রাজনৈতিক মতৈক্যের বিকল্প নেই
মোহাম্মদ হোসেন
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাল বংশের উদ্ভবকালে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল, সে সময়ের বঙ্গবাসীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতার তুলনায় আমরা সমসাময়িক বাংলাদেশে কিছু উন্নতি করতে পেরেছি কিনা, তা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক মেধা ও পরিমণ্ডল কি ওই ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমমানের বা নিম্নমানের? এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ কর্তৃক রচিত ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ নামক গ্রন্থ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘তারনাথ গোপালের উত্থান সম্বন্ধে একটি রূপকথার কাহিনির অবতারণা করেছেন। তার কাহিনির সারমর্ম এই যে, দেশে বহুদিন ধরে অরাজকতার ফলে জনগণের দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা মিলিত হয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে একজন রাজা নির্বাচিত করেন। কিন্তু নির্বাচিত রাজা রাত্রিতে এক কুৎসিত নাগরাক্ষসী কর্তৃক নিহত হন। এরপর প্রতি রাত্রিতে একজন করে নির্বাচিত রাজা নিহত হতে থাকেন। এভাবে বেশ কয়েক বছর গত হয়ে যায়। অবশেষে একদিন চুন্ডাদেবীর এক ভক্ত এক বাড়িতে আসে। সেই বাড়ির সবাই খুব বিষণ্ন। কারণ ওইদিন নির্বাচিত রাজা হওয়ার ভার পড়েছে ওই বাড়িরই এক ছেলের ওপর। আগন্তুক ওই ছেলের স্থানে রাজা হতে রাজি হন এবং সকালবেলা তিনি রাজা নির্বাচিত হন। সেই রাত্রিতে নাগরাক্ষসী এলে তিনি চুন্ডাদেবীর মহিমাযুক্ত এক লাঠি দিয়ে তাকে আঘাত করেন। রাক্ষসী মরে যায়। পরের দিন তাকে জীবিত দেখে সবাই আশ্চর্য হয়। পরপর সাত দিন তিনি এভাবে রাজা নির্বাচিত হন। অতঃপর তার অদ্ভুত যোগ্যতার জন্য জনগণ তাকে স্থায়ী রাজারূপে নির্বাচিত করে এবং তাকে গোপাল নাম দেওয়া হয়।’
এ রূপকথার উপরে বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার অনেক আবেগঘন আতিশয্য ব্যক্ত করেছেন, যার সঙ্গে ওই চার অধ্যাপক একমত নন। যা হোক, বাংলার ইতিহাস বিনির্মাণে খালিমপুর লিপির শ্লোকটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকরা মনে করেন। এ শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘মাৎস্যন্যায়’ অবস্থার অবসানের জন্য ‘প্রকৃতিগণ’ গোপালকে রাজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। ‘মাৎস্যন্যায়’ শব্দের স্পষ্ট ব্যাখ্যা বা অর্থ থাকলেও ‘প্রকৃতি’ শব্দের তাৎপর্য বা রূপক বা আক্ষরিক কোনো অর্থই নির্ণয় করা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, ‘প্রকৃতিগণ’ বলতে উচ্চ শ্রেণির রাজকর্মচারী বা সমাজের উচ্চবর্গীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সমাজপতিরা। অধ্যাপকরা বিশ্লেষণ শেষে যে নির্ণয়ে উপনীত হয়েছেন, তা হলো, ‘গোপাল একজন সমর নেতা হিসাবে কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় অরাজকতার অশুভ শক্তিগুলোকে পরাস্ত করে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। সাফল্যই তার জন্য বিপুল সমর্থন জুগিয়েছিল।’ বঙ্গে বা এর বাইরেও ছোট ছোট রাজ্য বা জমিদারি নিয়ে এরূপ উপকথাও প্রচলিত আছে, জমিদার বা রাজা নিরুদ্দেশ বা কোনো যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তার উত্তরাধিকারী বা আমত্যজনদের মধ্যে এমন বিষম কোন্দল, কে রাজা হবে তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। পরে রাজার হাতিকে ছেড়ে দেওয়া হলো রাজা খুঁজে আনার জন্য। রাজহাতি সারা দিন অথবা ৭ দিন ভ্রমণ করে দীনহীন একজন রাখাল বা ফকির বা সাধুকে পিঠে করে নিয়ে এসে রাজবাড়ির সিংহ দরজায় দাঁড়াল আর রাজবাড়ির সবাই এবং পার্শ্ববর্তী প্রজা সবাই হইহই করে তাকে রাজা রূপে অভিষেক করে আবার স্বাভাবিক রাজ্যপাঠ শুরু করল। এরূপ রাজার শাসনে সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকল।
আমরা এ বঙ্গীয় ‘ব’দ্বীপের বাসিন্দারা এভাবে বা পাল বংশের উদ্ভবের যে পদ্ধতি, তার চেয়ে উন্নত কোনো পদ্ধতিতে শাসক বাছাইয়ের জন্য উপযুক্ত বা পরিপক্ব হয়েছি কিনা, তার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। ৯০-এ এরশাদ পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ‘গোপাল’ হিসাবে নিয়োগ করা হলো। তিনি একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দিয়ে আবার বিচার কাজে চলে গেলেন। ‘মাৎস্যন্যায়’ চলতেই থাকল। পরে ’৯৬-এ আবার সংবিধান সংশোধন করে একজন ‘প্রধান গোপাল’ ও আরও কিছু গোপালের সমন্বয়ে একটি সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা হলো। এরূপ গোপালেরা ৯৬ ও ২০০১-এর দুটো মীমাংসা ঠিকঠাকই করেছিলেন। এতে কারও কারও পোষাল না। তারা ‘গোপাল’ বাছাইয়ের নয়া ফন্দিফিকির করাতে ‘গোল’ বেঁধে গেল। অরাজকতার একদম চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল। এবার দিশেহারা রাজহাতি নিজেই ছুটে বেরিয়ে গেল। অতঃপর একজন রাখাল আর একজন লাঠিয়াল খুঁজে নিয়ে এলো। তারা দুজন মিলে আরও কয়েকজন সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির নিয়ে আপাত একটা জনস্বস্তির ব্যবস্থা করলেন। সাময়িক কিছুদিন ডান্ডা মেরে অরাজকতা ঠান্ডা করলেন। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারলেন না। দেশ আবার হিংস্র সরীসৃপের শাসনে ছেড়ে দিয়ে কেঁদে বাঁচলেন। এ হলো ১৯৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাপাত বা বিবর্তন।
২০০৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহণকারী এক দঙ্গল হিংস্র সরীসৃপের মধ্যে থেকে বের হয়ে এলো এক ভয়ানক ‘নাগরাক্ষসী’, যার বিষাক্ত ছোবলে গোটা জাতি জর্জরিত হয়ে পড়ল। তার আগ্রাসী দংশনে জাতির প্রাণ যায় যায় অবস্থায় উপনীত হলো। বিধাতার অপার করুণায় জুলাই বিপ্লব আর আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ফলে ওই ‘নাগরাক্ষসী’ বিতাড়িত হলো। আমাদের প্রয়োজন হলো আবার একজন ‘গোপাল’র। ২০২৪ সালে এসে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমর নেতা, বিচক্ষণ ‘গোপাল’র স্থলাভিষিক্ত হলেন একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস। তাহলে যদি আমার মতো একজন সাধারণ বুদ্ধির মানুষ এরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের সমসাময়িক যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা ও পরিস্থিতি এবং তার ১২৭৫ বছর পরে ২০২৪ সালের বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা, পরিস্থিতির মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? তা কি খুবই ভুল হবে? শুধু সময়, মানুষের সংখ্যা, দেহগত মানুষেরই হয়তো পার্থক্য আছে! আমার দৃষ্টি এর চেয়ে আর বেশি কিছু দেখতে পায় না। বাংলার পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ‘গোপাল’ যেমন ছিলেন দক্ষ সমর নেতা, তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ শাসক। আমরা ২০২৪ সালেও একজন কাঙ্ক্ষিত মানের শাসক পেয়েছি; কিন্তু তাকে ঘিরে ধরছে হাজারটা সমস্যা। তিনি এবং তার সহযোগীরা সংবিধান ও রাষ্ট্র সংস্কার করতে চান, যা একটি জনআকাঙ্ক্ষাও বটে। কিন্তু কীভাবে করবেন? রাজা গোপালের সময়ে ‘প্রকৃতিগণ’ তাকে প্রবলভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের ‘প্রকৃতিগণ’ বোধের অসাধ্য, বিরূপ, বিষম। তারা কী চায় বোঝা ভীষণ দায়! তারা হয়তো ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘সাক্ষী গোপাল’ বানাতে চায়।
প্রথমত, আমরা সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখন নিয়ে কথা বলতে চাই। আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যদি ওই পালযুগীয় হয়, তাহলে এ সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা বা উদ্দেশ্য কী? ‘প্রকৃতিগণ’ বলছেন, সংবিধান সংশোধনের ম্যান্ডেট ড. ইউনূসের নেই। সংবিধান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অতি সাধারণ একটি অনুষঙ্গ মাত্র। এ সংবিধান কি গত ৫৩ বছরে গণতন্ত্র দিতে পেরেছে, না ভবিষ্যতে পারবে? সংবিধান ও আইনের নাম করে সরকারি কর্তৃত্বের হুকুমে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সরাসরি নাগরিকের বুক লক্ষ করে গুলি ছুড়েছে। সংবিধানে অধিকারের ভালো ভালো বাণী লেখা থাকলেও ওই সংবিধান কি উড়ে গিয়ে বর্ম হয়ে নাগরিকের বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়া আটকাতে পেরেছিল? স্বৈরশাসক যেমন সংবিধান সংবিধান জিকির তুলে যাচ্ছেতাই করেছে, তেমনি এখনো নাগরিক সমাজ সংবিধান নিয়ে বিভক্ত হয়ে সাংবিধানিক দড়ি টানাটানি করছে! ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ-পরবর্তী রাজা ‘গোপাল’র কি কোনো সংবিধান ছিল? নাগরিকদের প্রয়োজন ন্যায়বিচার, উন্নত জীবন, সংবিধান নয়।
দ্বিতীয় বিষয় রাষ্ট্র সংস্কার : এ রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার প্রয়োজন। এটি সংস্কার বা মেরামত করেও চালানো যাবে কিনা এ বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্দিহান। মানুষের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধির যদি উন্নতি না হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির যদি মান উচ্চ না হয়, তাহলে সংস্কার করে কী হবে? সে সংস্কার তো টেকসই হবে না। সময়, শ্রম বৃথা যাবে। যে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে যে ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তা কি যথেষ্ট? যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারা কি পূর্ণাঙ্গ চিত্র দৃশ্যায়ন করতে পারবেন? কমিশনের কর্তাদের নিয়েও তো বিতর্কের অভাব নেই। এ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পূর্ববর্তী অপশাসনের জঞ্জাল পুঞ্জীভূত রয়েছে। আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণে যে কায়েমি স্বার্থবাদ জারি আছে, তা চিহ্নিত করা এবং অপনয়ন এ সরকারের পক্ষে কি আদৌ সম্ভব? জনপ্রশাসন, বিশেষ করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার যেভাবে এতদিন অন্যান্য ক্যাডারকে বঞ্চিত করে নিজেরা দলবেঁধে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি নিয়ে আমলাতন্ত্রের স্বাভাবিক সব সূত্র তছনছ করে দিয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কমিশন কোনো সুপারিশ করতে পারবে বা সাহস দেখাবে? যদি এরূপ ব্যবস্থা হয়, বিসিএস ক্যাডারগুলোর ব্যবস্থাপনা, পদোন্নতি, পদায়ন পক্ষপাতহীন করার জন্য নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন কমিশন গঠন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাধায় এরূপ সংস্কার কি এ সরকার কার্যকর করতে পারবে? তা কি পরবর্র্তী কোনো সরকার মানবে? আর কোথায় সংস্কার করবেন? নির্বাচন ব্যবস্থায়? কী সংস্কার করবেন? স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় পরিষদ সব নির্বাচনে বয়স ১৮ বছর হলেই ভোট দিতে পারে। এরা কি স্বাধীন চিন্তা থেকে, জাতীয় উন্নয়নের চিন্তা বা জাতীয় চরিত্র গঠনের চিন্তা থেকে ভোটদান করে? ভোটাররা কি হুজুগে, কালো টাকার প্রভাবে, টাকা নিয়ে ভোট দেয় না? টাকা দিয়ে স্থানীয় মাস্তান ভাড়া করে হিসাব-নিকাশ করে কয়েকটা ভোটকেন্দ্রে ভোট কাটতে পারলেই পাশ, অতঃপর এমপি-মন্ত্রী। এসব অপকৌশলের প্রয়োগ কীভাবে সংস্কার হবে বা রোধ করা যাবে? দুর্নীতি দমন কমিশন কি সংস্কার করা হবে? দুর্র্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগে নিয়োগের সময়ে কি এরূপ কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়, যার দ্বারা নিয়োগ প্রার্থীর নৈতিক মানদণ্ড নির্ণয় করা হবে? ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতা বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করবে না, এরূপ কোনো ব্যবস্থা কি গ্রহণ করা সম্ভব হবে? স্বাস্থ্য খাতে বিশেষত পেরিফেরিতে সরকারি হাসপাতালে কোনো ডাক্তার, এমনকি পেরিফেরি মেডিকেল কলেজে পড়ানোর জন্য সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সব নষ্ট থাকবে, কী করবেন? কোথায় সংস্কার করবেন? একটি স্বাধীন জাতি গত ৫৩ বছরের ঠিক করতে পারেনি তার শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? কীভাবে শিখবে? কে শেখাবে? শিক্ষা লাভ করে কী কাজ করবে? মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওনামক এক অরাজকতা চলছেই। কী সংস্কার করবেন এখানে? বাস্তব অর্থে এসব সংস্কার আদৌ করা সম্ভব? সম্ভব হলে কীভাবে? জাতির মধ্যে কি সংলাপ হয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে?
বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইতোমধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অন্তত ৭০টি আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচনপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চুপ। তাহলে সংস্কার কেমনে হবে? আর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত বা পুনর্নির্মাণই বা কীভাবে হবে?
পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম একটি মৌলিক নীতি হলো, ছোট ছোট সংস্কার করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এমন একটা ভারসাম্যের মধ্যে রাখা, যাতে কেউ বিপ্লব/বিদ্রোহ ঘটাতে না পারে। গত ৩৪ বছর ধরে তথাকথিত গণতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র এ সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ক্রমান্বয়ে ব্যবস্থাটিকে এমন এক খাদের কিনারে নিয়ে গেছে, রাষ্ট্র রক্ষার জন্য ঘটনাক্রমে একটা অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিপ্লব ঘটেনি। কাজেই বিপ্লব ঘটাতে এবং বিপ্লবকে সংহত করে রাষ্ট্র সংস্কার করা গোপালের জন্য ‘নাগরাক্ষসী’ মোকাবিলা করার চেয়েও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এ রাষ্ট্রটির বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হতে হতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বহু ক্ষেত্রে আর সংস্কারযোগ্য নেই। ক্যানসারের চিকিৎসার মতো আগে কেটে ক্ষত অপসারণ করে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দরকার। এক্ষেত্রে রয়েছে গভীর সংকট। এ বিষয়ে যেমন জাতির ঐকমত্য গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাই ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব বা কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে বা অনর্থক বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে না।
যা হোক, আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের জন্য এখনই রাজনৈতিক ঐক্যের সংস্কৃতির উদ্বোধন প্রয়োজন। আশা করি, ২০২৪ সালে ‘প্রকৃতিগণ’ তা উপলব্ধি করতে পারবেন এবং আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থনে ঐকমত্য গড়ে তুলবেন। নইলে এ বঙ্গবাসীকে শশাঙ্ক-পরবর্তী মাৎস্যন্যায় যুগেই বসবাস করতে হবে।
মোহাম্মদ হোসেন : লেখক ও বিশ্লেষক