Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ওষুধের দামের লাগাম টানা জরুরি

Icon

এস এম নাজের হোসাইন

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ওষুধের দামের লাগাম টানা জরুরি

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজার প্রতিনিয়তই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। আর কয়েক মাস পরই শুরু হবে মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র মাহে রমজান। এ উপলক্ষ্যে রমজানে ব্যবহার্য সব নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ানো শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দামও মাসে মাসে বাড়ছে। যারা শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগী, তারা মাস পেরোলেই এটা টের পান। যেমন, আবারও বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম। ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের এক পাতার দাম ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটি হিসাবে নিলে ওষুধের দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়।

সীমিত আয়ের মানুষের এমনিতেই যেখানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা, সেখানে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বৃদ্ধি তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, গ্যাস্টিক, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি মাসের ওষুধের খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ফলে কাটছাঁট করে ওষুধ কিনে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। অতি জরুরি তথা জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম নানা অজুহাতে বাড়ানোর এ প্রবণতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

স্বাস্থ্য ও ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। এক্ষেত্রে ঘন ঘন দাম বাড়ায় বিপাকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। এর সার্বিক প্রভাব জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। বস্তুত ওষুধের দাম নিয়ে বাজারে দীর্ঘদিন ধরে নৈরাজ্য চলছে। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর অধিক মুনাফা অর্জন এবং দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা জরুরি। তা না হলে দেশের চিকিৎসা খাত নিম্নবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তদারকি ব্যবস্থা একবারেই দুর্বল। জেলা পর্যায়ে একজন ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক কোনো কোনো সময় ফার্মেসিগুলোতে লোকদেখানো পরিদর্শনে যান। এর বাইরে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও মাঝেমধ্যেই ফার্মেসিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করলেও এবং মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে ব্যবস্থা নিলেও ওষুধের দাম নিয়ে তেমন একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এর মূল কারণ হলো ওষুধের গায়ে কোম্পানিগুলোর মূল্য তালিকা লেখা থাকে। একটি কোম্পানি যখন দাম বাড়িয়ে দেন, অন্যরাও সঙ্গে সঙ্গেই দাম বাড়িয়ে দেয়।

সরকার তথা ঔষধ প্রশাসন মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে থাকে। অথচ দেশে দেড় হাজারের বেশি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ ২৭ হাজারেরও বেশি নামে (ব্র্যান্ড নামে) উৎপাদন করে থাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো। কোভিড মহামারি-পরবর্তী সময় থেকে দেশের ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি তথা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি বিশ্ববাজারে ওষুধের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য ও পরিবহণ ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাতে ঘন ঘন ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। অথচ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম কমলেও আমাদের দেশে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। এমনকি মহামান্য হাইকোর্টও বিগত ২৯ এপ্রিল দেশে ওষুধের দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব। অভিযোগ আছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার চেয়েও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত এবং এ কারণেই ওষুধ শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালেও ঔষধ প্রশাসন সে বিষয়ে অধিকাংশ সময়ই নীরব থাকে।

জনস্বাস্থ্য ও ভোক্তা অধিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ওষুধের দাম বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের ওষুধ সেবনের অধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল। বস্তুত শুধু ওষুধ নয়, সব নিত্যপণ্যের দামই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ওষুধ কোম্পানিগুলো বারবার নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে, আর সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এতে সায় দিয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। তবে এই দাম কতটা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে, সেটিই প্রশ্ন। এটি ঠিক, ওষুধও একটি বাণিজ্যিক পণ্য। বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও সংশ্লিষ্ট অন্যকিছুর দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই এর দামও বাড়বে। তবে ওষুধ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো জিনিস নয় যে বেশি দামেরটার বদলে কম দামেরটা কিনে খাওয়া যায় বা অল্প পরিমাণে খেয়ে থাকা যায়। ফলে সাধারণ মানুষ ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে আছে।

প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় দেশের মানুষকে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ নিজেদের বহন করতে হয়। অর্থাৎ ওষুধ কেনার পেছনেই সিংহভাই অর্থ ব্যয় করতে হয়। আমাদের দেশে চিকিৎসাব্যবস্থায় অনেকদিন থেকেই প্রচলিত আছে যে, চিকিৎসক যেভাবে রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেবেন, সেভাবেই সেবন করতে হবে। আর যে কোম্পানির ওষুধ/ইনজেকশন প্রেসক্রাইব করবেন, সেটাই খেতে বা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অসুখ তো সারবেই না, বরং স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়বে। আর এ কারণে ওষুধ প্রেসক্রাইবের ক্ষেত্রে একটি চক্র নানা অপকৌশলে চিকিৎসকদের মাঝে বিভিন্ন উপহার, সুবিধা প্রদান করলেও বা এ সংক্রান্ত অভিযোগ জোরালো হলেও কর্তৃপক্ষকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধি, যারা মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ নামে পরিচিত, তারা প্রতিদিন চিকিৎসকদের নানা উপঢৌকন প্রদানসহ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভিড় জমান। আর এ কারণে চিকিৎসকরা যাদের কাছ থেকে বেশি সুবিধা পান, তাদের ওষুধই ব্যবস্থাপত্রে বেশি লিখে থাকেন বলে অভিযোগ আছে।

ঘন ঘন ওষুধের দাম বাড়ার কারণে দরিদ্র ও অসচ্ছল মানুষের ওপর এর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেককে হয় ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়, নয়তো পরিবারের লোকজনের অন্যান্য প্রয়োজন বাদ দিয়ে ওষুধ কেনার পেছনে বরাদ্দ বাড়াতে হয়। আর ওষুধ কিনতে গিয়ে যদি বাড়ির অন্যদের না খেয়ে থাকতে হয়, তাহলে পুরো পরিবারের ওপরই এর প্রভাব পড়ে। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও জোরালো নজরদারি থাকা উচিত বলে মনে করি।

১৯৯৪ সালে তৎকালীন সরকার ওষুধ শিল্পের ওপর কোম্পানিগুলোর নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করে। এক আদেশে দেশে উৎপাদিত মাত্র ১১৭টি জেনেরিক ওষুধ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সব ওষুধ কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেয়। যদিও দেশে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে ১৯৪০ সালের ওষুধ আইন, ১৯৪৫ সালের ড্রাগ রুলস, ১৯৪৬ সালের দ্য বেঙ্গল ড্রাগস রুলস, ১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্স এবং ২০১৬ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তারপরও ১৯৯৪ সালের সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। ওই আদেশের বলে ওষুধ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ কার্যত কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যায়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এক সময় দুই শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু এখন ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করছে। এর বাইরের ওষুধগুলোর মূল্য নির্ধারণ অনেকটাই নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মর্জির ওপর। এতে ওষুধের মূল্য কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। মূল্য নির্ধারণ কমিটিতে ভোক্তাদের প্রতিনিধি হিসাবে ক্যাব থাকলেও ভোক্তাদের অধিকার ও যুক্তিকে বারবার উপেক্ষা করে অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রচলিত ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির যে প্রক্রিয়া চালু আছে, সেটি যৌক্তিক বা ন্যায়সংগত কিনা, সন্দেহ। জেনেরিক নামের যে দু’শতাধিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসনের ছিল, তা পুনর্বহাল করা দরকার।

স্বাধীনতার আগে দেশে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ তৈরি হতো। এখন ৯৮ শতাংশ ওষুধই দেশে উৎপাদন করা হয়। দেশে উৎপাদিত ১২৪টি ওষুধ রপ্তানিও হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে কোনোরকম জবাবদিহিতা ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির যে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। একইসঙ্গে বর্তমানে ঔষধ প্রশাসনের দক্ষতা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সেগুলোর সমাধান করতে হবে। দেশে ওষুধ শিল্প বিস্তার লাভ করলেও ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ৯৭ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এগুলোর অধিকাংশই আসে ভারত ও চীন থেকে। উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকেও কিছু কাঁচামাল আসছে। নিম্নআয়ের দেশ (এলডিসি) হিসাবে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে এ সুবিধা বহাল থাকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দেশের ওষুধ শিল্প সম্প্রসারিত হলেও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন থেমে নেই। শুরুতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এটি নিয়ন্ত্রণ করত। এখন দেশীয় বড় করপোরেট হাউজগুলো তাদের স্বার্থরক্ষার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে ওষুধ শিল্পে এ ধরনের অস্থিরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই বড় কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী তৎপরতা এবং এ ব্যবসায় অনৈতিক বিপণন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে সর্বাগ্রে।

এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

cabbd.nazer@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম