বৈশ্বিক রূপান্তরে তিন শূন্যের নীতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বব্যাপী তরুণ-যুবকদের হৃদয়ে আদর্শিক চেতনা প্রতিষ্ঠার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যতিক্রম। তিনি যুবসমাজকে সামাজিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়ে নতুন ধারণার বশবর্তী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। হন্যে হয়ে চাকরি অনুসন্ধানে মেধাসম্পদ, শ্রম ও সময়ক্ষেপণ না করে নিজে কর্মসংস্থানের উদ্যোক্তা হওয়ার অভিনব পন্থার উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। তিনি বিশ্বপরিমণ্ডলে বিরাজমান তিনটি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে (সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ) শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আমরা জানি, দারিদ্র্য বর্তমান বিশ্বের প্রধান সমস্যা। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকেন্দ্র অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে ‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ : সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ শিরোনামে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১১২টি দেশের ৬৩০ কোটি মানুষের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের প্রায় অর্ধেকই সংঘাতকবলিত দেশের বাসিন্দা। চরম দারিদ্র্যে থাকা জনগোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশের বেশি বসবাস করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। দক্ষিণ এশিয়ায় ২৭ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র মানুষের মধ্যে এমন পরিবারও আছে, যে পরিবারে অন্তত একজন অপুষ্টিতে ভুগছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা ৪৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে বসবাস করছে। সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোয় শিশুমৃত্যুর হার ৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে শান্তিপূর্ণ দেশগুলোয় এ হার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। যুদ্ধরত দেশগুলোর মানুষ পুষ্টি, বিদ্যুৎ, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার উদাহরণ বর্তমান গাজা উপত্যকা। ‘ফেমিন রিভিউ কমিটি’ নামক সংস্থার মূল্যায়নে জানা যায়, দখলদার ইসরাইলের অবরোধ, খাবার পৌঁছাতে না দেওয়া এবং বর্বর হামলার কারণে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার ধাপ হয়তো ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে বা খুবই দ্রুত পার হবে। সংস্থাটির মতে, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গাজায় খাদ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা হতে পারে ৩ লাখ ৪৫ হাজার, যা উপত্যকাটির মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ।
উন্নত দেশগুলোয়ও দারিদ্র্যের একই দৃশ্যপট অবলোকন করা যাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর প্রকাশিত বেসরকারি সংস্থা ট্রাসেল ট্রাস্ট পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম সারির উন্নত দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাজ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে, অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে দেশটিতে বেড়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য। বর্তমানে ৯৩ লাখ মানুষ ক্ষুধা ও দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইতঃপূর্বে দেশটিতে একসঙ্গে এতসংখ্যক মানুষ কখনো এ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়নি। বিস্ময়করভাবে দুই দশক আগের তুলনায় বর্তমানে ৪৬ শতাংশ বেশি শিশু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মুখোমুখি। চার বছরের কম বয়সি প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করছে। ইউনিসেফের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধনী দেশগুলোর মধ্যে শিশু দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি যুক্তরাজ্যে। বর্তমানে ৬ কোটি ৯২ লাখ ৫১ হাজার জনসংখ্যার দেশটির ২৫ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। দাতব্য সংস্থা বাট্ল ইউকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে অনেক দরিদ্র পরিবারকে ভীষণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন পার করতে হচ্ছে। খাবার, পোশাক থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের সংকটে ভুগছে বহু পরিবার।
বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈষম্য বৃদ্ধি ও স্থবির উৎপাদনশীলতার নেতিবাচক প্রভাবে বেকারত্বের হার হ্রাসের চিত্র সুস্পষ্ট। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাব অনুসারে বিশ্বে এখন বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ, যা বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন-যদিও করোনা অতিমারির পর বিশ্বের সব অঞ্চলে বেকারত্বের হার সমানভাবে কমেনি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবিধা না পাওয়ায় কিছু অঞ্চলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত আইএলওর প্রতিবেদন ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ ২০২৪’-এ জানানো হয়েছে, গত চার বছরে শ্রমবাজারের উন্নতি ঘটেছে। এ ধারাবাহিকতা আগামী দুই বছর বজায় থাকতে পারে। চলতি বছর ও আগামী বছর বেকারত্বের হার আরও কমে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের হিসাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বেকারত্বের হার ছিল ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশে কর্মহীন মানুষ ছিল ২৫ লাখ। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশে। আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, এই সুন্দর ধরিত্রী মানবগোষ্ঠীর জন্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসাবে পরিবেশ দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরিমেয় কার্বন উৎপাদনের কারণে পৃথিবীর বায়ু প্রচণ্ডরকম দূষিত। অতিসম্প্রতি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, সব প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। নাগরিকজীবন প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। কার্যত সব কার্যক্রম প্রায় স্থবির। এছাড়া পরিমিত অক্সিজেনের অভাবে নানা রোগ-ব্যাধিতে জনজীবন পর্যুদস্ত। একই চিত্র পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের। বিগত কয়েক সপ্তাহে ঘন ধোঁয়াশায় ঢেকে যাওয়ায় ‘স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে প্রাদেশিক সরকার। অসুস্থ হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। পাঞ্জাবে বায়ুদূষণের কারণে ৫ বছরের কম বয়সি ১ কোটি ১০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেছে ইউনিসেফ পাকিস্তান। অন্যান্য দেশের মতো সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের প্রায় প্রতিটি নগর-শহর-জনপদে মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ চরম উদ্বেগ তৈরি করছে। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর অন্যতম এবং প্রায়ই তালিকার শীর্ষ অবস্থানে স্থান পাচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের আরেকটি বড় অনুষঙ্গ হলো শব্দদূষণ। বাংলাদেশে শব্দদূষণ একটি ক্রমবর্ধমান ভয়ানক সমস্যার রূপ পরিগ্রহ করছে। নানা কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে যানবাহনে হর্নের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শব্দদূষণের অন্যতম কারণ হিসাবে বিবেচিত। তাছাড়া অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অট্টালিকা নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মারাত্মক শব্দদূষণ সৃষ্টি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এসব ভবন নির্মাণ করছে। একই এলাকায় একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশাল মাপের বহুতল ভবন নির্মাণে পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের প্রতি অবজ্ঞা অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ও অসুস্থ নাগরিকরা শব্দদূষণে নানা নিউরো ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব সমস্যা মুনাফালোভী বিনিয়োগকারীদের বিচলিত করছে না। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে এ সম্পর্কে সচেতন করা হলেও শব্দদূষণ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। এদেশের পরিবেশ এতটা দূষিত যে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকে। এটি অনস্বীকার্য, শূন্য কার্বন নিঃসরণই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। প্যারিস জলবায়ুচুক্তি অনুযায়ী, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়ানো যাবে না। সেজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ কমানো হবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অভিযোজনের সুযোগ পেতে উন্নত দেশগুলো বছরে ১০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিশ্রুতির দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এর বাস্তবায়নের অগ্রগতি অতি নগণ্য।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠানরত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৯) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জলবায়ু সংকটকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘মানবসভ্যতা টেকাতে হলে গ্রহণ করতে হবে ভিন্ন জীবনধারা, গড়ে তুলতে হবে ভিন্ন এক সংস্কৃতি। আর সেটি হতে পারে আমার দীর্ঘদিনের লালিত ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ ধারণা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে।’’ তরুণদের প্রতি তিন শূন্যের আদর্শ নিয়ে গড়ে ওঠার এবং পুরো জীবন সেই আদর্শে অটল থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পরিবেশের নিরাপত্তার জন্য দরকার নতুন একটি জীবনধারা, যে জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া নয়, যা মানুষকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে। বেছে নেওয়ার সুযোগের কারণেই তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ করবে। প্রতিটি তরুণ এই তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে : শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, সম্পদের শূন্য পুঞ্জীভূতকরণ ও শূন্য বেকারত্ব। সেটা সম্ভব হবে কেবল সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার এবং নিজেদের উদ্যোক্তায় পরিণত করার মাধ্যমে। প্রতিটি মানুষ তিন শূন্যের নীতি নিয়ে বেড়ে উঠবে ও আজীবন তিন শূন্যের নীতি ধারণ করবে। আর সেই পথ ধরেই একটি নতুন সভ্যতা গড়ে উঠবে।’
বিশ্বনেতারা এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের তরুণ সমাজের জন্য নানামুখী সামাজিক ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবেন-এটিই প্রত্যাশা।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী