জনপ্রশাসন সংস্কার : আমাদের প্রত্যাশা
মোহাম্মদ আবদুল মাননান
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সংগৃহীত
একটি প্রতিষ্ঠান বা পদ্ধতির মধ্যে সমস্যা থাকলেই তো সংশোধনের প্রশ্ন আসে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্যেই নিহিত আছে এ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করার গুরুত্ব। এখন বোঝার বিষয়, কী কী সমস্যা আছে এবং কোথায় ও কী ধরনের সংস্কার বা মেরামতের দরকার। কাজেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে সমস্যাগুলোর পাঠ বা অনুশীলনটি আগে করতে হবে; অন্যথায় জুতসই-কাঙ্ক্ষিত-টেকসই এবং গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রণয়ন করা যাবে না।
আমাদের সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ সুস্পষ্ট। কিন্তু নানা সময়ে তিন বিভাগের এখতিয়ার ও ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। আমেরিকায় নির্বাহী বিভাগ, লেজিসলেটিভ ও জুডিশিয়ারির কার্যক্রমের সীমানা টানা আছে। ওখানে একটি বিভাগ অন্য বিভাগের ক্ষমতাকে সমীহ করে তথা স্পেস দেয়। এখানে সেটি হয় না। একটি উদাহরণ হলো, সরকারপ্রধানকে এমন এখতিয়ার দেওয়া আছে যে, অনেক কিছুর জন্য তাকে সংসদে যেতেই হয় না; অথচ এটি ভালো গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে কেবল সরকারই নয়, নির্বাহী বিভাগের প্রতিটি দপ্তর-সংস্থাও গণতান্ত্রিক হবে। প্রতিটি সংস্থা গণতান্ত্রিক হলে সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না। দুর্ভাগ্য, এই প্র্যাকটিস আমরা দেখতেই পাইনি। এদেশের কোনো ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশন, দুদককে শক্তিশালী করতে চায়নি। মানবাধিকার কমিশন আছে, কিন্তু এমনভাবে আছে যাতে কোনো কাজ করতে না পারে; কারণ সরকার জানে, এই কমিশন প্রথমেই সরকারের ওপর চড়াও হবে। একই কথা দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিয়েও। অনুরূপভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক সরকার গণতান্ত্রিক হতে দেয়নি। সরকার জনস্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করলে বা জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজে গাফিলতি দেখালে উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারেন। উচ্চ আদালত সচরাচর সেটা করেন না এজন্য যে, দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে। কেউ রিট করলেই আদালত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আদেশ প্রদান করেন।
কিন্তু জনপ্রশাসন এখানে সম্পূর্ণ আলাদা। সরকার রাইট ট্র্যাকে না থাকলে জনপ্রশাসনের কর্মীদের থেকে কেবল বার্তাই আসবে না, তারা সেই কাজ বা কর্মসূচি বন্ধ করে দেবে। আর জনপ্রশাসনের মাথার উপর থাকবে জনপ্রশাসন কমিশন; সব কমিশনই হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। জনপ্রশাসন স্থায়ী ও দলনিরপেক্ষ চরিত্রের হতেই হবে। জনপ্রশাসন স্থায়ী প্রতিষ্ঠান। জনপ্রশাসনের একজন কর্মী চাকরি শেষ করে বাড়ি ফিরবেন কিন্তু প্রতিষ্ঠান শাশ্বত। এ প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা দলনিরপেক্ষ থেকেই যে কোনো সরকারের সঙ্গে কাজ করতে কেবল অভ্যস্তই হবে না, এটিই হবে তাদের ব্রত বা কর্মধর্ম। ওসিকে বলা হলো, অমুককে ধরে আনো। ওসি বলতে পারবে, তার কোনো অপরাধ দেখছি না, নেই মামলা দেওয়ার মতো কোনো কারণ। ফলে তাকে ধরা যাবে না, দেওয়া যাবে না মিথ্যা মামলা। ডিএম বলতে পারবে, ব্যালটে সিল দিয়ে একজনকে নির্বাচিত করা যাবে না। হ্যাঁ, ওই ডিএম বা ওসি বদলি হবে, ভালো পদে থাকবে না আর এসব সরকারের ক্ষমতার মধ্যেই পড়ে-কিন্তু এই বেআইনি আদেশ লঙ্ঘনের জন্য তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা চাকরিচ্যুতি ঘটবে না; ঘটবে না ক্যারিয়ারে কোনো বিঘ্নতা। সরকার স্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাছে বিষয়টি রেফার করতে পারবে মাত্র। এই নিশ্চয়তা একজন পাবলিক সার্ভেন্টকে দেওয়া গেলেই সরকারের অন্যায় আবদার বা দাবি থেকে দেশ রক্ষা পাবে; বিকশিত হবে প্রত্যাশিত জনসেবা। এদেশে সেই সিস্টেম কি আছে? নেই। দেশের সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা নির্বাহী বিভাগের উপরের স্তরে অবস্থান করেন, ফলে সুরক্ষা না থাকায় সরকারি আধিকারিকরা সরকারের অন্যায় আদেশ-আবদার মানতে বাধ্য; সেই সঙ্গে যুক্ত হয় দলীয়করণের প্রবণতা এবং দলীয় হওয়ারও প্রবণতা। এটি আদর্শিক প্রশাসন ব্যবস্থা নয়। এ অবস্থা-ব্যবস্থার সংস্কার লাগবেই। এখানে মনে রাখা দরকার, সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদ মতে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য হবে জনগণের সেবা। বস্তুত, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কর্মবিভাগ হবে রাজনীতিমুক্ত, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ও চিরন্তন প্রতিষ্ঠান। এই নিরপেক্ষতা থেকেই সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে দায়িত্ব পালন করবে। দুর্ভাগ্য, এদেশের জনপ্রশাসনে এই প্রক্রিয়া অনুপস্থিত এবং এ কারণেই জনপ্রশাসন জনসেবার বদলে সরকারের তল্পিবাহক কিংবা লাঠিয়ালে পরিণত হয়ে আসছে; পালিত হচ্ছে বেআইনি আদেশ।
উপরের কথাগুলোই জনপ্রশাসনের দর্শন হবে। এরপর প্রতিনিয়ত আমরা কী দেখছি, সে প্রসঙ্গ। এ নিবন্ধ লেখার আগে জনাদশেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সবাই সেবাপ্রার্থী। তাদের মধ্যে কজন আবার টেবিলের দুদিকেরই-অর্থাৎ টেবিলের ওপাশে বসে সেবা দিতেন, কিন্তু এখন টেবিলের এ পাশে বসে সেবা নিচ্ছেন। পাবলিক সার্ভেন্টদের আচরণ ও সেবার মান এবং সেবা প্রদানের ধরনে তারা বেশ ক্ষুব্ধ-অথচ তারা কদিন আগেও টেবিলের ওপাশটায় ছিলেন। তাদের কথা, দিনে দিনে অবস্থা খারাপ হচ্ছে। যারা কখনোই টেবিলের ওপাশে ছিলেন না, তারাও অসন্তুষ্ট। তাহলে? আবার সরকারি টেবিলের ওপাশে যারা বর্তমান, তাদের কথা-সরকারি নিয়ম-নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বাড়াবাড়ি গুণগত ও নিরপেক্ষ সেবা প্রদানের অন্তরায়। কমিশনকে এসব বিষয় অ্যাড্রেস করতেই হবে। এখানে স্মতর্ব্য, সংবিধানমতে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মবিভাগই নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, সংসদসহ বিভিন্ন কমিশন সচিবালয় এবং প্রতিরক্ষা বিভাগও জনপ্রশাসন। কিন্তু গঠিত কমিশন হয়তো প্রতিরক্ষা, পুলিশ, বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয় বাদ রেখেই সুপারিশ করবে। পুলিশ সংস্কারের জন্য আলাদা কমিশন এই কারণে যে, পুলিশের উপরের দিকে সবাই জনপ্রশাসনের কর্মী হলেও নিচের দিকের সবাই পুলিশ সার্ভিসের এবং কাজের ধরনও ভিন্ন। উপরের একজন ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘আদতে আমরা চরিত্রহীন আর ইবলিশদেরই প্রশাসন পদে পদে দেখতে চায়।’ এই ভদ্রলোক প্রভুতোষণ থেকে জনপ্রশাসনের মুক্তি চাচ্ছেন। একজন বলেছেন, সরকারি অধিকর্তাগণ নৈশ কিংবা ডামি নির্বাচন উপহার দিয়ে নিজেরা নির্দ্বিধায় কোটি টাকার নিরাপদ পাহাড় রচনা করেই যাবে-এই ব্যাকরণ থেকে বেরুতে হবে। একজন বলেছেন, রাজনীতিক আর আমলাকূল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মাত্র। একজন বলেছেন, গিভ অ্যান্ড টেকের আমলাতন্ত্রের রদ চাই। আবার এক-দুজন বর্তমান আমলা বলেছেন, সুযোগ-সুবিধা পরের কথা, চাই চাকরির নিরাপত্তা। এদের মধ্যে একজন নৈশ নির্বাচনের সময়ে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন; বললেন, করাত ঘুমাতে পারিনি। মনে করার কারণ আছে, এই ক’জনের কথার মধ্যেই বহুজনের কথার বা চাওয়ার সারমর্ম আছে। কাজেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এই পাঠের মর্ম উদ্ধার করতে পারলেই সুপারিশ দেওয়া সহজতর হবে।
আছে আন্তঃক্যাডার এবং এক সার্ভিসের সঙ্গে অন্য সার্ভিসের নানা সমস্যা, সুযোগ-সুবিধা এবং পদোন্নতিসহ নানা ব্যাপার। বিপুল বহরের ক্যাডার সার্ভিস রেখে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একটি ক্যাডার বা সার্ভিসের সঙ্গে অন্য একটি ক্যাডারের কাঠামো এক নয়। ফলে অভিন্ন সুবিধা-পদোন্নতি নিশ্চিত করা কঠিন। একই দিনে চাকরিতে এসে বাংলার শিক্ষক অধ্যাপক হয়ে এখন অধ্যক্ষ, অথচ একই দিনে যোগদান করে পদার্থবিদ্যার শিক্ষক আজও সহকারী অধ্যাপক। একটি ছাতার নিচে রেখে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কর ক্যাডার আর শুল্ক ক্যাডারের পদোন্নতি সমান তালেই হবে, তার কোনো মানে নেই। ফলে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ হবে; একটি পরীক্ষায় নয়। পুলিশ সার্ভিসের নিয়োগের সঙ্গে স্বাস্থ্যের ডাক্তার-একটি পরীক্ষা দিয়ে নয়। এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশলী বা স্বাস্থ্য প্রকৌশলীর নিয়োগ তো আলাদা পরীক্ষাতেই হচ্ছে-এতে একটি বিভাগের সঙ্গে আরেকটির তুলনা দেওয়ার সুযোগ নেই। অথবা হতে পারে, সব প্রকৌশলী একটি পরীক্ষায় নিয়োগ হবে এবং পদোন্নতিও একটি প্যাকেজে এবং সব প্রকৌশল দপ্তরেই পদায়ন হবে। তবে এতে পেশাদারত্ব বা স্পেশালাইজেশন সৃষ্টি হবে না। ক্যাডারের বর্তমান ধারণা ভেঙে দিয়ে সার্ভিসভিত্তিক নিয়োগ দরকার এবং এ ব্যবস্থাই পারবে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করতে। ভারতে তো প্রশাসন-পুলিশ-পররাষ্ট্র ভিন্ন সার্ভিস। আরও সুপারিশ চাই। নিয়োগবিধি, নিয়োগ পদ্ধতি, প্রশিক্ষণের আধুনিকায়নের সুপারিশ। একজন নাগরিক হিসাবে বুঝি না, এখনো একটি মাত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে কেন ক্যাডার, নন-ক্যাডার, ক্লাস টু, অর্থাৎ সবটাই করতে হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলাদা কমিশন, ক্লাস টু’র জন্য আলাদা কমিশন করতে বাধা কোথায়!
দুটি বিষয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে মাথায় রাখতে হবে-এক. বর্তমান জনপ্রশাসনের সৃষ্টি কবে হয়েছিল এবং লক্ষ্য কী ছিল। এই প্রশ্নের মধ্যেই চলে আসবে জনপ্রশাসনকে আজকের উপযোগী করতে কী কী সংস্কার চাই। দুই. এখন স্পেশালাইজেশনের যুগ। সব রোগে প্যারাসিটামল চলবে না। এখানেই ল্যাটারাল এন্ট্রির কথা আসবে। প্রশ্ন আসবে, বিশেষজ্ঞ পেতে ল্যাটারাল এন্ট্রিকে বেগবান করা আবশ্যক কিনা। কাজে দক্ষতা দেখাতে পারছে না, তারপরও ৩৫ বছরের মৌরসি পাট্টার মতো চাকরিতে রাখতে হবে কেন? এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ে পদোন্নতি না নিতে পারলে বাড়ি পাঠানোর রেওয়াজ চালু হতে পারে। জনপ্রশাসনের উপরের দিকে কেবল চা বানাতে, ফোন ধরতে কিংবা কম্পিউটারে কম্পোজের জন্য জনবলের কেন দরকার হয়? এখনো তো ২০২৪ সাল।
আমজনতা চায় কম সময়ে, হয়রানিবিহীন এবং কম খরচে সেবা পেতে। সেটি নিশ্চিত করতে যা দরকার, তেমনই হোক সুপারিশ। জনসাধারণ আরও চায় সরকারের কর্মীবাহিনী নিজেদের প্রভু নয়, সেবক মনে করবে। সেটাই হচ্ছে না। ফলে হওয়ানোর সময় এসেছে। ভেবে দেখার দরকার আছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেই কেন একজন প্রতিশ্রুতিশীল নবীন দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ দুর্নীতি রোধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই-বা কী। আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিশনে প্রথমে আটজন এবং পরে আরও তিনজন বিশেষজ্ঞ যুক্ত হয়েছেন। তারা সবাই জনপ্রশাসনে প্রাজ্ঞজন। ফলে জনমানুষের চাহিদা ও প্রত্যাশার কথা ভেবে একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক জনপ্রশাসন পাওয়ার লক্ষ্যে যৌক্তিক-আধুনিক সুপারিশ প্রণীত হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা না হলে আদর্শ জনপ্রশাসনও ঠিকঠাক সেবা দিতে অপারগ হবে।
আরও একটি কথা। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান একজন সৎ, যোগ্য এবং সফল ও উচ্চ রুচির আমলা ছিলেন। বহুজনের আশঙ্কা আছে, তিনি আবার সিএসপি ঢংয়ের কিছু চাপিয়ে দেবেন কিনা! তবে কমিশনে আরও কজন হয়তো কমিশনপ্রধানকে রাইট ট্র্যাকে রেখেই সুপারিশ প্রণয়ন করবেন; সেটাও একটি আকাঙ্ক্ষা বটে। সময়ের উপযোগী একটি জনপ্রশাসন পেতে এই সুপারিশ একটি মাইলফলক হবে-এমনই জনপ্রত্যাশা।
মোহাম্মদ আবদুল মাননান : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক