ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ
মাহমুদুর রহমান মান্না
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ৫ আগস্ট দুপুরের পর আমাকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ফোন করেছিলেন। ততক্ষণে টেলিভিশনে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর প্রচারিত হয়েছে।
মনের মধ্যে বিপুল উত্তেজনা। কী একটা অসম্ভব আজ সম্ভবে পরিণত হয়েছে। সাইফুল হক বললেন, সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন। কী বলেন?
হাসিনা স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে আমরা যে লড়াই করছিলাম, তাতে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে জোটবদ্ধ হয়েছিল। আমরা ছয়টি দল একটি জোট বেঁধেছিলাম এবং সে জোট গণতন্ত্রের মঞ্চ বলে পরিচিত হয়েছিল। ছয়টি ছোট দল নিয়ে আমাদের এ জোট গঠিত হয়েছিল। জোটের মধ্যে আমরা একটি নিয়ম চর্চা করতাম।
জোটের অভ্যন্তরে যতখানি সম্ভব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু রাখার জন্য আমরা প্রায় সব সিদ্ধান্ত আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করতাম। সেনাপ্রধানের যে প্রস্তাব সাইফুল হক আমাকে জানালেন, সে ব্যাপারেও সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্ন ছিল। কিন্তু তখন কে কোথায় আছে কে জানে! এত তাড়াতাড়ি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব।
সাইফুল হক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবার ফোন করলেন। বললেন, সাকির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। ও অলরেডি ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে। আমাদেরও তো যাওয়া উচিত। কী বলেন? উনি আবারও বললেন, সে একাকী গেলেও তো আমাদেরই যাওয়া হয়ে গেল। মানে গণতন্ত্র মঞ্চের। অন্যদের তো যোগাযোগ করে পাচ্ছি না। আমি আর আপনিই যাই চলেন। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি ছিলাম গুলশান অঞ্চলে। সেখান থেকে বেরিয়ে এক নম্বর চত্বর পার হয়ে সোজা তিতুমির কলেজের দিকে রওয়ানা দিলাম। সোজা গিয়ে ময়মনসিংহ রোডে হাতের বাঁয়ে মোড় নিয়ে ডাইনে রেলক্রসিং পার হলে সোজা জাহাঙ্গীর গেট। কতক্ষণ লাগবে আর। আমি মনে মনে ভাবলাম বড়জোর ১৫ মিনিট। তখন আমার রাস্তা সম্পর্কে এবং ঢাকা মহানগরের মানুষ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না।
তিতুমির কলেজ পার হয়ে যাওয়ার পরই আমি মানুষের ভিড় দেখলাম। প্রথমে হালকা পাতলা। তারপর সে ভিড় হালকা থেকে আস্তে আস্তে বিশাল ভিড়ে রূপ নিল। আমার গাড়ি পেছন দিকে ভিড়ের মধ্যেও একটু একটু করে এগোচ্ছিল। কিছু কিছু মানুষ গাড়ির দিকে দেখছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই আমাকে চিনতে পারল। তারা স্লোগান দিয়ে উঠল। তারপর কাছে এলো। প্রথমে অনুরোধ করল। পরে এক ধরনের উপরোধে গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করল।
নিচে চলতে থাকা জনতার এক বড় অংশ আওয়াজ করে স্লোগান দিল। তাদের মধ্যে অনেকেই এসে আমার সঙ্গে বুক মেলাল এবং হ্যান্ডশেক করতে থাকল। তাদের হাত ধরে টানাটানির একপর্যায়ে আমার হাতে এক ধরনের স্থায়ী ব্যথাও শুরু হলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হলো তা হলো এই যে, ১৫ মিনিটের এ রাস্তায় পৌঁছাতে আমার দুই ঘণ্টা দেরি হলো। জাহাঙ্গীর গেটে পৌঁছানোর পর আমি জানতে পারলাম, সেনানিবাসের ভেতরের সভা শেষ হয়েছে। আমার এখন আর যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
এসব কথা আমার মনে পড়ল ২৪ অক্টোবর রাতে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সজীব রাজ্জাকের পাঠানো একটি ভিডিও ক্লিপ দেখতে দেখতে। এ দিন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা; আসন্ন চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের’ উপায় শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আদর্শ ও বাংলাদেশ রিসার্চ এনালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) যৌথভাবে বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে এ আলোচনার আয়োজন করে।
সরকার যে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তার একটি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ, অন্তর্বর্তী সরকারের আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কেউ কেউ এ আলোচনায় অংশ নেন। কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমান সময়ে এটি একটি হাই প্রোফাইল আলোচনা অনুষ্ঠান। আমার সৌভাগ্য, রাজ্জাক আমাকে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিল। যাতে কেবল অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বক্তব্য ধারণ করা হয়েছিল।
রাজ্জাক যদি আমাকে পুরা অনুষ্ঠানের ভিডিও পাঠাত, তাহলে নিশ্চয়ই বেশি ভালো হতো। আগেই বলেছি, এটি একটি হাই প্রোফাইল অনুষ্ঠান ছিল। বর্তমানে দেশের গণতন্ত্রের যেসব চ্যালেঞ্জ, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বিদগ্ধজনেরা। আমি পত্রিকায় পরদিন সেগুলো পড়ে দেখেছি। কিন্তু আসিফ নজরুলের বক্তব্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
আসিফ খুব খোলাখুলি বলছিলেন, ৮ আগস্ট তারা কোনো বিপ্লবী সরকার গঠন করেননি। অন্যদের মতো তিনিও সেনানিবাসে প্রধান সেনাপতি কর্তৃক আহূত বা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রায় সব দল ও জোটের রাজনৈতিক নেতাদের দেখতে পেয়েছিলেন। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি গণতন্ত্র মঞ্চের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাহলে একটা সরল স্বীকারোক্তি আছে যে, তখন আর মাথায় কোনো বিপ্লবী সরকারের চিন্তা আসেনি।
কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এও বলেছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই সে ধরনের প্রস্তাব আসেনি। এখন অনেকেই যেমন বলছেন যে, তখনই বিপ্লবী সরকার গঠন করা দরকার ছিল, চুপ্পুকে প্রেসিডেন্ট রাখা উচিত ছিল না, তার কাছ থেকে শপথ নেওয়া ঠিক হয়নি, এর চেয়ে জাতীয় শহিদ মিনারে গিয়ে কোনো মেহনতি মানুষের কাছে শপথ নেওয়া ভালো ছিল, এ রকম কথা তখন কেউ বলেননি।
আসিফ নজরুল অবশ্যই সত্য কথা বলছেন। এখানে মিথ্যা কথা বলার তার কোনো কারণ নেই। সে ঐতিহাসিক মুহূর্তকে কেউই হয়তো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। সে রকম তো হতেই পারে। অবশ্য শপথ নেওয়ার সময় আমি শুনেছিলাম লেখক, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার এ রকম কথা বলেছিলেন। তিনি নাকি তার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ না নিতে। তার স্ত্রী অবশ্য সে কথা রাখেননি। ফরহাদ মজহারও এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি করেছেন বলে শুনিনি।
ফরহাদ মজহার লোকটা কেমন? তিনি কি একজন বিপ্লবী? এই যে পনেরো বছর ধরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ছিল, তাতে তার ভূমিকা কেমন ছিল? এখানে এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ নেই। ফরহাদ মজহার একেবারে অপরিচিত লোক নন। তাকে একবার কেউ বা কারা গুম করার চেষ্টা করেছিল।
এক সময় পত্রপত্রিকায় দেখেছিলাম, তাকে ধরে বর্ডারের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল নাকি। তখন তিনি বেশ আলোচনায় এসেছিলেন। এরপর ছাড়া পেয়ে গেলে তিনি বেশ কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন। দম-টম নিয়ে আবার মাঠে এসেছিলেন, কথা বলছিলেন। কিন্তু এ দীর্ঘ লড়াইয়ে কোথাও তিনি নেতৃত্ব বা পরিচালকের ভূমিকায় আসেননি। এ কারণে হয়তো তার কথা তেমন গুরুত্ব পায়নি।
আচ্ছা ৮ তারিখে যদি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বাদ দিয়ে একটি সরকার গঠন করা হতো, সেটা কেমন হতো? তখন কি তাতে আর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থাকত? প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বাদ দিলেই কি সেটি একটি বিপ্লবী সরকার হয়ে যেত? ড. ইউনূস থাকতেন না সেখানে? এখন যারা উপদেষ্টা আছেন তাদের কেউ কি বাদ যেতেন? তাহলে শুধু সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বাদ যাওয়ার কারণেই কি সরকার একটা বৈপ্লবিক চরিত্র পেয়ে যেত?
নিশ্চয়ই এতটা সরল নয় অঙ্কটি। জুলাইয়ের মহান অভ্যুত্থান দেশের সামনে একটি লক্ষ্য হাজির করেছিল। আর সেটা হলো : দেশটাকে বদলে দেওয়ার। নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার। যারাই ক্ষমতায় যেত, তাদের যে নামেই ডাকা হতো, তাদের প্রথম কাজ হতো সংস্কার করে নির্বাচনের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে দেওয়া। পাঠকবৃন্দ, বিপ্লব মানে কেবল লড়াই আর রক্তদান নয়। লড়াইটা করতে হয় জনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে, আর সেজন্যই জীবন যায়। কিন্তু মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজটাকে বদলে দেওয়া, সমাজের গুণগত রূপান্তর সাধন করা। আর এ গুণগত রূপান্তর সাধন করার নামই সামাজিক বিপ্লব।
ফ্যাসিবাদ উৎখাতের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা যদি এ গুণগত পরিবর্তনের কাজটি করতে পারে, তবে সে সরকারকে আমরা নিশ্চয়ই একটি বিপ্লবী সরকার বলব। যারা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করেন তারা মনে করেন, পুঁজিবাদ উৎখাত করে সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার নামই বিপ্লব। আর এজন্যই তারা শ্রেণির প্রশ্নটা নিয়ে আসে। তাদের মতে একশ্রেণির হাত থেকে আরেক শ্রেণির কাছে ক্ষমতা যাওয়ার নামই বিপ্লব। তারা সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এজন্য আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলছি, এ লড়াইয়ের প্রশ্ন তাদের বিপ্লবী বিবেচনার মধ্যে নেই। আমাদের বিপ্লব, বিপ্লবের কর্তব্য এবং বিপ্লবী সরকারের ধারণা তাই তাদের মতো নয়।
জুলাই-আগস্টে যে ঐতিহাসিক আন্দোলন হয়েছে, যার ফলে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের মতো এতটা নিকৃষ্ট, নৃশংস ফ্যাসিবাদের উৎখাত হয়েছে, তাকে অনেকেই বিপ্লব বলছেন। অনেকেই আছেন, এমনকি যারা নিজেদের প্রগতিশীল, বুদ্ধিজীবী, চিন্তক, প্রভাবক বা ইনফ্লুয়েন্সার মনে করেন, তারাও এটাকে বিপ্লব বলেন। কোনো সন্দেহ নেই, এই এত বড় ঘটনাকে বিপ্লব বললে কারও মনে কোনো প্রশ্ন আসবে না।
কিন্তু সময় আসবে যখন, পুরো ঘটনার গুণগত বিশ্লেষণ হবে। তখন পুরো ঘটনার যথাযথ মূল্যায়ন হবে। তখনই বলা যাবে, সে সময় সংবিধানকে মেনে নিয়ে একটি সরকার গঠন করায় কতখানি ভুল বা শুদ্ধ হয়েছে। আরেকভাবেও ইতিহাস আমাদের এ প্রশ্নের জবাব দেবে। অর্থাৎ সময়ই বলে দেবে আমরা আমাদের নিজেদের গুণগত যোগ্যতায় এ সংকট কতখানি কাটিয়ে উঠতে পারব।
ড. ইউনূস একজন আশাবাদী মানুষ। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে তিনি অপরিসীম ক্ষমতা দেখেন। তিনি মনে করেন, অর্গল খুলে দিলে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে।
মাহমুদুর রহমান মান্না : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য