কবে মিলবে ডেঙ্গুজ্বরের টিকা
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চলতি বছর সারা দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের পরিস্থিতি ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে রাজধানীসহ সারা দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টির ধরন পালটে যাওয়া এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানা কারণে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারিসহ ছোট-বড় ক্লিনিকে অসংখ্য রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং অনেক রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ একই সময়ে ফিরে আসছে, কম-বেশি সারা বছর চলছে এবং আমরা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি।
ডেঙ্গু বাংলাদেশে নতুন কোনো রোগ নয়, আমরা ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়ছি। তবে ২০১৯, ২০২০, ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ থেকে এর প্রকোপ ক্রমেই বাড়ছে। এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হচ্ছে টিকা বা ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। ডেঙ্গুজ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, নেই কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও। টিকা বা ভ্যাকসিনই ডেঙ্গু প্রতিরোধের একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, করোনা মহামারি শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায় আমরা এর টিকা পেয়ে গেলাম; সারা বিশ্বের মানুষই করোনা টিকার আওতায় এসেছে; কিন্তু ডেঙ্গু এত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রকোপ ছড়ালেও কেন এখনো এর টিকা সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না? এছাড়া অনেকেই জানতে চায়, আমাদের দেশে ডেঙ্গুর কোনো টিকা দেওয়া হয় কিনা বা আসলেই অতি দ্রুত সময়ে টিকা দেওয়া হবে কিনা।
এ বিষয়ে বলতে গেলে, ডেঙ্গুর টিকা যে একেবারে নেই, তা নয়। শুরুর দিকে ডেঙ্গুর কিছু কিছু টিকা বা ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছিল। দেখা যায়, ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধানত চার ধরনের সেরোটাইপ রয়েছে। সেরোটাইপ ১, ২, ৩ ও ৪। ইতঃপূর্বে এমন কোনো কার্যকর টিকা বা ভ্যাকসিন বের হয়নি, যা এ চারটি সেরোটাইপের বিপক্ষেই কাজ করবে। এরপরও যেসব টিকা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যদিও ডেঙ্গুর টিকা তৈরি করতে অনেক বছর ধরেই চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুটি টিকা কিন্তু বের হয়েছেও-একটি ডেংভ্যাক্সিয়া (Dengvaxia) ভ্যাকসিন, আরেকটি কিউডেঙ্গা (Qdenga) ভ্যাকসিন।
ডেংভ্যাক্সিয়া : ডেংভ্যাক্সিয়া টিকাটি বের করেছে ফ্রান্সের একটি ওষুধ কোম্পানি। এ টিকাটির প্রয়োগে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, কিন্তু সেল মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় না। এর ফলে এ টিকাটি নেওয়ার পরে ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কেন এমন হয় তা পরিষ্কার নয়, তবে এ ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে বলে অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট।
সাধারণত ডেংভ্যাক্সিয়া তিনটি ডোজে দিতে হয় ছয় মাস পরপর। কিন্তু এ ভ্যাকসিনটি সবাইকে দেওয়া যায় না। সাধারণত ৯ থেকে ১৬ বছরের বাচ্চাদের দেওয়া হয়, অর্থাৎ ৯ বছরের নিচে এবং ১৬ বছরের উপরে যারা, তাদের কেউই এ টিকা নিতে পারবে না। এছাড়া ঢালাওভাবেও এ টিকা সবাইকে দেওয়া যায় না। যাদের একবারও ডেঙ্গু হয়নি, তাদের এ টিকা দেওয়া যাবে না। সাধারণত যাদের রক্ত টেস্ট করে ডেঙ্গু পজিটিভ অ্যান্টিবডি পাওয়া যায় বা আগে কখনো ডেঙ্গু হয়েছিল, এমন মানুষদেরই টিকাটি দেওয়া যায়। এর বাইরে কাউকে এ টিকা দেওয়া যায় না। টিকাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ রকম সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আগে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হলে এবং ভুলক্রমে তাকে এ টিকা দেওয়া হলে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। উপরন্তু যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি (সেরোনেগেটিভ), তাদের জন্য এ ভ্যাকসিনটি নিরাপদ নয়।
কম বয়সি শিশু ও যাদের আগে ডেঙ্গু হয়নি, তাদের এ ভ্যাকসিন দিলে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তবে এর কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহের কথা শোনা যায়। কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমনকি এ ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের ফলে কিছু জটিলতা দেখা যায়; সে কারণে এর কার্যকারিতা নিয়ে অনেক সন্দেহ রয়ে গেছে।
কিউডেঙ্গা : কিউডেঙ্গা হচ্ছে জাপানভিত্তিক একটি ডেঙ্গু টিকা। আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত (সেরোপজিটিভ) অথবা অনাক্রান্ত (সেরোনেগেটিভ) যে কোনো মানুষ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিতে পারবে। তবে এটিও ঢালাওভাবে সবাইকে দেওয়া যায় না। শুধু ৬ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে যে কাউকে দেওয়া হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই ইতোমধ্যে টিকাটির ব্যবহার শুরু হয়েছে। শোনা যায়, কিউডেঙ্গা টিকাটি তুলনামূলক বেশি কার্যকর। দুটি ডোজ দিতে হয় তিন মাস পরপর। এ টিকাটি ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কার্যকর বলে প্রমাণিত। শুধু তাই নয়, কিউডেঙ্গার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্য টিকার তুলনায় খুবই কম। প্রায় ২০টি দেশে টিকাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ায় কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিনটি প্রচুর পরিমাণে দেওয়া হচ্ছে। কিউডেঙ্গা টিকাটি চার বছর পর্যন্ত সুরক্ষা দেয় প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই। এ টিকা একদিকে ৭০ শতাংশ কার্যকর এবং যারা এটি একবার গ্রহণ করে, তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ৯০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে যেতে হয় না। সর্বোপরি বলা যায়, জাপানের তৈরি ভ্যাকসিনটি যথেষ্ট কার্যকর ও নিরাপদ হিসাবে বিবেচিত।
একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, ডেংভ্যাক্সিয়া এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) স্বীকৃতি পায়নি। তবে কিউডেঙ্গার অনুমোদন দিয়েছে সংস্থাটি। অনেক দেশে টিকাটি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেকেই টিকাটি দেওয়ার পক্ষপাতী, বিশেষ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের একটি বড় অংশ শিশু ও কিশোর। তাই ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সিদের ডেঙ্গুর সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য টিকা দেওয়া উচিত বলে অনেকে মনে করেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে এখন ইন্দোনেশিয়ায় কিউডেঙ্গা টিকা বেশি দেওয়া হচ্ছে। আমরা সেখানকার ফলাফলটা দেখি। যদি ফলাফল ইতিবাচক, কার্যকর ও ভালো হয়, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দেশেও এ ধরনের টিকা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশেও আইসিডিডিআরবির সহায়তায় ‘টেট্রাভেলেন্ট’ ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ‘টিভি ০০৫’-এর ট্রায়ালের প্রথম দুই ধাপ শেষ হয়েছে এবং সফলতা পেয়েছে। তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালটি শেষ হওয়ার পথে। সফল হলে এর কার্যকারিতা আরও ব্যাপকভাবে প্রমাণিত হবে। তৃতীয় ধাপের হিউম্যান ট্রায়াল শেষ হলে এবং চতুর্থ ধাপের ট্রায়াল সফলভাবে শেষ করতে পারলেই এটি উৎপাদনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন চাওয়া হবে। ইতোমধ্যে টিকাটির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে এবং এ টিকার অন্যতম সুবিধা হলো একটি ডোজ নিলেই তা কাজ করবে। আরেকটি সুবিধা হলো, একটি ডোজই ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধেই কার্যকর হবে। শিশুসহ যে কোনো বয়সের মানুষের জন্যই টিকাটি কার্যকর। এটি ট্রায়াল শেষ করে বাজারে আসতে এখনো কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
ডেঙ্গু যেহেতু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, সেজন্য আমাদেরও চেষ্টা থাকবে-নিজেরা ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারি কিনা। যতদিন কার্যকর ভ্যাকসিন আমরা না পাই, ততদিন ডেঙ্গু থেকে নিরাপদে থাকতে আমাদের প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করাটাই আমাদের জন্য এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাস্তবতা হলো, ডেঙ্গু শুধু আর শহরকেন্দ্রিক রোগ নয়, সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ছে কম-বেশি। সুতরাং, আমাদের সবাইকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টেকসই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গড়ে তোলার বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা অপরিহার্য। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডেঙ্গু সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান হতে পারে।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক