Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভারতকে তার বাংলাদেশ নীতি বদলাতে হবে

Icon

মাহমুদুর রহমান মান্না

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতকে তার বাংলাদেশ নীতি বদলাতে হবে

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। স্বৈরাচার সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এই বিজয়ের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণ নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসর কয়েকটি রাজনৈতিক দল বাদে স্বৈরাচার হাসিনার বিরুদ্ধে সাড়ে ১৫ বছরে ধরে লাগাতার আন্দোলনে থাকা দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশকে এতটা ঐক্যবদ্ধ আর কখনো হতে দেখা যায়নি। দু-একটি বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানের সব শক্তি এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে, সর্বাত্মকভাবে তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এখানে ব্যতিক্রম আওয়ামী লীগ এবং তাদের দোসররা। শুরু থেকেই তারা সরকার ও দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য দেশে-বিদেশে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে।

৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে বলে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া কিছু ফোনকল থেকে বোঝা যায়, প্রকাশ্যে না এলেও তিনি ভারতে বসে এই ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত নতুন সরকারকে স্বাগত জানায় এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় সায় দেয়। পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ইস্যুতে একই সুরে কথা বলতে শুরু করে, যা দেশের জনগণের মধ্যে আওয়ামী বিরোধিতার পাশাপাশি ভারত বিদ্বেষের জন্ম দিচ্ছে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেরাই বিভিন্ন সময়ে তাদের বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, ভারতের সহযোগিতায় ২০১৪ সালের পর থেকে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে ছিল। পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে থেকে প্রথম চার মাস প্রকাশ্যে না এলেও গত ৩ ডিসেম্বর একটি সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেন এবং ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একটি জনসভায় অংশ নেবেন বলে জানা যাচ্ছে। প্রকাশ্যে এসে প্রথম বক্তব্যেই তিনি আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজটি করলেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, শেখ হাসিনা সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রোপাগান্ডাকে গণহত্যা হিসাবে অভিহিত করেছেন। বোঝা যাচ্ছে, তিনি এই কাজটি চালিয়ে যাবেন।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার পর স্বাগত জানালেও ভারতের সঙ্গে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। ভারতের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানোর বিষয়টি তারা স্বাভাবিকভাবে মানতে পারছে না। ভারত এটাকে নিজেদের পরাজয় বলে মনে করছে। সম্প্রতি বহিষ্কৃত ইসকন নেতা ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আটকের পর সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা, ভাঙচুর এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে।

এর আগে কলকাতায় সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও হামলার চেষ্টা করেছিল একদল উগ্রবাদী ভারতীয়। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার আগে সেখানেও কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ চলছিল। এরপরও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করেছে, ভারত সরকার (ত্রিপুরার রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার) ন্যক্কারজনক এ হামলার ঘটনা ঘটতে দিয়েছে। যদিও আগরতলায় হামলার পর ভারত দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার বিরোধীদের তালিকা করে ধরে ধরে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কের সভায় ভার্চুয়াল ভাষণে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের পরিকল্পনাতেই গণহত্যা হয়েছে; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এখনো গণহত্যা চলছে। আশ্রয় দেওয়ার পর ভারত এখন নির্বিঘ্নে শেখ হাসিনাকে এসব কথা বলতে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আরও খেপিয়ে তুলছে।

ইতোমধ্যে ড. ইউনুসের সরকারের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এনেছে। বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় গণমাধ্যম বা বলতে গেলে ভারত সরকার এবং প্রায় সব রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনার প্রোপাগান্ডা আন্তর্জাতিক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার কি এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে? ৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনে আয়োজিত জনসভায় শেখ হাসিনার ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখার কথা শোনা যাচ্ছে। একই সময়ে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে ডেকে কথা বলেছেন। সঠিক তথ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি সত্যিকারের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। বোঝা যচ্ছে, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একদিকে বলছেন, শেখ হাসিনা কীভাবে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখার সুযোগ পাচ্ছেন, সে ব্যাপারে ভারত জানে; অন্যদিকে বলছেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এখনো আসেনি। প্রশ্ন আসে, তাহলে সরকার আসলে পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে?

পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ছাত্র প্রতিনিধি, স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে থাকা সব রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন এবং সেখান থেকে জাতীয় ঐক্যের ডাক এসেছে। বোঝা যাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য থাকলেও দেশের স্বার্থে, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে, দেশের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্র রুখে দিতে এখনো বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু সর্বাবত্মকভাবে সফল হতে হলে সরকারকেই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশে কখনো কোনো সরকার এত ব্যাপক সমর্থন পায়নি। এবারই প্রথম সরকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। সব রাজনৈতিক শক্তি (আওয়ামী লীগ এবং তার দোসররা বাদে), ছাত্রসমাজ এবং অন্যসব অংশীজন এই সরকারকে নিজেদের সরকার মনে করে। জনগণও বিশ্বাস করে, এই সরকারের কর্মকাণ্ডে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। আর এ কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হওয়া যাবে না। তাই জনগণের প্রত্যাশা, আওয়ামী লীগ, ভারতীয় গণমাধ্যম (প্রকারান্তরে ভারত) এবং সর্বশেষ স্বয়ং শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, সেই চ্যালেঞ্জ উত্তরণের জন্য সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

ভারত নিজেকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ তাকে বন্ধুহীন করেছে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকিয়ে রাখা এবং তার কর্মকাণ্ডে অন্ধ সমর্থনের পাশাপাশি পতনের পর তাকে আশ্রয় দেওয়া ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। আমরা প্রতিবেশী ভারত কিংবা অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই সমতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চাই। আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্যবাদ পরিহার করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতকে তার বিদেশনীতি, বিশেষ করে বাংলাদেশ নীতি বদলাতে হবে।

মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম