শতফুল ফুটতে দাও
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রয়োজনীয়তা
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রায় ৫৩ বছর কেটে গেছে। এই ৫৩ বছর জাতির জন্য কম সময় নয়। এ সময়ের মধ্যে যে কাজটি সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল, তা হলো জাতি গঠনের কাজ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে যে কর্তব্যটি সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হয়েছে, তা হলো জাতি গঠনের কাজটি। আমাদের রাজনীতি এতটাই বিভেদাত্মক হয়ে পড়েছে, যার মধ্য দিয়ে জাতি গঠনের প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশকে যারা রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অনেক ইতিবাচক গুণাবলি সত্ত্বেও তারা দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে খুবই ক্ষতিকর সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। আধুনিক বিশ্বে সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারণা প্রাধান্য অর্জন করেছে। ধারণাটি হলো, ইনক্লুসিভনেস। ইংরেজি এই শব্দটির বাংলায় অর্থ হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’। একটি সমাজে নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানা বিশ্বাসের, নানা ভাষার মানুষ থাকতে পারে। জনগোষ্ঠীর একটি অংশ যত ক্ষদ্রই হোক না কেন, যে বর্ণের, যে ভাষার, যে ধর্মের, তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বা অন্তর্ভুক্ত না করে জাতিগঠনের কোনো প্রয়াসই সফল হতে পারে না। এ ধরনের অবজ্ঞা, অবহেলা ও সংকীর্ণতা জাতির একটি অংশকে যে বিচ্ছিন্নতাবোধে, যে অবহেলাবোধ ঠেলে দেয়, তা কখনো সুস্থ ধারায় জাতি বিকাশের জন্য সহায়ক হতে পারে না। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও বেদনাবোধ জাতির অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে কুরে কুরে খায়। এই প্রবণতা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে এবং জাতির মধ্যে বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় দেখা গেছে, বিদেশি শত্রুরাষ্ট্র এই বিভেদের সুযোগ গ্রহণ করে একে সমাধানহীনতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। দেখা দেয় গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাত। গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতের মতো অ-মীমাংসেয় পর্যায়ে না গেলেও শত্রু রাষ্ট্রগুলো এমন একটি জাতি ও দেশের বিরুদ্ধে যে ধরনে প্রচারণার জাল তৈরি করে, তাতে সেই জাতি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়তে পারে। বৃহত্তর সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্নতা এবং বৃহত্তর ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরের বিচ্ছিন্নতা অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ ও সমাজ গঠনের ব্যর্থতার দগদগে দৃষ্টান্ত। উভয় ক্ষেত্রেই শত্রু মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলো এসব রাষ্ট্রকে এ রকম দুঃখজনক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের মতো সমজাতীয় রাষ্ট্র খুব কমই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী এবং ৯২ শতাংশ মানুষ ধর্মের দিক থেকে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এ রকম একটি দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন কোনোভাবেই অসম্ভব ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বৃহত্তর অংশের তুলনায় ভিন্ন, তাদের ভাই বলে একক জাতীয়তার রাষ্ট্রীয় বন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। আমাদের জাতীয় নেতারা দূরদর্শিতার অভাবে অতি ক্ষুদ্র সমস্যাকে প্রায় অমীমাংসেয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমতলের মানুষদের যে দ্বন্দ্ব আমরা এখন দেখতে পাই, তা সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল না। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৬৪ বর্গমাইল এলাকা রাতারাতি পাহাড়ি জনবসতি থেকে জলমগ্ন বিশাল হ্রদে পরিণত হয়। এর ফলে শতসহস্র পাহাড়ি পরিবার নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়। তাদের পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পুনর্বাসনের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা বেপরোয়া দুর্নীতির ফলে ভুক্তভোগী জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছায়নি। এর ফলে এই জনগোষ্ঠী চরম দুর্দশায় পড়ে যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীল পরিবেশের উদ্ভব ঘটেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্যবাসীদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু ভিন্ন জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীগুলো কেন বাঙালি হয়ে যাবে? কেন তারা আত্মপরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে? শেখ মুজিবুর রহমানের এই উক্তি জাতীয় সংহতির সহায়ক না হয়ে জাতীয় বিভেদের জন্ম দিয়েছে। পার্বত্য জনগোষ্ঠীগুলো কমপক্ষে ১২টি নৃ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটি তিন-চারশত পরিবারের বেশি হবে না। সংখ্যার দিক থেকে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, একটি নৃ-গোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র মনে করা মোটেও সংগত নয়। তারা আপন পরিচয়ে সমুজ্জ্বল।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান যখন গৃহীত হচ্ছিল, তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে বলেছিলেন, একজন চাকমা বাঙালি হতে পারে না, একজন বাঙালি চাকমা হতে পারে না। তবে একজন চামকা বাংলাদেশি। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বক্তব্যের সারবত্তা উপলব্ধি করা হয়নি। সুতরাং, পরিণতি যা হওয়ার, তাই হয়েছে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ধারণা চালু করে এই সমস্যার সামাল দিতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনী গড়ে ওঠে। তারা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী পথে পা বাড়ায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই সমস্যার সুযোগ গ্রহণ করে এবং পার্বত্য ত্রিপুরায় শান্তি বাহিনীর লোকজনদের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত করে তোলে। কোনো রাষ্ট্রই তার কোনো অংশে বিচ্ছিন্নতাবাদকে সহ্য করতে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই সশস্ত্র প্রয়াসের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিপ্রয়াসের পথে হাঁটতে হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। শুধু তাই নয়, জনমিতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সমতল থেকে গরিব মানুষদের তুলে নিয়ে পাবর্ত্য এলাকায় বাঙালি বসতি তৈরি করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশই এ ধরনের সমস্যার সমাধানে বসতির নৃতাত্ত্বিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বাঙালিদের নিয়ে বসতি গড়ে তোলার যে পদক্ষেপ নেওয়া হলো, তাতে নতুন এক সমস্যার উদ্ভব হলো। সেটি হলো, ভূমি সমস্যা। পার্বত্য এলাকার চিরায়ত জুম চাষভিত্তিক জমির গোষ্ঠীগত মালিকানার মধ্যে অ-উপজাতীয়দের পরিচিত জমির ব্যক্তি মালিকানার প্রবেশ ঘটল। এর ফলে ভূমির মালিকানা নিয়ে জমি সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। একটি সমস্যার সামাল দিতে গিয়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে ভয়ানক রকমের জটিল হয়ে উঠল। এই জটিলতা থেকে বের হওয়ার সুযোগ ক্রমান্বয়ে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হতে থাকল। আজ পর্যন্ত পার্বত্য এলাকায় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সমতল ও পার্বত্য এলাকার মধ্য পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করে পার্বত্য এলাকাগুলোকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তোলা। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তার প্রতি মর্যাদা দিয়ে এগুলোকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। পার্বত্য এলাকার অর্থনীতিকে বহুমুখী করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং সে অঞ্চলে নতুন নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ সমস্যার সমাধানে অনেক অবদান রাখবে। এ ছাড়া পার্বত্যবাসীদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে রাষ্ট্রের মূল সংহতিবোধ আরও মজবুত হবে। আসল কথা হলো, সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে বিশাল ধরনের রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও দেশ গঠনে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার মূলে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর স্লোগান তোলা হলো ‘এক নেতা এক দেশ-বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। আমাদের দেশ গঠনে শুধু একজন নেতার কথা বলে বিরাট ভুল করা হয়েছে এবং অন্য জাতীয় নেতাদের অবদানকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয়েছে। কোনো দেশে জাতীয় আন্দোলন শুধু এক নেতাকেন্দ্রিক হয় না। ছোট-বড়, মাঝারি সব ধরনের জাতীয় নেতা জাতীয় চেতনা গড়ে তুলতে অবদান রাখেন। ইতিহাসে নিুবর্গের প্রবক্তাদের বক্তব্য হলো, জাতীয় পর্যায়ে যেসব বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মূলে রয়েছে অসংখ্য মানুষের মুক্তি অর্জনের জন্য ছোট, বিচ্ছিন্ন এবং খণ্ড খণ্ড অনেক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গই একসময় বিশাল দাবানল সৃষ্টি করে। ২০২৪-এর আগস্ট অভ্যুত্থান শুরুতে ছিল কোটা সংস্কারের একটি নিরীহ, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। ঘটনাবলির ঘাত-প্রতিঘাতে এই আন্দোলন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাতের আন্দোলনে পরিণত হয়। শেখ হাসিনাও প্রচণ্ড আত্মম্ভরিতায় বলতেন, আমি এই করেছি, আমি ওই করেছি। তার উচ্চারণে কখনই ‘আমরা’ বা ‘আমাদের’ কোনো স্থান ছিল না। অথচ এদেশে যা কিছু হয়েছে, তার জন্য অবদান রেখেছে এদেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সন্তান। সাধারণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য তার জন্য বয়ে এনেছে ভয়াবহ পরিণতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গুম, খুন, জেল-জুলুম ও আয়নাঘরের নিষ্ঠুর অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন। এগুলোর সবকিছুই বিশাল সমজাতীয় বাংলাদেশিদের বিভক্ত ও পরস্পরবিরোধী শিবিরে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশ ও জাতির সামনে আগামী দিনের বিশাল করণীয় হলো, সবদিক থেকে দিশেহারা বাংলাদেশি জাতিকে নতুন দিশা দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ