Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

আজ একটি বিশেষ দিন

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আজ একটি বিশেষ দিন

নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহীয়সী বেগম রোকেয়া নারী জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনতে কঠোর পণ ও পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, নারীকে তার ন্যায্য অধিকার আদায়, অর্থনৈতিক মুক্তি তথা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দিতে পারে একমাত্র শিক্ষা। কারণ তার জন্মের আগে থেকে নারীরা এক অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে বাস করছিল। তাদের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। নারীদের শিক্ষার আলো থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করায় তারা শৃঙ্খলিত বন্দি জীবনযাপন করতেন। আমাদের সমাজে সেই অনাদিকাল থেকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীরা অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছিল। মহীয়সী বেগম রোকেয়া শৈশবকাল থেকে উপলব্ধি করেছিলেন, নারী জাতিকে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা।

রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মাবার কারণে সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর চাপে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তার বড় দুই ভাই ইংরেজি স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলেও বেগম রোকেয়াসহ অন্য দুই বোন আরবি শিক্ষা ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থ পড়ার সুযোগ বা অনুমতি পাননি। বেগম রোকেয়ার পিতা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলী সাবের ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও বিনয়ী স্বভাবের মানুষ। দুই পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে রোকেয়া ছিলেন চতুর্থ। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের সহযোগিতায় তার বড় বোন করিমুন্নেসা ঘরে বসে কিছুটা লেখাপড়ার সুযোগ পেলেও, রোকেয়া সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পাঁচ বছর বয়স থেকে অবরোধবাসিনী হয়ে তার জীবন শুরু হয়। সাবের পরিবারের অবরোধবাসিনীর প্রথা ভেঙে প্রথমে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন তার বড় বোন করিমুন্নেছা। তাই বড় বোনের মতো বেগম রোকেয়াও কঠিন কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার জন্য কঠিন সংগ্রামের পথ বেছে নেন। বড় বোন করিমুন্নেসার মতো তিনিও ইংরেজি ও বাংলা শিক্ষার ওপর জোর দেন। কিন্তু সমাজপতিদের কাছ থেকে চাপ আসতে থাকে। মেয়েদের লেখাপড়া করা অন্যায়। কিন্তু রোকেয়া এ ব্যাপারে আপসহীন। বাবা-মা চিন্তিত হলেন, সমাজের রীতিনীতিকে তারা কিভাবে উপেক্ষা করবেন? অনেক চিন্তাভাবনার পরে তারা ছোট্ট রোকেয়াকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রোকেয়ার বড় দুই ভাই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। রোকেয়ার বিয়ে হয় উচ্চশিক্ষিত অবাঙালি সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় বিবাহিত জীবন তার জন্য বয়ে আনে আশীর্বাদ। বিহারের অধিবাসী উচ্চশিক্ষিত সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন অত্যন্ত উদার ও সুন্দর মনের মানুষ। পড়াশোনার ব্যাপারে তার স্বামী তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দেন। রোকেয়ার জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে সাখাওয়াৎ হোসেনের পরম মমতা, সহযোগিতা ও সাহচর্যে। স্বামীর ঘরে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যান। সে সময়ে আমাদের নারী সমাজ ছিল অশিক্ষা আর কুশিক্ষার বেড়াজালে আবদ্ধ। তাই রোকেয়া কলম ধরলেন নারী শিক্ষা আর নারী জাগরণের জন্য। লিখেন বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ হতে থাকে। নবনূর পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সমাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতা-মাতা উভয়েরই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের সর্বত্রই আমরা যাহাতে তাহাদের পাশাপাশি চলিতে পারি, আমাদের এইরূপ গুণের আবশ্যক।’ তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে নারী সমাজের ভাগ্য পরিবর্তনের অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যান।

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর ও মৃত্যু ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এ দিনটি বাঙালি জাতি, বিশেষ করে এ উপমহাদেশের নারী জাতির জীবনে একটি বিশেষ দিন। ১৯১০ সালে কলকাতায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল মুসলিম মেয়েদের জন্য অবিভক্ত বাংলার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন ও কুসংস্কারে ঢাকা সমাজে বাড়ি বাড়ি ঘুরেও তিনি আশানুরূপ ছাত্রী জোগাড় করতে পারেননি। মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে তিনি স্কুল শুরু করেন। পরে ১৯১৫ সালে অর্থাৎ ৫ বছর পরে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ৮৫ জনে উন্নীত হয়েছিল বলে জানা যায়। যে ক’জন ছাত্রী তার স্কুলে পড়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে তারাই নারী জাগরণের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাকে যারা সহযোগিতা করেছিলেন, তাদের মধ্যে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, বিচারপতি সৈয়দ আমীর আলী, মওলানা মোহাম্মদ আলী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, বদরুদ্দিন হায়দার অন্যতম। কবি সরোজিনী নাইডু নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার নিরলস প্রচেষ্টার জন্য তাকে প্রশংসাপত্র লিখেন। সবার সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল এক সময় সরকারি মঞ্জুরি লাভ করে। সার্থক হয় বেগম রোকেয়ার সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রম।

বেগম রোকেয়া নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলেছেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেন নিন্দা গ্লানি অপমান কিছুই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড়, ঝঞ্ঝা, বজ্র বিদ্যুৎ থেকে সবাই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’ তিনি তার অন্য একটি লেখায় বলেছেন, ‘দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ কিন্তু ঘরে ঘরে নারীদের অবস্থা ক্রীতদাসীদের চেয়ে কোনো অবস্থায় ভালো নয়। দাসরা তো তবু মুক্তির স্বপ্ন দেখেন; কিন্তু নারীরা তো সেই স্বপ্নের কথা ভাবতেই পারেন না।’ বেগম রোকেয়া সেই সময়ে উপলব্ধি করেছেন, ‘ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছে।’ স্ত্রী শিক্ষার বিরোধিতাকারীরা বলেন, ‘শিক্ষা পেলে তারা অশিষ্ট ও অমান্যকারী হয়।’ তাদের উদ্দেশে রোকেয়া বলেছেন, ‘তারা নিজেদের মুসলমান বলেন, অথচ ইসলামের মূল সূত্রের বিরুদ্ধাচরণ করেন। শিক্ষা পাইয়া যদি পুরুষগণ বিপথগামী না হয়, তাহলে স্ত্রী লোকেরা কেন বিপথগামী হইবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে যে নারী অপমান ও নির্যাতন সহ্য করেন, স্বামী ও সংসারের দাসত্ব যে নারী বিনা প্রতিবাদে পালন করে যান, সমাজের চোখে সে নারীই আদর্শ। সমাজে নারী ও পুরুষের সমকক্ষতার জন্য যদি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে হয়, তবে সেটাই করতে হবে।’

অন্ধকার, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম সমাজে বাস করে মহীয়সী এ নারী যেসব কথা বলেছেন, তা অচিন্তনীয়। কতটা সাহসী, বুদ্ধিমতী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে তিনি সেই যুগে বসেও এ ধরনের বাস্তব সত্য কথা অকপটে বলতে পারেন। নারী জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয়। তাকে নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় এজন্য যে, তার আগে আর কোনো মুসলিম নারী-সমাজের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এতটা আলোড়ন তোলেননি। বেগম রোকেয়ার অসীম সাহস, ধৈর্য, নিষ্ঠা, মনোবল ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এদেশের নারীজাতি শিক্ষা, দীক্ষা, জ্ঞান গরিমায় পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তাদের সম্মানজনক আসন করে নিতে পেরেছে। নারী এবং পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেই নারী। এ বিপুলসংখ্যক নারী যদি সমাজের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে না আসত, উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত না হতো, তাহলে দেশ এগিয়ে যেত কীভাবে?

নারীরা আজ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। আর সে কারণেই আমাদের সমাজ, বিশেষ করে নারী সমাজু এ মহীয়সী বীর নারীর কাছে চিরঋণী ও চিরকৃতজ্ঞ। তার আদর্শ, তার শিক্ষা, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আমাদের নারী সমাজের অনুপ্রেরণা। তাই এ দেশের মানুষ, বিশেষ করে নারীসমাজ এ দিনটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করে।

মনজু আরা বেগম : লেখক, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক

monjuara2006@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম