
প্রিন্ট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব ও সংবিধান বিতর্ক

সাইফুল হক
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অবসানের পর থেকে সংবিধান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ নতুন সংবিধান প্রণয়নের কথা বলছেন, কেউ সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন, আবার অনেকেই সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন। রাজনীতিসচেতন মানুষ সংবিধান নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। অনেকেরই এ ব্যাপারে নিজস্ব মতামত রয়েছে, রয়েছে সংবিধান আর রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে নানা প্রস্তাবনা। একটি দেশ ও জনপদের জন্য এ এক ব্যতিক্রমী সময়। উত্তরণকালীন জনআকাঙ্ক্ষার এ অন্তর্বস্তুকে ধারণ করতে পারলে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে সাম্যভিত্তিক গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র-সরকার-সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে।
রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় সংবিধান যে প্রধান দিকনির্দেশক, রাষ্ট্রের আদর্শ-নীতি ও নাগরিক অধিকারের মূল রক্ষাকবচ, সে কারণে সংবিধানকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ওঠাটাই স্বাভাবিক। গত ৫৩ বছরে যারা ক্ষমতায় এসেছেন, সংবিধান ছিল তাদের মনোযোগের প্রধান এক কেন্দ্র। এ কারণে যারা যখন ক্ষমতায় গেছেন, প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা তাদের মতো করে সংবিধান গড়েপিটে নিয়েছেন; দরকার মতো কাটছাঁট করেছেন; নতুন নতুন সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব অগণতান্ত্রিক সুরক্ষাকবচ কোনো স্বৈরতন্ত্রী সরকার ও শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পারেনি। গণরোষ-গণ-অভ্যুত্থানের পথে তাদের লজ্জাজনকভাবেই বিদায় নিতে হয়েছে।
এ পর্যন্ত ১৭ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাসক দল নিজেদের ক্ষমতা নিশ্চিত ও প্রলম্বিত করতেই এসব সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব নিয়ে জনপরিসরে কখনোই তেমন কোনো আলাপ-আলোচনার অবকাশ ছিল না। ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী তার কোনো প্রয়োজনও বোধ করেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধান আরও অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী, সাম্প্রদায়িক ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাবিদ্বেষী চরিত্র গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ তার গত শাসনামলে সংবিধানে এমনও সব সংশোধনী যোগ করেছে, যা কোনোভাবে সংশোধন বা পরিবর্তনযোগ্য নয়। এ ধরনের তৎপরতা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এটিকে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার বর্ম হিসাবেই বিবেচনা করে এসেছে। গেল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, এটি কতটা উদ্ভট ও হাস্যকর। আর এটিও স্পষ্ট, জাতীয় সংসদ যদি এ ধরনের অদ্ভুত অগণতান্ত্রিক ধারা গ্রহণ করতে পারে, তাহলে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংসদ তা বাতিল বা সংশোধনও করতে পারে।
এটি বহুল আলোচিত ও রাজনীতিসচেতন সবার জানা, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের প্রধান আইনি বৈধতার ভিত্তি বিদ্যমান সংবিধান। প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক চরম কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার উৎস বিদ্যমান সংবিধান; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ কতিপয় ধারা প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে জবাবদিহিহীন চরম স্বেচ্ছাচারী অগণতান্ত্রিক আচরণ ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করেছে। বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই গোটা সরকার, সংসদ তথা সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে আসা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতার গত দেড় দশকে বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর এ নির্বাহী ক্ষমতা কাঠামোর অধীনে নিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেঙে পড়া ও অকার্যকারিতার বড় উৎস এখানে।
এলএফও’র অধীনে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সভার নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়েই গণপরিষদ গঠন করা হয় এবং ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। পাকিস্তানের জন্য সংবিধান সভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্থিত একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে পারেন, তা ছিল এক বিস্ময়কর বিষয়। এটি নিয়ে ১৯৭২ সালেই বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া জাতিসত্তায় কেবল বাঙালি পরিচয়সহ সংবিধানের অনেক ধারা নিয়েও তখন বিতর্ক উঠেছিল। কিন্তু তখন বাঙালি আগ্রাসী জাত্যাভিমানের আবেগে এসব আমলে নেওয়া হয়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘আইকনিক’ প্রভাব বিবেচনায় নিয়েই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিহীন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছিল। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে যখন রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা চালু হলো, তখন প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পিত হলো। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী, সংবিধান পরিবর্তন করে যখন আবার প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হলো, তখনো রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আবার প্রধানমন্ত্রীর ওপর অর্পিত হলো; যা পরবর্তী ৩৪ বছরে ধীরে ধীরে এক নিকৃষ্ট সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রের ভয়াবহ উত্থান ঘটাল।
১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গৃহীত সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও তা মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতিরাষ্ট্রের ঘোষণা (Proclamation of Independence)-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে যথাযথ ধারণ করতে পারেনি। গণআকাঙ্ক্ষা ও তখনকার বাস্তবতায় ৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতিকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের শ্রেণিগত গঠন কাঠামো মোটেও এ মূলনীতি বাস্তবায়নের উপযোগী ছিল না। আওয়ামী লীগের দিক থেকে এটি ছিল অধিকার ও মুক্তির জনআকাঙ্ক্ষা সামাল দেওয়ার এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। ‘৭২ থেকে ’৭৫ আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের শাসনেই তার প্রমাণ মিলেছে।
৫ আগস্টের পর সংবিধান নিয়ে উত্তেজনা
৫ আগস্ট ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর প্রায় এক নজিরবিহীন আবেগ ও উত্তেজনার জোয়ার দেখা গেছে। গেল দু’মাসে এ উত্তেজনার পারদ কিছুটা নিচে নেমে এলেও এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে অসংখ্য সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব আলোচনায় অনেকে তাদের ভাষায় ‘বিপ্লবের চেতনায়’ বিদ্যমান সংবিধান ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান প্রণয়নের আওয়াজ তুলছেন। তারা বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান কেন এ সংবিধানের অধীনে ঘটা করে বঙ্গভবনে যেয়ে পতিত সরকারের অনুগত রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিলেন, তা নিয়ে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন। তারা নিজেদের বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করে শহিদ মিনার বা কোনো উন্মুক্ত স্থানে জনতার সামনে অন্তর্বর্তী সরকারকে শপথ নেওয়ার দাবিও করেছিলেন। কেউ আবার এখন সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বলছেন। আর সংবিধান সংশোধনের অসংখ্য প্রস্তাবনা তো আছেই।
নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাবকারীরা ৫ আগস্টের পরিবর্তনকে বিপ্লব হিসাবে বিবেচনা করছেন। আমি ইতোমধ্যে বহু সভায় জানতে চেয়েছি, কথিত এ বিপ্লবের মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি কী, এ বিপ্লবের শ্রেণি সমাবেশ বা শ্রেণিভিত্তি কী, নেতৃত্ব কী, যারা এখন আমাদের সবার সমর্থনে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আছেন, তাদের মধ্যে এসব ব্যাপারে কি বড় দাগের সামান্যতম কোনো বোঝাপড়া আছে? তাদের অধিকাংশ কি এসব চিন্তাভাবনার কাছাকাছি আছেন? ইতোমধ্যে এক ছাত্র প্রতিনিধি বলেছেন, ’৭২-এর সংবিধান নাকি মুজিববাদের সাংবিধানিক রূপ। আর জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান দাবি করেছেন, ‘১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানটি ভারতে বসে রচনা করা হয়েছিল। তাই আমাদের সংবিধান জন্মভূমি হিসাবে বাংলাদেশকে পায়নি’ (প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০২৪)।
এসব উদ্ভট আর অনৈতিহাসিক বক্তব্য নিয়ে কাদের সঙ্গে কী বিতর্ক করব! এ লেখায় এখন এসব নিয়ে আর কথা না বলি। নতুন সংবিধানের প্রসঙ্গে আসি। আগের প্রশ্নগুলোর সঙ্গে যোগ করি। আপনারা যারা নতুন সংবিধান তৈরি করতে চান, আপনারাই বা কারা, আপনাদের পরিচয় কী? আপনাদের ‘অথরিটি’ কী? ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এ গণঅভ্যুত্থানের পুরোধা অংশ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ তাদের গুরুত্বপূর্ণ আট দফা বা নয় দফা কি বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি তুলেছিল? না, তোলেনি। দেশের মানুষ কি নতুন একটা সংবিধানের দাবিতে আন্দোলন করেছে? তা-ও নয়।
তবে অভ্যুত্থানের আগে দাবি তোলা হয়নি বলে গণঅভ্যুত্থানের পরে দাবি তোলা যাবে না, এমন নয়। নতুন অবস্থায় দাবি নিশ্চয়ই যে কেউই, সমাজের যে কোনো অংশই দাবি জানাতে পারেন। তাতে আমি কোনো অসুবিধা দেখিনা। অসুবিধা দেখি এ দাবির বাস্তব ভিত্তি কী, বস্তুগত পরিস্থিতিই বা কী, তা নিয়ে। এ দাবি তোলার সঙ্গে উল্লেখিত প্রশ্ন বা বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।
নতুন সংবিধানের এ দাবির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক কী, বৃহত্তর জনপরিসর, আমাদের বহুত্ববাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমাজের সঙ্গে নতুন সংবিধান রচনার ‘ডিসকোর্স’টা কী- এসব নিশ্চয় জরুরি আলোচনা। যদি ধরেও নেই ৫ আগস্ট একটা বিপ্লব হয়েছে, তাহলে এ বিপ্লবের চরিত্র কী, এ বিপ্লবের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট কী? এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন কোনো শ্রেণি বা রাজনৈতিক গোষ্ঠী কি ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, যারা নতুন সরকার গঠন করেছেন, তাদের শ্রেণি চরিত্র কী, তাদের ক’জনই বা আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনবিরোধী আমাদের ষোল বছরের জানবাজি লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-এসব নিশ্চয় অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নয়।
আর যদি ধরে নেই ৫ আগস্ট একটা বিপ্লব হয়েছে, তাহলে ঘুণে ধরা পোকায় খাওয়া সংবিধানের অধীনে বঙ্গভবনে দলেবলে যেয়ে উচ্ছেদ হওয়া সরকারের রাষ্ট্রপতির কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। দরকার ছিল বিপ্লবের পর বিপ্লবী সরকার গঠন করা এবং বিদ্যমান সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করা। সেই বিপ্লবী সরকারের চেহারা-চরিত্র আবশ্যিকভাবে এরকম হতো না নিশ্চিত করে বলা যায়। এ ধরনের বিপ্লবী সরকার ডিক্রি জারি করে প্রথমেই ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জগতের মাথা থেকে ছা-পোনা সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসত; মেগা দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দুর্বৃত্ত, মাফিয়াদের আইনের আওতায় এনে তাদের অবৈধ আর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করত, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপ্লবী পুনর্গঠন করে বিপ্লবী ধারায় জরুরি ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের কাজ হাত দিত। এরকম অসংখ্য বিপ্লবাত্মক কাজের ফিরিস্তি দেওয়া যাবে।
আপসোস এর কিছুই হয়নি। হওয়ার কোনো বাস্তবতাও ছিল না। তবে দেশের সাধারণ মানুষ যে আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে একটা আমূল পরিবর্তন চায়, তা নিয়ে বোধকরি বড় ধরনের দ্বিমত নেই। কিন্তু তার জন্য বৈপ্লবিক শক্তি ও বিপ্লবী শ্রেণির যে আত্মগত প্রস্তুতি বা ‘সাবজেক্টিভ প্রিপারেশন’-এর দরকার, সে ক্ষেত্রে যে সীমাহীন ঘাটতি রয়েছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট।
ধরে নিলাম আপনারা একটা নতুন সংবিধান লিখলেন, তারপর কী? আপনাদের এ নতুন সংবিধানের খসড়ার ব্যাপারে অন্য অনেকের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত প্রয়োজন হবে; সংবিধান গ্রহণের জন্য সংবিধান সভার নির্বাচন প্রয়োজন হবে। সংবিধানের আদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান ও নীতির বিষয়ে, সংবিধান সভার নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কি একমত হতে পারবে? বাস্তবতা হচ্ছে, এ মুহূর্তে তার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে কোন খসড়া সংবিধান নিয়ে নির্বাচনে যাবেন? সংবিধান সভার নির্বাচনে তো পঞ্চাশটি সংবিধান হাজির হতে পারে। তারপর পরিস্থিতি কী!!
বস্তুগত এ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন সংবিধান প্রণয়নের তৎপরতা প্রধানত আবেগপ্রসূত, খুবই তরল ও অন্তঃসারশূন্য। তবে এর মধ্যে যে একটা পবিত্র সদিচ্ছা রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাহাত্তরের সংবিধান ২০২৪ এসে বহু দিক থেকেই আর মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারছে না-এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের যে রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে উঠেছিল, বাহাত্তরের সংবিধান তার যেটুকু ধারণ করতে পেরেছিল, ৫৩ বছর পর প্রকৃত প্রস্তাবে তা-ও ভেঙে পড়েছে। তার জন্য দরকার নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা, নতুন বোঝাপড়া। এ লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গণতান্ত্রিক সংবিধানের জরুরত নিয়েও প্রশ্ন নেই। দেশে যদি একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব হতো, তাহলে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেত। কিন্তু দেশে কোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লবও হয়নি, বিপ্লবের কিছু উপাদান দেখা গেছে। ইতোমধ্যে তা আবার অনেকটা ম্রিয়মাণ হতেও শুরু হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর আবার দেখা গেল ভাবাদর্শ, রাষ্ট্র-রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে রাতারাতি এক ধরনের ধর্মবাদী তৎপরতার আদিখ্য। এর পেছনে অন্তর্বর্তী সরকার, ঘরে বাইরের নানা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সরকারঘনিষ্ঠদের প্রচ্ছন্ন মদদও লক্ষ করা যাচ্ছে। অথচ গণতন্ত্র মর্মবস্তুর দিক থেকে অসাম্প্রদায়িক। গণতন্ত্রে নাগরিকদের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গীয়, সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তাদের অধিকার ও মর্যাদায় কোনো ধরনের বৈষম্য ও ভেদ-বিভাজনের কোনো অবকাশ নেই। এ সাধারণ বোধ ও উপলব্ধি নিয়েও ঐকমত্য নেই।
এ জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের আড়াইমাস পর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে তাদের প্রত্যাশিত কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বৈদেশিক চাপ মোকাবিলা ও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা গতি আনা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বাকি সেক্টরগুলোতে তাদের এখনো উপযুক্ত ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির লাগামটানাসহ জনজীবনে তারা যদি স্বস্তি আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারেন, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারসহ দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রাথমিক কাজগুলোও নানাভাবে হোঁচট খেতে পারে। আর কোনোভাবে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর যদি দূরত্ব আরও বাড়তে থাকে, তাহলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের ঐকমত্যের পদক্ষেপগুলোও এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
উত্তরণের সম্ভাবনা
রাজনৈতিক দল, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্র-তরুণ থেকে শুরু করে সমাজের সচেতন ও সংবেদনশীল সবাই এখন রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, কেউই আর গতানুগতিক পুরোনো ক্লেদাক্ত অপরাজনীতির ধারায় ফিরতে চান না। গণতান্ত্রিক উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা এখন নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। পরিবর্তনের এ আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা, তাকে বাস্তবায়নযোগ্য জাতীয় রূপ দেওয়া-এটি এখন গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগের বিষয়। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের তাগিদও সামনে চলে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে, ফ্যাসিলেটেটর হিসাবে তারা পরিবর্তন বা সংস্কারের এজেন্ডাগুলোর ব্যাপারে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বহুমাত্রিক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। মতৈক্যের বিষয়গুলো নির্বাহী আদেশেই কার্যকর করার সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন বা কোনো ধারা পুনর্লিখনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পরবর্তী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া দরকার। সংবিধান সংশোধনের এসব উদ্যোগের আশু লক্ষ্য হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শাসনের পথ বন্ধ করে রাষ্ট্র-রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিসর বৃদ্ধি করা। তার বেশি কিছু নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা পার্লামেন্ট ব্যতিরেকে আর কারও জনগণের ম্যান্ডেটসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নেই। যারা এক্ষুনি নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে চান, তাদেরও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সম্মতি নিতে হবে।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি, সাম্য ও ইনসাফভিত্তিক জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য গণতান্ত্রিক সংবিধানের কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাস্তায় হাঁটা দরকার; দরকার তার মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক প্রস্তুতি; সর্বোপরি প্রয়োজনীয় শ্রেণি সমাবেশ, গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক শ্রেণির মেরুকরণ। এর শর্টকাট কোনো পথ নেই; বুদ্ধি করে, লবিং করে বা ফাঁকফোকর দিয়ে কোনো কৌশল করে এটি হবে না। এটি কেবল অতিবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির কাজও নয়। এটি কেবল একটি নতুন দলিল লেখার বিষয়ও নয়, এর জন্য দরকার গোটা সমাজ, তার বিভিন্ন শ্রেণি ও জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন দিক থেকে প্রস্তুত করা। কারণ নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান কার্যকর করার রাজনৈতিক ও শ্রেণিশক্তিকে প্রস্তুত করা না গেলে নতুন সংবিধানের দলিল কেবল একটি কাগুজে বিষয় হয়ে থাকবে। এক্ষেত্রে সারা দুনিয়াদারির অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
আশাজাগানিয়া বিষয় এই যে, এবারকার হার না-মানা গণজাগরণ-গণ-অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সংবিধানের প্রশ্নটি বড় আকারে সামনে নিয়ে এসেছে, অযুত সম্ভাবনার রাস্তাও খানিকটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এখন কাজ হচ্ছে এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র-রাজনীতির জটিল ও পিচ্ছিল পথে ধারাবাহিকভাবে বহুমাত্রিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা।
কার্ল মার্কসের কথা দিয়ে শেষ করি। ‘চরম পরিবর্তন প্রয়াসী হতে হলে জিনিসের শেকড়শুদ্ধ ধরা চাই। মনুষ্যজাতির বেলায় শেকড় হচ্ছে মানুষ নিজেই।’
সাইফুল হক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
ঘটনাপ্রবাহ: রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন
আরও পড়ুন