রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা
মো. মুজিবুর রহমান
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
জনসংখ্যার অনুপাতে রাজনৈতিক দলের সংখ্যার দিক থেকে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বলা যেতে পারে, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক বেশি। এটা যে রাজনীতির প্রতি জনগণের দুর্নিবার আকর্ষণ ও জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলনের কারণে ঘটে, তা নয়। বরং জনগণের সেবার পরিবর্তে এর মাধ্যমে নানা ধরনের ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই অনেকে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আবার একই উদ্দেশ্যে অনেকেই নিজেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নেয়। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত লাভের দিকটি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। ধারণা করি, খুব কমসংখ্যক দলই আছে, প্রকৃতপক্ষে যারা জনগণের সেবা করার মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেকেই রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে নানাভাবে লুটপাট চালিয়ে থাকে। কেউ কেউ বালুমহাল দখলের হাতিয়ার হিসাবে রাজনৈতিক দলের শক্তি ব্যবহার করে, আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর অনৈতিক চাপ প্রয়োগ থেকে শুরু করে টেন্ডারবাণিজ্য, জোরপূর্বক সরকারি জায়গা দখল, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহণ ব্যবসা বাগিয়ে নেওয়াসহ আরও নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়, এমন ক্ষেত্রগুলো নিজের দখলে নিয়ে নেয়। তারা এ ধরনের কার্যক্রম বিনা বাধায় পরিচালনার উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকে একটি অদম্য শক্তি হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এটি যে জনগণ বুঝতে পারে না, তা নয়। তবে জনগণের কোনো স্বার্থ সম্পৃক্ত থাকুক বা নাই থাকুক, রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি নিয়ম-নীতিবহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনা করে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়ে থাকে। এসব করে থাকে রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে। এ ধরনের বেপরোয়া রাজনীতির নামে একদল লোক দুর্বৃত্তায়নমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যায়, এক ধরনের বিনা বাধায়। এদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে কোনো শিক্ষার ছাপ থাকে না বললেই চলে। যখন যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকে, তখন সেই দলের নেতাকর্মী সেজে কেউ কেউ এসব অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। অনেক সময় এ ধরনের বেআইনি কার্যক্রমে শাসক দলেরও পরোক্ষ সম্মতি থাকে। কারণ, শাসক দলের অনেকেই এসব নিয়ম-নীতিবহির্ভূত আয় থেকে ভাগবাটোয়ারা পায় বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও খবর বের হতে দেখা যায়। পরিতাপের বিষয় হলো, ক্ষমতার পালাবদল হলেও এসব সুবিধাভোগীর কোনো বদল হয় না। বরং তাদের লুটপাটের চরিত্র পূর্বাপর একই থাকে। অনেক সময় শুধু লুটপাটের হাত বদল হয় মাত্র। এতে দেশের জনগণের কখনোই কোনো উপকার হয় না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ধরনের পরিস্থিতি নতুন নয়। বরং এ দেশে রাজনীতির শুরুটাই হয় পেশিশক্তি প্রদর্শন ও নানাভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে। কর্মীদের দিয়ে লাঠিসোঁটা বহন করানো ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশের আয়োজনের কথা আজকাল কল্পনাই করা যায় না। বলতে দ্বিধা নেই, যখন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিজের কোনো বক্তব্য থাকে না, দল যখন দেউলিয়াপনায় ভোগে, তখন বক্তৃতা-বিবৃতিতে শুধু রুচিহীন শব্দ ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে আক্রমণ চলতে থাকে। এসব ভাষা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং এগুলো কোনো রাজনীতির ভাষা হতে পারে না।
দেশে এখন নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। এদের মধ্যে এমন একটি দলও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার নেতৃত্বে কোনো অশিক্ষিত লোক রয়েছেন। বরং দেখা যায়, সবক’টি রাজনৈতিক দলই উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞানী, গুণী ও বিজ্ঞজন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের অনেকেই সর্বোচ্চ পিএইচডি ডিগ্রিধারী। এছাড়া দেশের প্রায় সবক’টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অনেক নামকরা আইনজীবী থেকে শুরু করে ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা সম্পৃক্ত রয়েছেন। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে এত গুণী ব্যক্তি থাকার পরও দলীয় কর্মকাণ্ড ও সভা-সমাবেশে নিজের বক্তৃতায় অনেক নেতাই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের উদ্দেশ্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে এত নিুমানের ভাষা ব্যবহার করেন, যা কখনো কখনো সাধারণ ভব্যতার সীমা অতিক্রম করে যায়। অনেক সময় রাজনৈতিক বক্তৃতাকালে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে ‘চোর-বাটপাড়’ শব্দেরও ব্যবহার করা হয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, নিকট অতীতে একবার বরই দিয়ে ইফতার করার অনুরোধ জানানো এক মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের জোটভুক্ত আরেক দলের এক শীর্ষ নেতা ওই মন্ত্রীর শরীরের পশ্চাৎ অংশে (ওই নেতার উচ্চারিত মূল শব্দ এখানে উল্লেখ করা হলো না) লাথি মেরে মন্ত্রিসভা থেকে বের করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহ্বান জানিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা দিয়েছিলেন! একই বক্তৃতায় তিনি ওই মন্ত্রীকে ‘তুই’ বলেও সম্বোধন করতে দ্বিধা করেননি। এ হলো রাজনীতিকদের ভাষা! এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে আসবেন, তারা কী ধরনের রাজনৈতিক ভাষা শিখবেন? তারা কাকে আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করবেন? রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে নানা রকমের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ানো যায়, রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় টিকে থাকা যায় সাময়িকভাবে, কিন্তু তাতে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনায় কোনো ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করা যায় না।
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের এয়ারপোর্টে আমাদের একজন উপদেষ্টার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কয়েকজন প্রবাসী যে ধরনের আচরণ করেছেন, তা সাধারণ শিষ্টাচারবোধ ও ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। অথচ তারা একটি উন্নত রাষ্ট্রের সভ্য সমাজে বসবাস করেন। বিদেশি এয়ারপোর্টে দেশের রাজনীতি নিয়ে এ ধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ কাম্য নয়। এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সরকারের কোনো প্রতিনিধির কাছে দেশের যে কোনো নাগরিক তার রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরতেই পারেন, যে কোনো বিষয়ে জানতে চাইতেই পারেন, এমনকি দাবি-দাওয়াও উত্থাপন করতে পারেন; কিন্তু শুধু রাজনৈতিক কারণে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত অথবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন, সাধারণ সৌজন্যবোধের সীমা ছাড়িয়ে, বিদেশের মাটিতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কাউকে হেনস্তা করা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের ঘটনা একদিনে ঘটেনি। বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বহু বছর ধরে পেশিশক্তির প্রদর্শন এবং অশালীন ও অপ্রীতিকর শব্দাবলি প্রয়োগের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে, রাজনৈতিক অঙ্গনকে একরকম কলুষিত করা হয়েছে ধীরে ধীরে। যারা এসব রুচিহীন শব্দের প্রয়োগ ঘটান, তাদের ভেতর যে প্রকৃত শিক্ষার লেশমাত্র নেই, তা আর নতুন করে বলার দরকার হয় না।
অবশ্য আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং আমরা যে শিক্ষার কথা বলছি, সে শিক্ষা দিয়ে কোনো নাগরিকের নৈতিক গুণাবলীর কতটুকু উন্নতি হচ্ছে, তা এক বড় প্রশ্ন। দেখা যায়, দেশে হু হু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে, বাড়ছে শিক্ষার হার; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ব্যক্তির নৈতিক গুণাবলীর উন্নতি হচ্ছে না। রাষ্ট্র থেকে ঘুস, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপরাধ কমছে না। এসব কোনো অশিক্ষিত ও মূর্খ লোকের দ্বারা ঘটে না, ঘটে শিক্ষিত অথচ অসৎ ও সুবিধাবাদী লোকের দ্বারা। দুর্নীতি দমন কমিশনে আজ পর্যন্ত কোনো কৃষকের নামে ঘুস গ্রহণ নিয়ে কোনো অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানা নেই; যা হয়, সেটা কেবল শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে যারা এসব ঘুস ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে। মাঝে-মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে মামলা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ এটা স্পষ্ট, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে দেশের নাগরিক শ্রেণির এক উল্লেখযোগ্য অংশের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। তাহলে এ শিক্ষা দিয়ে আমরা কী করব? বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গলদ রয়েছে। আমরা কেবল চাকরির বাজারমুখী শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। আবিষ্কারধর্মী ও উদ্ভাবনমুখী শিক্ষা আমরা খুব একটা দিতে পারছি না। এছাড়া নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ও উন্নত চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো ত্রুটি রয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, আমরা রাজনীতি নিয়ে যতটা সময় ব্যয় করি, শিক্ষা নিয়ে ততটা নয়। এ দেশের ঘরে ঘরে রাজনীতিপ্রিয় এবং রাজনীতিসচেতন মানুষের অভাব নেই। অথচ রাজনীতির গুণগত উন্নয়ন হচ্ছে না প্রত্যাশিতভাবে। অফিস-আদালত, কল-কারখানা, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার-সর্বত্র রাজনীতি নিয়ে যত আলোচনা হয়, এ রকম আর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না। রাষ্ট্র থেকেও রাজনীতির প্রতি যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে, শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে তার কিয়দংশও দেওয়া হয় না বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেখা যায়, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য বেশকিছু কমিশন গঠিত হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রের একটি অন্যতম বড় খাত হিসাবে শিক্ষা খাত অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও এ খাতের সংস্কার নিয়ে অদ্যাবধি কোনো কমিশন গঠন করার খবর জানা যায়নি। এ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের শিক্ষা খাত রাষ্ট্রীয়ভাবেই কতটা অবহেলিত। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষাকে অবহেলা করে দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন, ব্যক্তির নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। তাহলেই বৈষম্যহীন ও ন্যায়ভিত্তিক উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে বলে মনে করি।
অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ