জনপ্রশাসন সংস্কার
জনপ্রশাসন সংস্কারে বাধা কেন?
মেজবাহ হোসেন
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জনপ্রশাসন সংস্কার ও তদসংশ্লিষ্ট কাজ করতে গিয়ে কমিশন বেশ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত। মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া কমিশনের কিছু সুপারিশ কয়েকটি পক্ষ মানতে নারাজ, যার মধ্যে দুটি প্রধান সুপারিশের একটি হলো উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে কোটার পুনর্বিন্যাস এবং পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ এবং অন্যটি হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে জুডিশিয়ারির আদলে আলাদা কমিশনের অধীনস্থ করা। প্রথমটি নিয়ে একটু বিশদ আলাপ করা যাক। কেন প্রশাসন ক্যাডার উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে শতভাগ নিয়োগ দাবি করছে আর অন্যরা কেন ওই পদে সবার উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলছে। এর মূল কারণ হলো আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। এ বৈষম্য দীর্ঘদিনের আর তাদের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ফারাক অনেক বেশি। প্রশাসন ক্যাডারের সর্বগ্রাসী মনোভাব আর তাদের প্রতি রাজনৈতিক সরকারগুলোর অযৌক্তিক অনুকম্পা এ বৈষম্যের মূল কারণ। তাদের প্রাপ্তি, পদোন্নতি, ভাতাদি, ক্ষমতা প্রদর্শনের চৌহদ্দি অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি। তাই প্রশাসনের ওই পদগুলোতে অন্যদের নজর। এখানে একটি খোঁড়া যুক্তি দেওয়া হয় যে, একটি পেশার সঙ্গে অন্য পেশার ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক, তাদের প্রাপ্তিও ভিন্ন হবে। এ কথা ঠিক, তাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু সে ভিন্নতা আকাশ-পাতাল ফারাক হবে না কখনোই। একই বিজ্ঞপ্তি, একই পরীক্ষা, একই নিয়োগ-তাদের মধ্যে পার্থক্য উনিশ-বিশ বা খুব বেশি হলে আঠারো-বিশ হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই পনেরো-বিশ হবে না; যেটি এখন অনেক ক্ষেত্রে দশ-বিশ! তাই যাদের প্রাপ্তি আরেকজনের তুলনায় খুবই কম, তারা পদের পুনর্বিন্যাস চাইবে এটাই নিয়ম। কারণ দীর্ঘ সংগ্রাম করেও তাদের চলতি পদের কোনো মানোন্নয়ন তারা করতে পারেনি।
প্রশাসনে পিরামিড কাঠামোতে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে পিরামিড উলটে দেওয়া হয়; কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে পদ ফাঁকা থাকলেও পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা হয় ইচ্ছা করেই। কারও কারও চাকরিতে উপরে ওঠার কোনো পদই থাকে না। তখন অধিক আকর্ষণীয় পদে যাওয়ার ঝোঁক থাকা অন্যায্য নয়।
প্রশাসনের লোকদের সব জায়গা দখল করার প্রবণতাও নিন্দনীয়। সব সাংবিধানিক পদ, বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের প্রধান, প্রজেক্ট ডিরেক্টর-সবখানে কেন শুধুই সচিব বা অতিরিক্ত সচিব? এগুলো নিশ্চয় প্রশাসন ক্যাডারের কোনো পদ নয়। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি বা অন্য কারও যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কি হতে পারে না? সুতরাং উপসচিব পদে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ বাস্তবসম্মত। চাকরিবিধির তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের কর্মচারীরা যেভাবে কমিশন ও সিনিয়রদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কর্মকাণ্ড করেছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, তাদের ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেনি। তারা হাসিনার আমলের মতো এখনো নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করছেন এবং সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করছেন। মনে রাখতে হবে, তাদের চাকরি, নিয়োগবিধি, প্রটোকল সবকিছুই অন্য ক্যাডারদের মতোই। তাই তাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হতে হবে।
দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে পৃথক কমিশনের অধীনে রাখার প্রস্তাব। এ প্রস্তাবেও সংশ্লিষ্ট ক্যাডার দুটি অনাস্থা-আপত্তি জানিয়েছে। জুডিশিয়ারির আদলে সব টেকনিক্যাল সার্ভিসকে বিসিএসের বাইরে আলাদা একটি কমিশনের অধীনে রাখা অধিক যুক্তিযুক্ত। এতে সার্ভিসগুলোর মানোন্নয়ন সহজ হবে এবং তাদের গুণগত সেবা প্রদান নিশ্চিত হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাতে দক্ষ ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের উন্নত বেতন কাঠামো প্রদান আবশ্যক, কিন্তু বর্তমান বিসিএসের অধীনে সেটি করার কোনো সুযোগ নেই। প্রচলিত বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিতে বিষয়ভিত্তিক মেধাবী ও অভিজ্ঞদের বাছাইয়ের মানদণ্ড সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এসব ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থীদের যোগ্যতা নিরূপণ করতে হবে। এ কারণেও এই নিয়োগ আলাদা কমিশনের মাধ্যমে হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আবার টেকনিক্যাল সার্ভিসে যেহেতু পদোন্নতির ধাপ কম এবং এখানে পিরামিড মডেলের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই এ পেশাগুলোতে একটি নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হওয়ার পর তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির ব্যবস্থা করলে এ পেশার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যাবে (যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা)। তাহলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার কমিশনের এমন একটি যুগোপযোগী প্রস্তাবে অনাস্থা জানাল কেন? দুটি কারণ উল্লেখ করা যায়-এক. আস্থার অভাব, দুই. কমিশনের কমিউনিকেশন গ্যাপ। আস্থার অভাব এ কারণে বলছি যে, সরকার বা আমলাতন্ত্রের অন্যদের প্রতি প্রতারণা করার নজির আছে। তারা তুলনামূলক ক্ষমতাহীনদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতির খেলাপ করেছে বহুবার বা তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করেনি (যেমন, শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক পদ ৪র্থ গ্রেড থেকে ৩য় গ্রেডে উন্নীতকরণ)। এ কারণে তাদের শঙ্কা, ক্যাডার থেকে বের হওয়ার পর তাদের সঙ্গে যদি প্রতিশ্রুত দেনা-পাওনা নিয়ে প্রতারণা করা হয় বা কোনো এক অজুহাতে সেসব ঝুলিয়ে রাখা হয়, তাহলে তারা লাভবান হওয়ার পরিবর্তে উলটো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ এসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকবে যথারীতি প্রশাসনের হাতেই। আর প্রশাসন ক্যাডার যে অন্য কারও ভালো দেখতে পারে না, তাদের সবকিছু চাই এটা প্রমাণিত; সেখানে ক্ষমতাহীন পেশাজীবীদের উন্নয়নে তারা কতটুকু সদ্ভাব দেখাবে, তা নিয়ে সন্দেহ হওয়া অমূলক নয়। এ শঙ্কা দূরীকরণে কমিশনকে ভূমিকা রাখতে হবে। ওই ক্যাডারের নেতাদের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের সরাসরি কথা বলতে হবে। প্রস্তাবিত আলাদা কমিশনে তাদের কী প্রাপ্তি ও সুরক্ষা থাকবে, সেসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের জোর প্রতিশ্রুতি থাকবে কমিশনের সুপারিশে। প্রচলিত সুযোগ-সুবিধার তুলনায় প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতিতে তাদের প্রাপ্তি ও মর্যাদা অধিক হলে কেবল তখনই কেউ সেখানে যেতে চাইবে, নতুবা নয়।
এভাবে সবার জন্য মোটা দাগে সমতা নিশ্চিত করতে পারলে আন্তঃপেশা উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং জনপ্রশাসনসহ প্রতিটি সেক্টরে সেবা প্রদান গতিশীল হবে। তাই সংস্কার কমিশনের উচিত সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা পেশ করা এবং যে কোনো চাপ উপেক্ষা করে তা বাস্তবায়নের জন্য জোর সুপারিশ করা।
মেজবাহ হোসেন : শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, হাবিপ্রবি; পিএইচডি ফেলো, কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র