যান্ডের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। ঘটনাস্থলে এখন যখন দ্বিতীয় আমিনবাজার ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে, তখন দুই ব্রিজের মাঝখানে লোহার ব্রিজটি ও তার বলয় হতে পারে ঢাকার বিশেষ পর্যটন আকর্ষণ। সেতুটি সংরক্ষণ করা অবশ্যকর্তব্য মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মারক হিসাবে।

ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ

mahmoodnasirjahangiri@gmail.com

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম