শতফুল ফুটতে দাও
সিরিয়া : কোথা থেকে, কোন পথে
ছবি: সংগৃহীত
সিরিয়ায় একনায়কত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক বাশার আল আসাদ রেজিমের পতন ঘটেছে। মিডিয়ায় বাশারের ভাগ্য সম্পর্কে নানা জল্পনা-কল্পনার পর জানা গেছে, তিনি রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। তার পতন ও রাশিয়ায় আশ্রয় লাভের সঙ্গে অনেকেই শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে আশ্রয় লাভের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করেন। তবে দুটি ঘটনার মধ্যে বেশ মিল থাকলেও ঘটনা দুটি একরকম নয়। এ যাত্রায় বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের অভিযানে বাশার সরকারের পতন ঘটে। বাশারের অনুগত সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের প্রতিহত করতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বাশারের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি তার বাসভবনেই রয়েছেন এবং নতুন সরকারের কর্মকর্তাদের শপথ গ্রহণে তিনি প্রস্তুত আছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া রক্তপাতহীনভাবেই ঘটছে। এ পরিস্থিতিকে আমরা যদি রুশ সমর্থনে কয়েক বছর আগে বিদ্রোহ দমনে আসাদের প্রয়াসের তুলনা করি, তাহলে ভাবাই যায় না সিরিয়ায় অনেকটা নির্ভেজালভাবে কেন এবং কী করে রেজিমের পরিবর্তন হলো।
পর্যবেক্ষকদের মতে, সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আনবে। এর আলামত আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছি। সিরিয়ার গোলান মালভূমির বাফার জোনের বেশকিছু অংশ ইসরাইল দখলে নিয়েছে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সিরিয়ায় গোলান মালভূমি ইসরাইল দখল করে নেয়। এ মাসের ৯ ডিসেম্বরের সিরীয় মিডিয়ার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শতাধিক হামলা চালিয়েছে। এ তথ্য দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। সিরিয়ার স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গবেষণা কেন্দ্রের ওপর হামলা করা হয়েছে। এ হামলা নিছক সন্দেহবশত করা হয়েছে। আমরা জানি, ইরাকে মার্কিন হামলার জন্য অজুহাত হিসাবে বলা হয়েছিল, ইরাকে জনবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে। পরে দেখা গেছে, সে রকম কিছুর অস্তিত্ব ইরাকে নেই। সিরিয়ার ক্ষেত্রে ইসরাইলিরা যা করছে, তার উদ্দেশ্য তাৎপর্যহীন নয়। ইসরাইল বলছে চরমপন্থিদের হাতে যাতে সিরিয়ার অস্ত্রভান্ডার চলে না যায়, তার জন্যই ইসরাইল এসব পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইতোমধ্যে সিরিয়া থেকে ইরান ও হিজবুল্লাহর অবস্থান উৎপাটন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সিরিয়ায় বাশার সরকারের পতনের ফলে ইরান, হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিরা দুর্বল হয়ে পড়বে। দুর্বল হয়ে পড়বে হামাসও। ইসারাইলি হামলায় প্রধান নেতৃত্ব নিহত হওয়া সত্ত্বেও হামাস ও হিজবুল্লাহর মনোবলে চিড় ধরানো যায়নি। কিন্তু এখন বাশার আল আসাদের সিরিয়াকে স্ট্র্যাটেজিক মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে হামাস ও হিজবুল্লাহর যে শক্তি ছিল, তা এখন বাশারহীন অবস্থায় কাবু হয়ে পড়েবে। এক কথায় বলা যায়, ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ এবং আরব প্রতিরোধ অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। তা সত্ত্বেও কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইসরাইল তার আগ্রাসী যুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেচুরে পড়বে। এ রকম অবস্থা দু-চার বছরের মধ্যেই ঘটবে বলে এ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। তাদের যুক্তি হলো, গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩০ শতাংশ ইসরাইলি ইসরাইল ছেড়ে অন্য দেশে অভিবাসী হয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, ইসরাইলি জনগণের মধ্যে তাদের কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইলের ওপর আস্থার ঘাটতি শুরু হয়েছে। এ ঘাটতি আগামী দিনগুলোয় আরও বাড়বে।
ইসরাইলের অভ্যন্তরে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেমেছে। তাদের দৃষ্টিতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিজের ক্ষমতার গদি আটকে রাখার জন্য যুদ্ধকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক কৌশল মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিকে অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময় একটি বিষয় চাউর হয়েছিল, তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুনরাঙ্কন করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এ জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে অনুমান করা ভুল হবে না যে, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুনরাঙ্কনের প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি রমরমা হবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে বহু প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয় হবে। অনেক রক্ত ঝরবে এবং মানবিক ট্র্যাজেডি অসহনীয় দুঃখ-বেদনার জন্ম দেবে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কোয়ার্টারে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ব্রিটিশ উদ্যোগে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল। নতুন নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের নতুন সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব নিয়ে লরেন্স অব এরাবিয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনিও প্রচলিত আছে।
যে সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন হয়েছে, সেই সিরিয়ায় তার পিতা হাফেজ আল আসাদ দীর্ঘ ৩০ বছর দেশ শাসন করেছেন। এজন্য বলা হয়, সিরিয়ায় বাশার পরিবারের শাসনের অবসান হলো ৫৩ বছর পর। হাফেজ আল বাশার লৌহমুষ্টিতে তার শাসন চালিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র বাশার আল আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। ব্রিটেনে দন্ত চিকিৎসক হিসাবে উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত বাশার আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলেন। এর ফলে সিরিয়ার উদার গণতন্ত্রবাদীরা আশাবাদী হয়েছিল। কিন্তু সেই আশাবাদ ছিল ক্ষণস্থায়ী। বাশারও লৌহদৃঢ় হস্তে দেশ শাসনের প্রক্রিয়া বেছে নেন।
একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে সিরিয়া তার ক্ষুদ্র জনসংখ্যা, আয়তন এবং অর্থনৈতিক সম্পদের তুলনায় আধুনিক সিরিয়া অনেক বেশি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল। কারণ তার ছিল শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা, দৃঢ়চেতা পররাষ্ট্রনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যের হৃৎপিণ্ডে তার অবস্থান। সিরিয়ার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসরাইল, লেবানন, তুরস্ক, ইরাক এবং জর্ডান। এর ফলে এ রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান বিরোধগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। ইসরাইল ছিল তার সবচেয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ।
সিরিয়ার ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ ও দীর্ঘ। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে সিরিয়ার অভ্যুদয় ১৯২০ সালে। এ সময় পাশ্চাত্য শক্তিগুলো এ রাষ্ট্রটিকে অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্য থেকে বের করে আনে। এ সময় দেশটি ফরাসি উপনিবেশ ছিল এবং ১৯৪৬ সালে এটি স্বাধীনতা অর্জন করে। এ রাষ্ট্রটির সমস্যা ছিল এই যে, এতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর চাহিদার সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এর সীমান্তের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও সাযুজ্য ছিল না। শুরু থেকে এর বাসিন্দারা রাষ্ট্রটিকে খুব বৈধ মনে করেনি। এ জনগোষ্ঠী চেয়েছিল বৃহত্তর নিখিল আরব রাষ্ট্রের অংশ হতে। ১৯৫৮ ও ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিরীয় রাষ্ট্রটি মুছে যায় এবং মিসরের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। সিরীয় সরকারের জন্য নিখিল আরব জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ পরবর্তী সময়েও বৈধতা যোগ করতে থাকে। তবে সময়ের প্রবাহে রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক কেন্দ্র এবং স্পষ্ট পরিচয় ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৩ সালের পর থেকে নামমাত্র নিখিল আরব, সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টি নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশ শাসন করতে থাকে। অবশ্য ১৯৬৬ সালে একটি ক্যু’দেতা হয়। যার ফলে বাথ পার্টির বামপন্থি অংশ সালাহ জাদিদের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৭০ সালে আরেকটি ক্যু’দেতার মাধ্যমে হাফেজ আল আসাদ ক্ষমতায় এসে মধ্যপন্থা অনুসরণ করেন। অব্যাহতভাবে বাথ পার্টির শাসন আগেকার অস্থিতিশীলতার বিপরীতে নাগরিক স্বাধীনতার চড়া মূল্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করে। শিকড়ের দিক থেকে বাথ শাসন ছিল একটি কর্তৃত্ববাদী সামরিক একনায়কত্ববাদ। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ ছিলেন সর্বপ্রধান ব্যক্তি, তিনি সংখ্যালঘিষ্ঠ আলাউল মাজহাবের সদস্য ছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতো পার্লামেন্টের মনোনয়নে ৭ বছর মেয়াদের জন্য। হাফেজ আল আসাদ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৯৯ শতাংশ ভোটে জয়লাভ করেন।
তত্ত্বগতভাবে বাথ পার্টি মাতৃপ্রতিম ছয়টি ক্ষুদ্র দলের সঙ্গে National Progressive Front গঠন করেছিল। তারা বাথ পার্টির তুলনায় স্পষ্টত অধস্তন অবস্থায় ছিল। তাদের ছিল না কোনো স্বাধিকার, ছিল না কোনো খাঁটি নির্বাচনি এলাকা। তারা সামরিক বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনুসারী তৈরি করতে পারত না। এ অধিকার কেবল বাথ পার্টিরই ছিল। সরকারের মন্ত্রিসভায় সব পদ বাথ পার্টি পেত। জনসংসদ সাধারণ ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হতো। এদের দৃশ্যমানতা ছিল, কিন্তু ছিল না খুব একটা ক্ষমতা। জনপ্রতিনিধিত্বের ভ্রম সৃষ্টি করার জন্য ১৯৯০ সালের নির্বাচনে গণসংসদের আসন এবং স্বতন্ত্র প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। সংসদের ২৫০টি আসনের অর্ধেক শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। National Progressive Front দুই-তৃতীয়াংশ আসনে ‘জয়ী’ হয়। বাকি আসনগুলো স্বতন্ত্ররা লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনগুলো মুক্ত কিংবা উন্মুক্ত ছিল না। বাথ পার্টি নিয়ন্ত্রণ করত কে ব্যালটে জয়লাভ করবে এবং মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্ধারণ করা হতো কার কথা শোনা হবে। এভাবে সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বাথ পার্টি সিরিয়ায় একটি একনায়কত্ববাদী ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা বাশার আল আসাদের নিয়তিকে নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে পরবর্তী কলামে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ