শতফুল ফুটতে দাও
১৯৭৫ : আগস্ট ও নভেম্বর
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থানে বিশাল পরিবর্তন আসে। বছরটি ছিল ১৯৭৫। এই বছরের আগস্টের ১৫ তারিখ এক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সম্পর্কে বর্ণনা করতে হলে বলা যায়, ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন হয়। আগস্টের ১৫ তারিখে পটপরিবর্তনের নেতৃত্ব দেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। বাংলাদেশের রেডিও থেকে মেজর ডালিম ঘোষণা করেছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছে এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশাল জনপ্রিয়তার ঐতিহ্যবহনকারী নেতাকে সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে হত্যা করলেও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। মনে হয়েছে, সাধারণ মানুষ এ রক্তাক্ত পরিণতিতে অসন্তুষ্ট নয়। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতির মোড় পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা অনেক সময় দেখি, নদী তার খাত পরিবর্তন করে। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে বান ডাকে। যখন নদীর বান ডাকা স্তিমিত হয়ে আসে, তখন নদীর এক পাড় ভাঙে এবং অন্য পাড়ে পলি জমা হয়ে নতুন ভূমি সৃষ্টি হয়। এ কারণেই হয়তো ভাবুক কবি গান রচনা করেছিলেন, নদীর একূল ভাঙে, ওকূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের রাজনীতিও নদীর মতোই।
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পটপরিবর্তন ঘটে, তা নিছক নদী ভাঙনের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এ পরিবর্তনটি অনেকটাই ব্রহ্মপুত্র নদীর খাত পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনীয়। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ব্রহ্মপুত্র নদের পুরোনো খাতটি ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো। ব্রহ্মপুত্রের খাত পরিবর্তনের ফলে ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের অংশটি মৃত্যুবরণ করে। এতে পানির প্রবাহ শূন্যের কোঠায় চলে যায় এবং নদীটির নামকরণ করা হয় পুরোনো ব্রহ্মপুত্র। নিঃসন্দেহে ব্রহ্মপুত্র নদের খাত পরিবর্তন শক্তিশালী ভূমিকম্প না হলে হতো না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পের মতোই বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের ফলে ‘এক নেতা এক দেশ’ স্লোগানের মৃত্যু ঘটে। শেখ মুজিবের দুঃশাসনের দিনগুলোতে তারই ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি বলেছিলেন, ‘আমরা আইনের শাসন চাই না, চাই মুজিবের শাসন।’ ১৫ আগস্ট এ ধরনের দম্ভোক্তির সমাপ্তি টেনেছে। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক একনায়কত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে প্রবর্তিত একদলীয় বাকশালতন্ত্রের পতন ঘটে। ১৯৭২-এর সংবিধান তিনবার সংশোধনের পর চতুর্থবারে এসে একদলীয় শাসনের সংবিধানে পরিণত হয়েছিল। আগস্ট অভ্যুত্থানের ফলে একদলীয় বাকশাল শাসনের দুঃসহ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি লাভ করে। সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনতার মুখ দেখতে পায়। গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনীর ঘেরাও ও দমনের অভিযান বন্ধ হয়। অনেকদিন পর গ্রামের মানুষ শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ পায়। এ প্রাপ্তিগুলো কোনোক্রমেই ঠুনকো কিছু নয়। একটি দেশে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত হয়ে ঘুমাতে পারলে, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! এখন মানুষ কতটা সুখে আছে, তার সূচক নির্ণয় করা হয় Happiness index দিয়ে। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছিল। এ থেকে বলা যায়, ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের মানুষ সুখ কিসে, তা বুঝতে শুরু করে।
উল্লেখ্য, খন্দকার মোশতাকের সরকার স্বীকৃতি অর্জন করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের আনুগত্য ঘোষণার মাধ্যমে। মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এমএইচ খান, বিডিআর ও পুলিশ প্রধানরা।
আন্তর্জাতিকভাবে মোশতাক সরকারকে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় সৌদি আরব এবং চীন। বাংলাদেশের এ পরিবর্তনে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক তাকে আশ্বস্ত করেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি অক্ষুণ্ন থাকবে। ইংরেজি পত্রিকায় শিরোনাম হলো, ‘Four state principles stay.’ বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বজায় থাকবে জানালে ভারতীয় হাইকমিশনার আশ্বস্তবোধ করেন।
প্রায় তিন মাসের মাথায় ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ সামরিক ক্যু’র ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগতদের নিয়ে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করা হয়। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পরদিন ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ও সিপিবি ৩ থেকে ৪ হাজার কর্মী ও নেতাদের নিয়ে একটি বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেয়। এ মিছিল শেখ মুজিবের বাসভবন পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সেখানে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। এ মিছিলে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফ অংশগ্রহণ করেন। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে মিছিলের এ ছবি বের হলে মানুষ ভাবতে থাকে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের লোক এবং তার সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর যোগাযোগ আছে। সেই সময় বাংলাদেশের জনগণ তীব্র ভারতবিরোধী হয়ে উঠেছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজে নিজেই মেজর জেনারেলে উন্নীত হন এবং সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তাওয়াব মেজর জেনারেলের র্যাংকব্যাজ পরিয়ে দেন। প্রায় একই সময়ে বঙ্গভবনে বসে খালেদ মোশাররফ প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েত উল্লাহ খানের কাছ থেকে টেলিফোনে জানতে পারেন, তার মা ও ভাই আওয়ামী লীগের মিছিলে যোগ দিয়েছেন। এতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বলতে থাকেন, আমার মা ও ভাই আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে। সেই সময় জনগণের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ছিল ভারতপন্থি দেশদ্রোহীর দল। তিনি এনায়েত উল্লাহ খানকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করা যায়? এনায়েত উল্লাহ খান তাকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিতে পরামর্শ দেন। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। তিনি দেশবাসীকে জানান, সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এতে খালেদ মোশাররফের শেষ রক্ষা হয়নি।
৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টে জওয়ানরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তারা দলে দলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। রাজপথে ট্যাংক ও কামানসজ্জিত হয়ে বিদ্রোহী সিপাহিরা বিপ্লবের স্লোগান দিতে থাকে। তারা স্লোগান দিচ্ছিল, সিপাহি বিপ্লব জিন্দাবাদ, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ। লক্ষণীয়, তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়নি। তারা স্লোগান দিয়েছিল ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’ রাজপথে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সিপাহি বিপ্লবের সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করে। এ অভ্যুত্থানকে চিহ্নিত করা হলো ‘সিপাহি-জনতার’ বিপ্লব রূপে। জিয়াউর রহমানকে সৈনিকরা মুক্ত করে আনল। সূচিত হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়। জিয়াউর রহমান বন্দি হয়েছেন জেনে সাধারণ মানুষ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। অনেকে দারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। আসলে উৎকণ্ঠায় ভোগার ফলে সাধারণ মানুষ খাবার গিলতে পারছিল না। সর্বোপরি ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো রকমের সরকার আছে কিনা, তা নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠায় পড়ে গেল সাধারণ মানুষ। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন। দেশকে তারা কত ভালোবাসেন।
জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। তিনি জনগণের প্রতি শান্ত থাকা এবং নিজ নিজ কর্মসম্পাদনের জন্য আহ্বান জানান।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে জাসদ ও কর্নেল আবু তাহেরের একটি ভূমিকা ছিল। জাসদ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি গোপন সংগঠন তৈরি করেছিল। এ সংগঠনের আওতায় জড়িত ছিল বেশকিছু সৈনিক। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশি হবে না। তাহের ও জিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল, জিয়া বন্দিদশা থেকে তাহেরের চেষ্টায় মুক্ত হলেও তাহেরের হঠকারী ধ্যান-ধারণার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাহেরের ইচ্ছা ছিল, মুক্ত জিয়া তার সঙ্গে শহিদ মিনারে এসে ভাষণ দেবেন। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে জিয়ার শুভানুধ্যায়ী অফিসাররা তাকে শহিদ মিনারে যেতে বারণ করেন। তাহের সেনাবাহিনীতে জিয়ার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সবকিছু ভেবেচিন্তে জিয়া শহিদ মিনারে যেতে অস্বীকার করেন। দুই উঁচু মাপের মুক্তিযোদ্ধা জিয়া ও তাহেরের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা স্লোগান তুলল, ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই’, ‘অফিসারদের রক্ত চাই’। ক্যান্টনমেন্টে কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করল বিপ্লবী সৈনিকরা। জিয়া সাহস ও ধৈর্যের সঙ্গে সিপাহিদের ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিরস্ত্র করতে সক্ষম হলেন। সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরে এলো। জিয়া যদি সেনাবাহিনীতে নিয়ম-শৃঙ্খলা উদ্ধারে সফল না হতেন, তাহলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দখলে চলে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যেত।
৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। এই দিন বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র শপথ গ্রহণ করে। জিয়ার মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বের ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উৎপাদনের জোয়ার সৃষ্টি হয়। জিয়া দেশের নারী-পুরুষ, কিশোর-যুবক, শিশু ও প্রৌঢ়সহ সব মানুষকে নিয়ে জাতি গঠনের মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। নিখুঁত দেশপ্রেম ও জাতি গঠনে সঠিক কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য জিয়া যুগ-যুগান্তরে মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই নিয়ে থাকবেন। জিয়ার দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রয়াস প্রতিবেশী দেশটির মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাদের গোয়েন্দা সংস্থার চক্রান্তের ফলে জিয়া ১৯৮১-এর ৩০ মে একদল সামরিক অফিসারের হাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ