শতফুল ফুটতে দাও
ভয়াবহ এই ‘চোরতন্ত্র’!
পুঁজিবাদ দেশে দেশে বিচিত্রভাবে বিকশিত হয়। প্রাক-পুঁজিবাদী অবস্থা থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের পথ কখনোই খুব মসৃণ হয় না। সামন্তবাদের গর্ভ থেকে পুঁজিবাদী সম্পর্ক বিকশিত হওয়ার পথটি অত্যন্ত বন্ধুর এবং মানুষের জন্য কষ্টকর। ইংল্যান্ড পুঁজিবাদের অন্যতম জন্মভূমি হিসাবে পরিচিত। ইউরোপের বাজারে ফ্লেমিশ উলের দাম পঞ্চদশ শতকের দিকে হু হু করে বেড়ে যায়। ইংল্যান্ডের ভূ-স্বামীরা দেখলেন, মেটিয়ার প্রথায় (ইংল্যান্ডের ভাগ চাষ পদ্ধতি) ফসল উৎপাদনের চেয়ে ভেড়ার চাষ করা অনেক বেশি লাভজনক হবে। যেসব প্রজা মেটিয়ার হিসাবে ভূ-স্বামীর জমিতে ফসলের চাষ করত; তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। হঠাৎ করে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া প্রজা কৃষকরা গ্রাম ছেড়ে কাজের সন্ধানে শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়। ভূ-স্বামীরা তাদের জমির চারদিকে বেড়া দিয়ে ভেড়ার চাষ শুরু করল এবং ভেড়ার পশম বিক্রি করে তারা প্রচুর লাভবান হলো।
ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট তাদের এ কাজকে বৈধতা দেয়। ইংল্যান্ডের শহরগুলোতে গ্রাম ছেড়ে চলে আসা মানুষগুলো বস্তিতে আশ্রয় পেল। এসব বস্তির জীবন ছিল খুবই কষ্টকর। আমাকে একজন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী বলেছিলেন, তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না, সেসময় ইংল্যান্ডের এবং ইউরোপের অন্য দেশের বস্তির জীবন ঢাকার বস্তির জীবনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি দুঃসহ ছিল। এসব বস্তিবাসীর জন্য বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ছিল খুবই কম মজুরিতে সবেমাত্র গড়ে ওঠা কলকারখানায় মজুরের কাজ করা। এদের দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। শিশুরাও এসব কঠোর পরিশ্রমের কাজে নিয়োজিত হতো। খুবই সস্তায় মজুর পাওয়ার ফলে কলকারখানার মালিক পুঁজিপতিরা বিশালভাবে মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হলো। ক্রমপুঞ্জীভূত মুনাফা নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ব্যবহৃত হলো। ইংল্যান্ডের জাতীয় উৎপাদন এতটাই বৃদ্ধি পেল যে, উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সে দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত হলো। ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে দেখার প্রয়োজন হলো। ইংল্যান্ডের কলোনিগুলো, বিশেষ করে ভারতবর্ষ পরিণত হলো ইংল্যান্ডের Captive Market-এ।
পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় আদিম পুঁজির। এ আদিম পুঁজি সমাজের অধঃস্তন শ্রেণির রক্ত-মাংস শোষণ করেই তৈরি হয়। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে আদিম পুঁজি সঞ্চয় সম্ভব হয়েছিল মেটিয়ারদের বলপ্রয়োগ করে জমি থেকে উচ্ছেদ করে এবং পরবর্তীকালে শহরগুলোতে এদের শ্রম অনেক কম মূল্যে ক্রয় করে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। এ আনুকূল্য বাস্তবায়ন করা হয় নানা রকমের পলিসি সাপোর্ট দিয়ে। পাকিস্তানের ২২ পরিবার সৃষ্টি হয়েছিল রাষ্ট্রের পলিসিকে পুঁজি বিকাশের সহায়ক করে তোলার মাধ্যমে। এ জন্যই আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তানি পুঁজিবাদকে বলা হয় State Fostered Capitalism. ফিলিপাইনে ফার্ডিন্যান্ড মার্কোসের স্বৈরশাসনামলে তৈরি হয়েছিল ক্রনি ক্যাপিটালিজম। এ ক্রনি ক্যাপিটালিজম গড়ে উঠেছিল ফার্ডিন্যান্ড মার্কোসের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে। ফিলিপাইনের ক্রনি ক্যাপিটালিজমের মডেলটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছিল স্বৈরশাসক মার্কোসকে দীর্ঘ ২০ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকার সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালনের জন্য। মার্কোসের শাসনামলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার উৎসাহব্যঞ্জক হলেও, তার শাসনের সমাপ্তিকালে ফিলিপাইনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করছিল এবং দেশটি ঋণের ফাঁদে আটকে পড়ে।
গত ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রকাশের পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দিপরা বা উর্দিছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ী, এই ৩ গোষ্ঠীর সমন্বয়ে চোরতন্ত্র সৃষ্টি হয়। চোরতন্ত্রের বিষবৃক্ষ সৃষ্টির উৎস ছিল ২০১৪ সাল থেকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ড. দেবপ্রিয় ক্রনি ক্যাপিটালিজমের বাংলা করেছেন চামচা পুঁজিবাদ এবং ক্লেপ্টোক্রেসির বাংলা করেছেন চোরতন্ত্র। এই অনুবাদ সার্থক হলেও কথাগুলো ইংরেজিতে শুনলে স্পষ্ট মনে হয়। শেখ হাসিনা একবার খুব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেছিলেন, আমার ক্ষমতা চাই। এ ক্ষমতা যেভাবেই অর্জিত হোক না কেন, তা পেতে হবে।
তিনি যখন বুঝলেন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না, তখন তিনি সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিলেন এবং এমন সব নির্বাচন আয়োজন করলেন, যেসব নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। কিন্তু কেউ চাইলেই ১৮ কোটি মানুষের দেশে যেনতেন করে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে কার্যত ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এটি একমাত্র সম্ভব হতে পারে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে অন্যায্য ও অন্যায় সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে। দেশে একটি ক্ষমতায় Nexus গড়ে উঠল, যেখানে চিহ্নিত সামরিক-বেসামরিক আমলা, মুখচেনা কিছু ব্যবসায়ী ও শাসক নেত্রীর পরিবারের সদস্যরা ঘনিষ্ঠ স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কোনো কোনো ব্যবসায়িক গোষ্ঠী অকল্পনীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, তাদের আমরা জানি। আমরা আরও জানি কোনো কোনো আমলা এই Nexus-এর বড় বড় খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আলোচনায় আছে রক্ত সম্পর্কের হাসিনার ঘনিষ্ঠজন।
রাজধানীর আগারগাঁও এনইসি ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. দেবপ্রিয়সহ শ্বেতপত্র কমিটির বাকি ১১ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। গত রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে রিপোর্ট জমা দেয় কমিটি। কমিটি বর্তমান সরকারের ন্যূনতম ২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন, সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ধারণ, উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সংলাপসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।
শুরুতে শ্বেতপত্র প্রণয়নের পদ্ধতি বর্ণনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল চুরির বর্ণনা দেওয়া। চোর ধরা কমিটির উদ্দেশ্য নয়। এটি দুদক, বিএফআইইউ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা দেখবে। রিপোর্টটি প্রথাগত জ্ঞান, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক এবং জনশুনানির ভিত্তিতে করা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৬০টি সভা করা হয়েছে। ১৮ বার এ কমিটি মিলিত হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
সুপারিশ বাস্তবায়নের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মনে রাখতে হবে, অর্থনীতিতে মনোযোগের অভাবে রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। এরপর অবকাঠামো, তৃতীয় জ্বালানি এবং চতুর্থ তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১০০ টাকার পণ্য ১ লাখ টাকা দেখিয়ে কেনা হয়েছে। আমরা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশকাণ্ডের ঘটনাও জানি। আমরা আরও জানি অবকাঠামো খাতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি খরচ দেখানো হয়েছে। অবকাঠামো খাতের দুর্নীতির একটি বড় দিক হলো ভূমি অধিগ্রহণ। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের নামে লক্ষ কোটি টাকার খেলা হয়েছে।
এক সময় পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ মনে করতেন, দুর্নীতি সবসময় খারাপ ফল দেয় না। দুর্নীতি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনে এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে গতিবেগ সঞ্চার করে। এছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থসম্পদ দেশের মধ্যে বিনিয়োগ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়। ড. দেবপ্রিয় জানিয়েছেন, বিগত সরকারের সময়ে বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ফলে অর্থনীতি রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। যারা অর্থ পাচার করেছে, তারা এদেশে জন্মগ্রহণকারী পুঁজিপতি হলেও এদেশের কোনো সম্ভাবনা দেখেন না বলে বিদেশে টাকা পাচার করেন। হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ভয়ানক ঘটনাগুলো বলে দেয়, এদেশে দেশীয় পুঁজি অদূর ভবিষ্যতে গঠিত হওয়ার নয়। ড. দেবপ্রিয় বলেছেন, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ বা বিচার বিভাগ যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একটি চুরির অংশ হয়ে যায়, সেটাই চোরতন্ত্র। চোরতন্ত্রের ভেতরে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী, উর্দিপরা বা উর্দিছাড়া আমলা এবং ব্যবসায়ীদের সহযোগ সৃষ্টি করা হয়। তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার এবং সামাজিক শক্তিকে দুর্বল করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তি অবশ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছিল নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম কর্মী এবং বেসরকারি খাতের লোকজন। অনেক সময় বিদেশিরা অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রশংসা করেছে। যেসব বিষয় নিয়ে প্রশংসা করেছে, তার ভিত্তি এখন সন্দেহের ভেতর রয়েছে। এ জায়গা থেকে বের হওয়ার জন্য জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংস্কারে যেতে হলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা থাকা জরুরি। অন্যদিকে যদি বাজারে পণ্যের দর নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বিপদসংকুল হবে। এর জন্য মানুষের যে ধৈর্য দরকার, তা থাকবে না। শ্বেতপত্রের হিসাব থেকে জানা যায়, বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে অবৈধ লেনদেন হয়েছে ৩ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় সরকারের সঙ্গে করা প্রকল্প জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি বলে চিহ্নিত হয়েছে।
আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম পুঁজিবাদের উত্থান প্রক্রিয়া নিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা, এখানে একটি সুস্থ পুঁজিবাদের সম্ভাবনা দীর্ঘকালের জন্য নস্যাৎ করে দিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকার। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হলে দেশটির আর কী থাকে! তবুও এদের কোনো অনুশোচনা নেই। হারানো চোরতন্ত্র উদ্ধারে এরা ভয়াবহ সব ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে যে ন্যক্কারজনক ঘটনার সূত্রপাত করা হয়েছে, তার আশু লক্ষ্য চোরতন্ত্রীদের বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ