Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ঋণ মান নির্ধারণে নতুন নিয়মে যে সুফল মিলতে পারে

Icon

এমএ খালেক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঋণ মান নির্ধারণে নতুন নিয়মে যে সুফল মিলতে পারে

বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২৭ নভেম্বর জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা অনুসরণের জন্য শিডিউল ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। আগামী বছর এপ্রিল মাস থেকে এ নতুন নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতিমালার ফলে এখন থেকে কোনো ঋণ হিসাবের কাছে ব্যাংকের পাওনা কিস্তি তিন মাস অর্থাৎ ৯০ দিন অপরিশোধিত থাকলে তার পরদিন থেকেই তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবে।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে একশ্রেণির প্রভাবশালী উদ্যোক্তাগোষ্ঠীর চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ সংজ্ঞায়ন করার ক্ষেত্রে শিথিলতা অবলম্বন করেছিল। বর্তমানে কোনো ঋণ হিসাবের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে না পারলেও ঋণগ্রহীতা আরও এক বছর পর্যন্ত নিজেদের খেলাপি ঋণমুক্ত দেখানোর সুযোগ পেতেন। এ সময়ের মধ্যে তারা নতুন করে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পেতেন। নতুন নীতিমালা জারি করার কারণে এখন থেকে কোনো ঋণ হিসাবে পাওনা ঋণের কিস্তি নির্ধারিত দিনে পরিশোধ না করা হলে পরদিন থেকেই তা খেলাপি ঋণে পরিণত হবে।

নতুন এ সার্কুলার বাস্তবায়ন শুরু হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। একইসঙ্গে বর্ধিত খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তবে এ ব্যবস্থায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃৃত অবস্থা জানা যাবে। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ আর থাকবে না।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, কোনো ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা কিস্তি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরদিন থেকেই সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাবটি খেলাপি মানে চিহ্নিত হয়। আর খেলাপি মানে চিহ্নিত হওয়ার পর সেই ঋণ হিসাবধারী কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এ ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে অন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে, তা-ও প্রযোজ্য হয়। বিগত সরকার আমলে দেশের একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাগোষ্ঠী নানাভাবে আর্থিক খাতে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে সুবিধা লুটে নিয়েছিল, সেই মহলটিই ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের পরও এক বছর পর্যন্ত অবকাশ সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল। এতে ব্যাংক খাতের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঋণখেলাপি হয়েও এক বছর পর্যন্ত তারা অন্য কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছিলেন। নতুন প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে সেই সুযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে।

নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ মান নির্ধারণের যে নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, তার মাধ্যমে ঋণ হিসাবগুলোকে সাতটি বিশেষ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হবে। এর মধ্যে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয় এমন ঋণ হিসাবকে স্ট্যান্ডার্ড লোন হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এই শ্রেণির ঋণের জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর একদিন থেকে এক মাস পর্যন্ত কোনো ঋণ হিসাবের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে স্ট্যান্ডার্ড-১ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এই শ্রেণির ঋণের জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত শিডিউল থেকে এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত কোনো ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তার জন্য ১ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। কোনো ঋণ হিসাব থেকে নির্ধারিত সময়ের পর দুই থেকে তিন মাস কিস্তি আদায় না হলে তাকে ‘স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট’ (এসএমএ) হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে। এ ধরনের ঋণ হিসাবের জন্য ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নিম্নমানের ঋণ হিসাব হচ্ছে সেই ঋণ হিসাব নির্ধারিত সময়ের পর দুই থেকে তিন মাস, যার কিস্তি অপরিশোধিত থাকবে। এই শ্রেণির ঋণ হিসাবের বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত শিডিউলের পর ছয় থেকে ১২ মাস পর্যন্ত কোনো ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে সন্দেহজনক বা ডাউটফুল লোন হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে। এই শ্রেণির ঋণ হিসাবের জন্য ৫০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের পর ১২ মাস বা এরও বেশি সময় কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে তাকে মন্দ ঋণ বা ব্যাড লোন হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে। এই শ্রেণির ঋণ হিসাবের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন উদ্যোগের ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ চিহ্নিত করার পথ অনেকটাই উন্মুক্ত হবে। কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। আমাদের আরও কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। বিগত সরকারের আমলে নানাভাবে ব্যাংক খাতকে অবৈধ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছিল। ব্যক্তিমালিকানায় একান্ত রাজনৈতিক বিবেচনায় সর্বশেষ যে নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যেগুলো মোটেও ভালোভাবে চলছে না। প্রচলিত আইনের পরিবর্তন করে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে আইএমএফের শর্তের কারণে এ আইন কিছুটা সংশোধন করে একই পরিবার থেকে একযোগে তিনজন পরিচালক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। আগে কোনো একক পরিবার থেকে একযোগে দুজন পরিচালক নিযুক্ত হতে পারতেন। তারা ধারাবাহিকভাবে দুই টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারতেন।

সর্বশেষ পরিসংখ্যান মোতাবেক দেশের ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা অর্থ, পুনঃতফসিলিকৃত ঋণ হিসাবের কাছে পাওনা অর্থ এবং মামলাধীন প্রকল্পের কাছে দাবিকৃত অর্থ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং ব্যাংক খাতকে সুশৃঙ্খল ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য আরও কিছু ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস দেশে রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে আন্দোলনে নিয়োজিত হয়। সেই সময় বেশকিছু বাসে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব আন্দোলনে দেশের শিল্প-কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই অজুহাতে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণখেলাপিদের ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করা হয়। মোট ১১টি শিল্পগোষ্ঠীর কাছে পাওনা ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দীর্ঘমেয়াদের জন্য পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু সেসব ঋণের বেশিরভাগই পরবর্তীকালে আবারও খেলাপি হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে শুধু কি ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণখেলাপিরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হলে তা সবার জন্যই অবারিত করা উচিত ছিল। ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের যে আইন করা হয়েছিল, তা বাতিল করে নতুন নিয়ম মোতাবেক খেলাপি ঋণ চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

আগে কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরপূর্বক শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাব অবলোপন করা যেত। এ আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর ২ বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাচ্ছে। এজন্য ৫ লাখ টাকার কম খেলাপি ঋণযুক্ত প্রকল্পের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়েরের শর্ত বাতিল করা হয়েছে। শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধানও প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ঋণ হিসাব অবলোপনের মাত্রা বেড়ে গেছে। আগে কোনো ঋণ হিসাব সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিলিকরণ করা যেত এবং প্রতিবার পুনঃতফসিলিকরণের মেয়াদ ছিল তিন বছর। এজন্য প্রথমবার ১০ শতাংশ, দ্বিতীয়বার ২০ শতাংশ এবং তৃতীয়বার ৩০ শতাংশ নগদ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। সর্বশেষ এ আইন পরিবর্তন করে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট প্রদানসাপেক্ষে একটি ঋণ হিসাব এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্তত ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করেছেন। উল্লেখ্য, দেশে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ শুরু হয় ১৯৯১ সালে। কিন্তু অতীতে আর কখনোই এত সহজ শর্তে ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ করতে দেওয়া হয়নি।

বিগত সরকার দায়িত্বচ্যুত হওয়ার কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা জারি করে, কোনো শিল্পগোষ্ঠীর এক বা একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হলেও অন্য শিল্পগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে। আগে নিয়ম ছিল কোনো শিল্পগোষ্ঠীর একটি প্রতিষ্ঠানও যদি ঋণখেলাপি হয়, তাহলে অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক ঋণ পাবে না।

একটি দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক খাত হচ্ছে ধমনিতে রক্ত প্রবাহের মতো। কোনো কারণে ধমনিতে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি কোনো দেশের ব্যাংক খাত যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, সেই দেশ কখনোই দ্রুত ও টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে চলতে দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। রাজনৈতিক সরকার তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যাংক খাতকে সঠিকভাবে চলতে দেবে না। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। তাদের দৃশত কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। তাই এখনই সময় ব্যাংক খাতের জন্য এমন কিছু আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর এ খাতকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে অপব্যবহার করতে না পারে।

এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি ও অর্থনীতি বিষয়ক লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম