রাষ্ট্রীয় অফিসে দলীয় রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ হোক
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
এমএ খালেক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![রাষ্ট্রীয় অফিসে দলীয় রাজনীতি চিরতরে নিষিদ্ধ হোক](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/12/10/গুমে-জড়িত-(4)-6757756c99173.jpg)
স্বাধীনতা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসংখ্যা এবং সরকার এ চারটি আবশ্যিক উপকরণ বা স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। এ চারটি উপকরণের একটিও যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে তাকে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা যাবে না। রাষ্ট্রের চারটি আবশ্যিক উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ হচ্ছে সরকার। সরকার পরিবর্তিত হলেও রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু অন্য তিনটি উপকরণ বিদ্যমান থাকতে হয়। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ও সরকারকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকি। অর্থাৎ মনে করি, সরকার ও রাষ্ট্র একই সত্তা। কিন্তু বিষয়টি আসলে তেমন নয়।
সরকারের কোনো নিজস্ব সম্পত্তি নেই। সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের আমানতদার মাত্র; রাষ্ট্রের জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জনকল্যাণের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। বিভিন্ন সময় যারা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেছেন, তারা নিজেদের দেশের মালিক বলে মনে করেছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। অতীতে যারাই সরকারে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তারা মনে করেছেন, তারাই দেশের মালিক এবং ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব তাদেরই। সরকারের বাইরের কারও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কথা বলার অধিকার নেই। কেউ যদি সরকারে কোনো কাজের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বা অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাহলে তাকে প্রায়ই রাষ্ট্রদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করা হতো। আসলে সরকার বিরোধিতা করা আর রাষ্ট্র বিরোধিতা করা এক বিষয় নয়। নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পদের জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের মতামত জ্ঞাপন করেন। বস্তুত সাধারণ মানুষও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। তারাও মনে করেন, সরকার মানেই হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। তারা সরকারের অনুগ্রহের পাত্র বৈ কিছু নন।
বিগত সরকারের আমলে অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এ উন্নয়ন কিসের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে? কথায় বলে, সর্বাধিক উন্নয়ন সর্বনিম্ন দুর্নীতি একটি দেশের জন্য উন্নয়নের রোল মডেল হতে পারে। এমনকি তুলনামূলক কম উন্নয়ন এবং অতি সীমিত দুর্নীতিও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই দুর্নীতির জন্য উন্নয়ন কাম্য হতে পারে না।
গত সরকারের আমলে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তা কতটা টেকসই, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শুধু উন্নয়ন হলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সেই উন্নয়ন কতটা জনকল্যাণমূলক এবং কতটা টেকসই, তা নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ এ উন্নয়নকার্য কোনো ব্যক্তি বিশেষ বা কোনো রাজনৈতিক দলের অর্থে সম্পাদিত হয় না। জনগণের করের অর্থে এ উন্নয়নকার্য সম্পন্ন হয়। কাজেই উন্নয়ন কতটা টেকসই এবং সাশ্রয়ী, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অধিকার অবশ্যই জনগণের রয়েছে। অতীতে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি পরিচালনার জন্য সরকারি উদ্যোগে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণ করা হয়েছে।
যখন সরকারি খাতে উন্নয়ন হয় এবং সেই তুলনায় ব্যক্তি খাত পিছিয়ে পড়ে, তখন বুঝতে হবে, দেশের টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারি খাত, বিশেষ করে অবকাঠামোগত খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সেই তুলনায় ব্যক্তি খাতের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সরকারি খাতে উন্নয়ন বেশি হলে, বুঝতে হবে সেখানে দুর্নীতি হচ্ছে এবং বিনিয়োগ হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকার টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করবে আর সেটি কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি খাত উৎপাদনশীল খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কিন্তু অনেক বছর ধরেই দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার একই পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে ব্যক্তি খাত, বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের হার বিদ্যমান হারের তুলনায় আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল। ১৫-২০ বছর ধরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার অন্তত ৪০ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু তা হচ্ছে না। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে জিডিপির ২৭ শতাংশ। নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার ন্যূনতম কোনো সম্ভাবনা নেই।
গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই ভালোভাবে চলেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। তখন যেসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ওই সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-পদোন্নতিতে ব্যাপকমাত্রায় দুর্নীতি হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারদলীয় রাজনীতির চর্চা চলেছে প্রকাশ্যে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো অবস্থাতেই দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন না। এটি তার চাকরিবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তা-কর্মচারী দলীয় রাজনীতির চর্চা করেছেন। যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন, তাদের কিছু কমন বৈশিষ্ট্য আছে। নিজসমর্থিত দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে, তখন তারা কোনো রাজনীতি চর্চা করেন না। তারা সেই সময় নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। যখনই সমর্থিত দল ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন তারা তৎপরতা শুরু করেন। অর্থাৎ এরা রাজনৈতিক দলের অসময়ের বন্ধু নন। সুসময়ের সুবিধাভোগী বন্ধু মাত্র। যারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেন, তাদের অনেকেই অতীতে কৃত দুর্নীতির দায় এড়ানো অথবা নতুন করে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থবিত্ত তৈরির জন্য এসব পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হন। অতীতে আমরা লক্ষ করেছি, যারা বিভিন্ন পরিষদের ব্যানারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেছেন, কারও কারও আচরণ এমন ছিল যে, সাধারণ কর্মকর্তারা এদের দাপটে দিশেহারা হয়েছেন।
যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন, তারা কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো ইস্যুতে দাবি আদায়ের চেষ্টা করতে পারেন না। এটি তাদের চাকরিবিধির পরিপন্থি। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসেই একটি নির্বাচিত অফিসার সমিতি থাকে। অফিসার সমিতি বিভিন্ন দাবিতে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাতে পারেন। কিন্তু তারা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি অথবা ধর্মঘটে যেতে পারেন না। কিন্তু দেখা যায়, অফিসার সমিতির বাইরে বিভিন্ন পরিষদের নামে এরা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অফিসে একাধিক কর্মচারী ইউনিয়ন থাকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ৪-৫টি কর্মচারী ইউনিয়নও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটি প্রতিষ্ঠানে কেন একাধিক কর্মচারী ইউনিয়ন থাকবে? যারা কর্মচারীদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন, তারা কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। এর বাইরে কোনো ইউনিয়ন থাকা কাম্য নয়। অতীতে লক্ষ করা গেছে, কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা অনেক সময় তাদের বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবি আদায়ের নামে কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন।
রাষ্ট্রীয় অফিসে দলীয় রাজনীতির চর্র্চা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। যারা বিভিন্ন পরিষদের নামে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় অফিসে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেছেন অথবা ভবিষ্যতে করবেন, তাদের আইনের আওতায় এনে চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় অফিসে কোনোভাবেই দলীয় রাজনীতি চর্চা চলতে দেওয়া যাবে না। কর্মকর্তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে, হয় আপনারা চাকরি করবেন, না হয় রাজনীতি করবেন। এ দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তি আছেন কিনা, এটাও অনুসন্ধানের বিষয়। এছাড়া অনেকেই আছেন, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে চাকরি করে চলেছেন। এদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুতকরণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই প্রত্যাশিত গতিতে কর্ম সম্পাদন হচ্ছে না। বিষয়টি অনেকেই উপেক্ষা করে চলেছেন। কিন্তু এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি প্রবণতা। পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য ও কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তেমন একটা তৎপর বলে মনে হচ্ছে না। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তার মাঝে কেমন যেন হতাশা বিরাজ করছে। যারা এতদিন দলীয় আনুকূল্যে কর্মজীবনে নানা অনৈতিক সুবিধা আদায় করেছেন তারা নতুন সরকারকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সহযোগিতা করবেন না, এটা মোটামুটি ধারণা করা যায়। প্রতিটি অফিসেই কিছু কর্মকর্তা পাওয়া যাবে যারা সুযোগ পেলেই বর্তমান সরকারকে বিপদে ফেলতে চাইবেন। অনেকে গোপনে সরকারবিরোধী তৎপরতায় নিয়োজিত আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আমলাতন্ত্র যদি প্রত্যাশিত মাত্রায় সরকারকে সহযোগিতা না করে তাহলে সরকারের পক্ষে সাফল্য অর্জন করা খুবই কঠিন হবে। কারণ সরকারকে বিভিন্ন কার্য সম্পাদনের জন্য আমলাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কাজেই আমলাদের শতভাগ আনুগত্য ও সহযোগিতা একান্ত কাম্য। বিগত সরকার আমলে যারা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভ করেছেন তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণত জুনিয়র অফিসার এবং সিনিয়র অফিসার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরাসরি নিয়োগ দান করা হয়। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয় বিবেচনায় উচ্চ পদে প্রথমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে চাকরি নিয়মিতকরণ করা হয়েছে। এভাবে যারা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে প্রবেশ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক