Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সর্বজনীন পেনশনকে যেভাবে আকর্ষণীয় করা যায়

Icon

চৌধুরী গোলাম সরওয়ার

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সর্বজনীন পেনশনকে যেভাবে আকর্ষণীয় করা যায়

ছবি: যুগান্তর

সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর কথা শুনে ভেবেছিলাম দারুণ একটি স্মার্ট ও সর্বজনীন প্রকল্প হতে যাচ্ছে এটি। দীর্ঘদিন থেকেই শুনে আসছিলাম, কিন্তু চালু করতে এত সময়ক্ষেপণ হলো, বয়স দোষে এর আওতা থেকে বেরিয়ে এলাম। বিলম্বিত লয়ে চলা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। যা হোক, অবশেষে শুরু তো হলো। ভাবলাম, দেশে সরকারি চাকরির বাইরে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ রয়েছেন-এটি তাদের জন্য একটি স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক ব্যাপার হবে। ভবিষ্যতের বিষয়ে কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত হওয়া যাবে। বেসরকারি খাতে অনেক ছোট-মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান আছে এবং সেখানে কর্মে নিয়োজিত আছেন অনেক মানুষ, যাদের দীর্ঘদিন চাকরি করার পর শুধু শেষ মাসের বেতন নিয়ে বিদায় নিতে হয়। তাদের কারও কারও পরবর্তী জীবন যে কত দুর্বিষহ হতে পারে, তা কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে। অনেক বড় শিল্প গ্রুপের জুট মিলে চাকরি করেও চাকরি শেষে কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি, খালি হাতে বাড়ি চলে গেছেন অনেকে। পরবর্তীকালে সামান্য কিছু টাকা কিস্তিতে পেয়েছেন, তবে কিস্তির তালিকায় নাম উঠানোর জন্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বখরাবাজির কাহিনি আরেক করুণ অধ্যায়।

সর্বজনীন জাতীয় পেনশন স্কিম ঘোষণার পর দেখা গেল, এটি মন্দের ভালো বা কিছু না থাকার চেয়ে ভালো, যদিও তা সর্বজনীন হয়নি এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করতে পারেনি। এটি একদিকে যেমন আকর্ষণীয় হয়নি, অন্যদিকে এটিকে ঘিরে এক ধরনের বিশ্বাসহীনতা কাজ করেছে। মানুষ ভেবেছে, সরকার আর্থিক সমস্যায় আছে, এ ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নেবে এবং টাকা লুটপাট করবে। এটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের একটা কৌশল। সরকারের ওপর এক ধরনের অনাস্থা তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সরকারি অনেক কাজের মতো এটিও গৎবাঁধা এবং অনেক নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে আটকে আছে। বয়স, চাঁদার হার এসব নির্ধারিত আছে। আমার মতে, এটি থাকার দরকার ছিল না। স্বকর্মে নিয়োজিত, প্রবাসী এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের মাসিক চাঁদা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিবছর বা বছরভিত্তিক একটা নির্দিষ্ট হারে তা স্বেচ্ছায় বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। একজন কর্মজীবী ২৫-৩০ বছর কেন একই হারে চাঁদা দেবেন। তিনি প্রথম বছর যা দেবেন, দ্বিতীয় বছর বা তার সুবিধাজনক সময়ে বা আয় বৃদ্ধি হলে ঘোষণা দিয়ে চাঁদার হার পরিবর্তন করার সুযোগ থাকা দরকার ছিল বলে মনে করি। ব্যাংকগুলো যেভাবে শর্টটার্ম ডিপোজিট হিসাবে বা এলআইএম ও ওডি হিসাবে দৈনিক ভিত্তিতে হিসাব করে তার ক্লায়েন্টকে লভ্যাংশ দেয় বা সুদ আদায় করে, সেভাবে কম্পিউটারাইজ্ড সিস্টেমে জমার ওপর লভ্যাংশ হিসাব করে প্রতিবছরের স্থিতি নিরূপণ করা যেতে পারে। চাঁদার হার সময় সময় পরিবর্তিত হলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে এটি বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালিত ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) ব্যবস্থা থেকে উন্নত কিছু নয়। সময় লম্বা রাখা হয়েছে, তাই ডিপিএসেরই সম্প্রসারিত রূপ বলা যায়।

মনে রাখা দরকার, এটি একটি কল্যাণমূলক ব্যবস্থা। সরকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী এখানে অনুদান বা উচ্চহারে লভ্যাংশ দিতে পারে এবং দেওয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইউনিভার্সেল বেসিক ইনকাম’ (ইউবিআই) প্রোগ্রামের কথা আলোচিত হচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন যদি কল্যাণমূলক চিন্তাধারা থেকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, তাহলে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে ভবিষ্যৎ আর্থিক ভোগান্তি থেকে রক্ষা করা যাবে এবং তুলনামূলক নিরাপদ একটি ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। এ পেনশনভোগীদের ইউবিআই সহায়তার প্রয়োজন হবে না বলে মনে করি। অবশ্য ‘সমতা’ নামক পেনশন ফান্ডে সরকার নিজ জমার সমান অংশ অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা রাখছে। এককালীন জমাও নেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে যাদের বয়স বেশি হয়ে গেছে বা চাকরির শেষপ্রান্তে এসে গেছেন। সব শেষে জমা টাকা, সরকারি অনুদান সব হিসাব করে পেনশন নির্ধারণ করা যেতে পারে।

আরও একটি বিষয় বিবেচনায় আসতে পারে। কেউ যদি এককালীন টাকা জমা রেখে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসতে চান, তাহলে তাদেরও সেই সুযোগ থাকা উচিত। কারণ, পেনশন যখন থেকে শুরু হবে, এটি সর্বশেষ জমা স্থিতির ওপর ভিত্তি করেই পরিমাণ নির্ধারিত হবে। কিছু মানুষ প্রত্যক্ষভাবে সুদে টাকা খাটাতে চান না। আবার ঝুঁকি নিয়ে কিছু করতে ভয় পান বা পারেন না। তাদের জন্য এটি নিরাপদ হতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা বেঁধে না দিয়ে আমৃত্যু এ পেনশন চালু রাখা দরকার। কারণ বৃদ্ধ বয়সেই এর সাপোর্ট বেশি প্রয়োজন। আগে থেকে কিছু নির্দিষ্ট না করে বা কিস্তি গ্যাপ হলেও বন্ধ না করে মোট জমার ভিত্তিতে পেনশন চালুর ব্যবস্থা রাখা জরুরি।

এখানে হয়তো প্রশ্ন উঠতে পারে, কত টাকা জমা দিলে কত পেনশন পাবেন, এটি না জানলে মানুষ আকৃষ্ট হবে কেন। প্রতিবছর শেষে জমার পরিমাণ, লভ্যাংশের পরিমাণ, সম্ভাব্য পেনশন প্রকাশ করা গেলে এবং মানুষ যদি এখানে আকর্ষণীয় কিছু দেখতে পায়, তাহলে আস্থাহীনতার সংকট কেটে যাবে। যদি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তথা সরকার এটি বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে, তবে এ খাতে বিপুল অর্থ সমাগম হবে এবং প্রথম এক থেকে দেড় দশক এ খাতে টাকা উত্তোলনের চাপ তুলনামূলকভাবে অনেক কম হবে। সরকার বড় অঙ্কের একটি ফান্ড এখান থেকে পেতে পারে এবং তা থেকে দেশের উন্নয়ন কাজে বিনিয়োগে সক্ষম হবে। এতে ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের ঋণ নেওয়ার চাপ কমবে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, দেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে।

সর্বজনীন পেনশন খাতে সরকারি অর্থদানে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ হবে উপকারভোগী। তাই এক্ষেত্রে শুধু যোগ-বিয়োগ আর লাভ-লোকসান হিসাবে সীমাবদ্ধ না থেকে বৃহত্তর কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ভাবতে হবে। এটি হতে পারে বয়স্ক ভাতারও বিকল্প। তাই সরকারকে এখানে জনগণের চাঁদা বা জমার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। শুধু অংশগ্রহণকারীর নিজের চাঁদা আর লভ্যাংশ হিসাব করে পেনশন প্রদান ব্যাংকের ডিপিএসের বিকল্প হতে পারে না। রাষ্ট্রকে কল্যাণমূলক হতে হলে সামাজিক সুরক্ষামূলক কাজে অধিকতর জড়িত হতে হবে। হাতেগোনা অল্প কয়েকটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেসরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির তেমন কোনো নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। সারা মাস চাকরি করে যেখানে বেতনের জন্যই আন্দোলনে নামতে হয়, সেখানে অন্য সুযোগ-সুবিধার কথা তো কল্পনাই করা যায় না।

এখানে আবার আরেকটি বিভাজন আছে, শ্রমিক ও কর্মকর্তা। শ্রমিকের ব্যাপারে আইনে উল্লেখ থাকলেও কর্মকর্তাদের ব্যাপারে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তাদের চাকরিরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর আইনে যা কিছুই থাক না কেন, আইনগত লড়াই করে তা পেতে হলে দীর্ঘ জীবন এবং ভালো আর্থিক সংগতি দরকার। কতজন অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিচ্যুত লোকের তা আছে, এটি সহজেই অনুমান করা যায়। একইসঙ্গে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীন যারা কাজ করবেন, তাদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে জনগণের এতে অংশগ্রহণের বিষয়ে আগ্রহ বাড়তে পারে। আবার তারাও এ ব্যবস্থাকে আরও কীভাবে আকর্ষণীয় ও কল্যাণদায়ক করা যায়, সে বিষয়ে বেশি চিন্তাশীল হবেন। যিনি বা যারা এর পক্ষে বলবেন, কাজ করবেন, তারা যদি এর আওতার বাইরে ভিন্ন ব্যবস্থাধীন থাকেন, তাহলে জনগণের আস্থা অর্জন যেমন দুরূহ হবে, তেমনি তারাও এর উন্নয়নে নিজেদের সবটুকু দেবেন, এটি ভাবতে মন সায় দেয় না।

চৌধুরী গোলাম সরওয়ার : বেসরকারি চাকরিজীবী ও প্রাবন্ধিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম