চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য চ্যালেঞ্জ অসংখ্য জটিল রোগ
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য চ্যালেঞ্জ অসংখ্য জটিল রোগ](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/11/06/3-(49)-672aa43866e13.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন মানুষ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে। আমরা আমাদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারি, গবেষকরা আমাদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কার কথা অনুমান করতে পারেন। নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হচ্ছে। আমরা জানি সুষম খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে কীভাবে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করতে পারি, রোগ নির্ণয়ের জন্য নতুন নতুন আধুনিক পন্থা ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তারপরও বিশ্বে অধিক হারে মানুষ নিত্যনতুন জটিল ও অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে।
অনেকেরই ধারণা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নয়ন আমাদের এমন চিকিৎসা সরঞ্জাম, অভিজ্ঞতা, রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা ও জাদুকরী ওষুধ প্রদান করবে, যা গ্রহণ বা ব্যবহার করে আমরা আমাদের সব স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করতে পারব। যখন আমরা এরকম আশাবাদী চিন্তায় মগ্ন, তখন বিভিন্ন দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য মানুষ জটিল ও প্রাণঘাতী ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা ভেবে কূল পাচ্ছেন না, কেন এত অধিকসংখ্যক মানুষ প্রতিবছর বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কীভাবে এসব রোগ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের মাধ্যমে অসহায় মানুষকে রক্ষা করা যায়। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষ নেই। উন্নত বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা নানা ধরনের জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়েও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না, কেন মানুষ বিশেষ স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য চিকিৎসা নিয়ে ভিন্ন ধরনের ফলাফল পাচ্ছে। এটা কি এ কারণে যে, প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে আলাদা, অন্য মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য নেই? বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ও প্রাণঘাতী স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে স্থূলতা, এইজিং, ডিমেনশিয়া, ক্যানসার, সংক্রামক রোগ ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়বেটিসের মতো নানা জটিল রোগ। এখন রোগের ধরন ও প্রকৃতিকে পুরোনো দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করার সুযোগ কমে যাচ্ছে।
আমাদের বিশেষ কিছু রোগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা পাওয়ার জন্য ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসাবে এটা বোঝা এখন সহজ হয়েছে যে, কোনো কোনো মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্য অন্যদের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। এ কারণেই সব মানুষ একই চিকিৎসা পদ্ধতিতে একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। দেখা গেছে, একই পরিবারের সব সদস্যের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সমান নয়। কেউ হয়তো সামান্য কারণে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে, অন্য কেউ কোনোরকম স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াই দীর্ঘদিন সুস্থ জীবনযাপন করে যাচ্ছে। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে মানুষ এখন কোষ পর্যায়ে রোগের উৎপত্তি বিশ্লেষণ করতে পারে। এটাকে এক অসাধারণ বিপ্লব বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও রোগ সম্পর্কে নিত্যনতুন ধ্যানধারণা কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন বিভিন্ন মানুষের জন্য ভিন্ন উপায়ে রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সুষ্ঠু উপায় খুঁজতে চেষ্টা করছেন। তবে নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের অনেক বিষয় খুব সহজভাবে বুঝতে সাহায্য করছে সত্যি। সমসাময়িককালে এসব উন্নয়ন আমাদের সামনে এমন সব জটিল বিষয় উপস্থাপন করছে যার সমাধান খুঁজে পেতে হয়তো আমাদের অনেক সময় লেগে যাবে। আর এ কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে একদিকে এগিয়ে থাকলেও অন্যদিকে এসব জটিলতার কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি, আমরা সমানতালে এগোতে পারছি না।
শুরুতে বলেছিলাম, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে আমরা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশিদিন বাঁচি। কিন্তু বেশিদিন বাঁচা আর সুস্থভাবে বাঁচা এক জিনিস নয়। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, স্বাস্থ্য সমস্যাও তত বাড়ে। রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার ও লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞান একজন মানুষকে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্ত যে কারও মনে হতে পারে, এ জীবন তার জন্য মঙ্গলজনক নয়, সহনশীলও নয়। দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্ত অধিকাংশ মানুষ ডিমেনশিয়া বা মস্তিষ্কের কার্যকারিতাহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অনেক কিছুই মনে রাখতে পারে না, মতিভ্রমে ভোগে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও বিভিন্ন জটিল সংবেদনশীল সিস্টেম অকার্যকর হতে শুরু করে। অনেক মানুষ মাত্রাতিরিক্ত অসুস্থতার কারণে নিজের যত্ন নিজে নিতে পারে না, অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়। এ সমস্যা উন্নত বিশ্বে অতি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানে সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। সিনিয়র সিটিজেনদের ভরণপোষণ, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে সরকারকে বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বয়সজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগবিমারির কারণে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কিছু দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয় এবং প্রায়ই মারা যায়, নতুবা অসুস্থতা বা পঙ্গুত্ব নিয়ে দুর্বিষহভাবে জীবনযাপন করে। বয়স্ক মানুষ সাধারণত ক্যানসার, উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও টাইপ-২ ডায়বেটিসে বেশি আক্রান্ত হয়। অনেক বয়স্ক মানুষ স্থূল হয়ে যায় বলে স্বাস্থ্য সমস্যা আরও জটিল হয়ে পড়ে। উল্লিখিত রোগের কমবেশি চিকিৎসা থাকলেও ডিমেনশিয়া নিয়ে গবেষকরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কারণ ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ বা প্রতিকারে এখনো কোনো পন্থা আবিষ্কৃত হয়নি। ইতোমধ্যে ডিমেনশিয়া নিয়ে বেশকিছু গবেষণা হয়েছে।
কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিন্তাভাবনা করছেন। তার মধ্যে রয়েছে স্টেমসেল থেরাপি। স্টেমসেল থেরাপির মাধ্যমে মস্তিষ্কের রোগাক্রান্ত কোষ বা কোষপিণ্ডকে সরিয়ে সুস্থ কোষ বা কোষ সমষ্টি প্রতিস্থাপন করলে ডিমেনশিয়ার প্রতিকার হতে পারে। সামাজিক সম্পর্ক বা লাইফস্টাইল ডিমেনশিয়ার ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ডিমেনশিয়ার ধরন, প্রকারভেদ ও অন্যকিছু রহস্যজনক ফ্যাকটর বিজ্ঞানীদের চরম বিভ্রান্তিতে ফেলে রেখেছে, যা উত্তরণের পথ এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এককথায়, ডিমেনশিয়ার সংজ্ঞা প্রদান করা সহজ নয়। ডিমেনশিয়া হলো এমন অনেক রোগের সমষ্টি যাতে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্ক তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ডিমেনশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আরও দুটি রোগের নাম হলো আলজাহাইমার ও পারকিনসন। গবেষকরা হৃদরোগ, স্ট্রোক, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, ক্যানসারজাতীয় মারণঘাতী রোগের উৎপত্তি, বিস্তার, কার্যপ্রণালি, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে ইতোমধ্যে বেশকিছু অগ্রগতি অর্জন করলেও তা এখনো সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে বলে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসাবিজ্ঞানী মনে করেন। কারণ এসব রোগের মৃত্যুহার মোটেই হ্রাস করা যাচ্ছে না, বরং দিনদিন বাড়ছে বলেই পরিসংখ্যান তথ্য দিচ্ছে। কিন্তু মস্তিষ্কের কার্যাবলি ও কার্যপ্রণালি নিয়ে গবেষকরা এখনো বেশি দূর এগোতে পারেননি। মস্তিষ্কের কার্যাবলি, কার্যপ্রণালি ও বিভিন্ন রোগ ও তার চিকিৎসা এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছে। ডিমেনশিয়া নিয়ে গবেষণা করা ও এর প্রতিকার খুঁজে বের করা কেন এত কষ্টসাধ্য, তা অতিসহজে অনুমান করা যায়। ডিমেনশিয়া নিয়ে কাজ করতে হলে রোগীর মস্তিষ্ক বের করে এনে তা স্যাম্পল হিসাবে ব্যবহার করে গবেষণা চালাতে হয়।
রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য রক্ত, মলমূত্র ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে স্যাম্পল নিয়ে যেভাবে গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান, রোগীর মস্তিষ্ক নিয়ে সেভাবে গবেষণা চালান সম্ভব নয়। আমরা মস্তিষ্ককে স্ক্যান করতে পারি, কিন্তু সেই পরীক্ষা শুধু মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে আলোকপাত করতে পারে। ডিমেনশিয়ার প্রতিকার বা ওষুধ আবিষ্কার করতে হলে আমাদের জানতে হয় মস্তিষ্কের কোষ কীভাবে আচরণ করে, কীভাবে কাজ করে বা কীভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। সেটা জানার জন্য একজন গবেষকের প্রয়োজন রোগীর জীবন্ত মস্তিষ্কের কোষসমষ্টি এবং তা পাওয়া মোটেই সম্ভব নয়। আসলে বৃদ্ধ বয়সে মস্তিষ্কের কোষে কী ঘটে, কীভাবে ঘটে তার ওপর পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জের কাজ হবে মানুষ কেন এবং কীভাবে বুড়িয়ে যায় তার গুপ্ত রহস্য অনুসন্ধান করা। বিষয়টি যেমন সূক্ষ্ম তেমনই জটিল। তবে গবেষকরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন যে, ক্রোমোজমের প্রান্ত, যাকে টেলোমার বলা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাটো হতে থাকে। তারা কমবেশি এও জানেন, কোনো কোনো কোষের জৈবিক কার্যপ্রণালি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু কোন জৈবিক কার্যপ্রণালি দুর্বল হয় এবং কীভাবে হয়, তা এখনো নির্দিষ্টভাব জানা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে অনেক কিছু এখনো মানুষের অজানা।
শরীরের বাড়তি ওজন বা স্থূলতা এ শতাব্দীর চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য অন্য এক মহা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থূলতার রহস্য জানতে হলে সম্ভবত আমাদের এপিজেনেটিক সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। এপিজেনেটিক হলো এমন একটি বিষয়, যার দ্বারা দূষণ, মানসিক চাপ বা খাদ্যাভ্যাসের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে ডিএনএ-এর পরিবর্তনকে বোঝায়। গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় মা যদি সুষম ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার না খায়, তবে জন্ম নেওয়া শিশুর ওজন খুব কম হয়। পরবর্তী জীবনে এসব শিশু মোটা হয়ে যায় এবং টাইপ-২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়। এর কারণ হতে পারে-এসব শিশুর শরীরের কিছু কিছু জিন সক্রিয় থাকে না, যার ফলে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর উৎপত্তি হয়। কীভাবে জিন কাজ করে এবং পরিবেশগত উপাদানের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তা গবেষণার জন্য অনেক বড় পরিসরের কাজ। এসব সূক্ষ্ম বিষয় জানার জন্য গবেষকদের মন্তব্য হলো, ভ্রূণ সৃষ্টির আরও আগ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। কোনো এক জেনারেশনের ডিএনএ’তে এপিজেনেটিক পরিবর্তন হলে তা পরবর্তী জেনারেশনে স্থানান্তরিত হয়। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের চিকিৎসার মাধ্যমে এ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
বহুল আলোচিত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা মানবসভ্যতাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে এবং সম্ভবত ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছে। তা হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। মাল্টিরেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু অতিদ্রুত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যা মোকাবিলা করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের নেই। অ্যান্টিবায়োটিক তার কার্যকারিতা হারালে মূত্রনালির সাধারণ সংক্রমণ পর্যন্ত মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ানক বিপদ হবে যখন সার্জনরা ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে না পারার ভয়ে অতি সহজ সার্জারি বা অপারেশন পর্যন্ত করতে চাইবে না বা পারবে না। গত কয়েক দশকে জীবাণুর কাছে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি এবং হেরে গেছি। করোনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে জীবাণু জয়লাভ করেছে এবং একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ শূন্যস্থান পূরণে ১৯৮০ সালের পর থেকে সমানতালে আর নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হচ্ছে না, সামনেও হবে বলে কেউ আশাবাদী নয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন আর নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের জন্য পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী নয়।
এ কারণে বিপদ আরও ঘনীভূত হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সারা বিশ্বে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো আমরা ইদানীং অনেক বেশি ভ্রমণ করছি এবং সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি ও আনছি মাল্টিরেজিস্ট্যান্ট জীবাণু। এ ছাড়াও আমরা বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছি, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছি, আবার সেই রোগের জীবাণু নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা যত বেশি অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করব, জীবাণু তত বেশি ও তত দ্রুত রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাবে। আমরা সর্বত্রই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি। কৃষিতে, হাসপাতালে, বাসাবাড়িতে, হাঁস-মুরগিতে, এমনকি পোষা পশু-পাখিতেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, যুক্তিসংগত আচরণের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমিয়ে আনা, এ জীবন রক্ষাকারী ওষুধটির যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা। ইউরোপে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কারণ বহু দেশে অ্যান্টিবায়োটিক কেনা ও বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। গবেষকরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প কিছু একটা খুঁজতে শুরু করেছেন। তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটাই আশা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ওষুধ কোম্পানিগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারে পুঁজি বিনিয়োগ করলে হয়তো আমরা জীবাণুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে পারব। কিন্তু আমাদের পিঠ দেওয়ালে এখনো এমন শক্তভাবে ঠেকেনি যে কোম্পানিগুলো আমাদের রক্ষায় এগিয়ে আসবে। সুতরাং অনিশ্চিত আশাবাদ নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ মুহূর্তে আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
drmuniruddin@gmail.com