শিক্ষা সমাজ দেশ
‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা?’
ড. হাসনান আহমেদ
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘আমি তাই, আমি তাই গো, তোমার পরান যাহা চায়’-কথাটা একটু ঘুরিয়ে লিখলাম। দেখলাম, কেমন শোনা যায়। এমনটি হতে পারলে কারও সঙ্গে কোনো বিবাদ থাকে না। কিন্তু তা হওয়া কি কখনো সম্ভব? তাহলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধই বা থাকে কোথায়? তাছাড়া আমার চিন্তা-ঘুড়ি আমৃত্যু মুক্ত আকাশেই উড়বে, নাটাই আমি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে জিম্মায় রাখি না, এটা সত্য হয় কী করে? পত্রিকায় মুক্তভাবে লিখতে গিয়ে অনেকের কাছ থেকে অনেক খারাপ কথা শুনতে হয়, পতিত সরকারের আমলে অনেক বেশি শুনেছি। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছে। এটা কখনো আবার পত্রিকার ইজমের ওপর নির্ভর করে বলে শুনি। তবুও না মানি পরাভব, তবুও লিখি। যুগান্তর এ মনোভাবের ব্যত্যয় ভেবেই স্বাধীনভাবে দীর্ঘদিন লিখে চলেছি। কারণ দেশের জন্য দীর্ঘদিন থেকে সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে অব্যবহিত আগপর্যন্ত আমরা ব্যক্তি ও শক্তি পূজার বেদিতে নিজের মন ও চিন্তা-চেতনাকে উৎসর্গ করেছি; বলা যায়, অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ব্যক্তি বা দলীয় পর্যায়ে হলেও কোনো বহুল প্রচারিত জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকার এমন বাঁধাধরা কোনো ইজম থাকা উচিত নয়, যা লেখকের মুক্ত চিন্তাকে ভোগায় বা নিয়ন্ত্রণ করে, যদিও এদেশে তা আছে। দীর্ঘদিন কোনো দেশে মত বা সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেলে এমনটিই হওয়ার কথা। আমরা তখন দমননীতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। নিজের অজান্তে অন্তরে দানবীয় মনোভাব গড়ে ওঠে। সবার লেখাই যে আমার ভালো লাগা রাজনৈতিক দল ও পছন্দের শক্তির সঙ্গে মিলতে হবে, এমন কি কোনো কথা আছে? কোনো জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকার ক্ষেত্রে এমন মনোভাব থাকা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। এদেশের অধিকাংশ পত্রিকা ও পত্রিকার পেছনে কাজ করা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এমন স্বেচ্ছাচারী মনোভাব গড়ে ওঠা অমূলক নয়। কোনো ভিন্নমত এরা সহ্য করতে চায় না। ভাবখানা এমন-‘তাহাই সত্য, আমি রচিব যাহা’। এতে পরিশেষে তাদেরই ভুগতে হয়; বুঝি, ব্যবসাবিজ্ঞানে তারা অতটা পারঙ্গম নয়, যতটা আত্মশ্লাঘায় নিমজ্জিত। তাই আমরা এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। চিন্তাধারার অসারতাকে এরা ধারণ করতে অপারগ। এতে প্রকাশনা ক্রমেই দলীয় পত্রিকায় রূপ নেয়। এটাকে মানসিক দীনতাও বলা যেতে পারে। এদেশের এ বিকৃত রাজনীতি ও দলবাজি এবং জনগোষ্ঠীর শতধা বিভাজনই সব পশ্চাদগামিতা ও অনগ্রসরতার মূল; এর সঙ্গে দলীয় উগ্রতা। অন্তত সমাজবিজ্ঞানীরা তাই-ই বলবেন। দেশের উন্নয়ন ও শিক্ষাক্ষেত্রেও আমরা একই রোগে ভুগছি। শিক্ষাধারারও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। স্বাধীনতা ও উন্নয়ন কথা-দুটি আজ বিজ্ঞাপন আকারে ব্যবহৃত হতে দেখছি।
জাতীয় স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে একজোট ও সমমনোভাবাপন্ন না হতে পারলে দেশের উন্নতি সুদূরপরাহত। বর্তমান সময় নীরবে এসব কথা বলে। সময়ের ভাষা আমরা কান পেতে শুনতে পাই কি? আমরা জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থের নিগড়ে সব কর্মকাণ্ডকে বেঁধে ফেলেছি বলেই তেপ্পান্ন বছর পরও আজকের এই পরিণতি। দেশ নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্য এটাও একটা চিন্তার খোরাক। আমার মনে হয়, অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করারও এটাই একটা বড় অনুকূল ব্যবস্থা ছিল। তখন দলমত নির্বিশেষে আটানব্বই শতাংশ জনগোষ্ঠী একজোট হয়ে একটি উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে দলবদ্ধভাবে এগোতে পেরেছিল। এ ফ্যাক্টরটা আমরা অনেকেই উপেক্ষার চোখে দেখে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ক্ষমতাধর শক্তিকে স্বাধীনতা অর্জনে বড় করে দেখি। জাতীয় জীবনে কখনো কখনো এমন ক্রান্তিকাল আসে, যখন দলমত নির্বিশেষে সম্মিলিত শক্তিকে একত্রিত ও কর্মে নিযুক্ত হতে হয়। বিষাক্ত ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গকে কেটে নিরাপদ কোনো জায়গায় মাটিচাপা দিতে হয়। সবই প্রকৃতি ও সময়ের প্রয়োজনে। নইলে জীবন ও প্রকৃতির কাছে জনগোষ্ঠীকে অচিরেই ভুগতে হয়। উপযুক্ত সময় কোনো মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে না।
অনেক জায়গায় লিখেছি, উন্নয়ন মানে জনগোষ্ঠীর মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন, কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়। কয়েকটি বিভাগের সংস্কারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার মনোযোগী হয়েছে, এটা ভালো। আমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করি না। তবে এটাই যে সব, একথা ভাবা ঠিক হবে না। এ নিয়েও আমি এ কলামেই অনেক কথা লিখেছি। কদিন আগে এ পত্রিকায়ই লিখেছিলাম, হলুদ খেলেই রাঙা ছেলে হবে, এটা বিশ্বাস করা যায় না। কারণ আমি জানি প্রত্যেক বিভাগের মাথা থেকে পা পর্যন্ত পচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। শুধু মুখের কথায় কাজ নয়। নিয়ম পরিবর্তন করে কী করবেন? অন্তর্বর্তী সরকারে ভালো লোক বসিয়ে কী করবেন? যাদের দিয়ে কাজটা করানো দরকার, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মনোযোগ দিয়ে নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করবে না, দোষ গিয়ে পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে। সংস্কার হয় কাগজে-কলমে, বাস্তবায়ন করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যক্তিরা। তাদের যদি ‘মুখে মধু, পেটে বিষ’ থাকে! কর্মরত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মগজ পরিবর্তন দরকার। তা কি সহজে সম্ভব? প্রতিটি পদে সুস্থ চিন্তাশীল, দেশপ্রেমী, সৎ ব্যক্তির অবস্থান দরকার। যদিও একশ ভাগ ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। অন্তত ষাট থেকে সত্তর ভাগ ক্ষেত্রে তা যে কোনো মূল্যে করতে হবে। একাকী কোনো কাজ, যত চেষ্টাই হোক না কেন, করা যায় না। দরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগের আন্তরিক সংশ্লিষ্টতা, কাজ বাস্তবায়নের সদিচ্ছা, জনসাধারণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। সেজন্যই হিউম্যান রিসোর্স পড়াতে গিয়ে হিউম্যান ফ্যাক্টরের কার্যকারিতা আমি এভাবে বলি, ‘মন না রাঙিয়ে বসন রাঙিয়ে কি করিলি ও রে যোগী’! মন না রাঙিয়ে শুধু বসন রাঙালেই কাজ হয় না। হিউম্যান ফ্যাক্টর বিশ্লেষণ তা বলে না। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আমাদের সমুদ্রের কতদূর পর্যন্ত চোখ যায়? একটা মানুষের বাইরে থেকে ততটুকুই আমরা দেখি। মানুষ একবার অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার আর ফেরার কোনো পথ থাকে না। এ তো কোনো মোটরবাইক নয় যে, প্রয়োজনে ইঞ্জিনটা বদল করে ফেললাম। চরিত্র হারালে জীবনের মতো একবারই হারায়। টাকা হারালে কষ্ট করে ফেরানো যায়, কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য? এদেশের রাজনীতিকদের, আরেকটু বাড়িয়ে বললে, পতিত সরকারের এটাই একটা বড় কুলকলঙ্কী ও শ্রীভ্রষ্ট অবদান, যা যুগ যুগ ধরে দেশকে বইতে হবে। দীর্ঘদিন সামাজিক সুশিক্ষা দিয়ে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানবিক গুণাবলি-সঞ্চারক শিক্ষা চালু করে পর্যায়ক্রমে এ কলঙ্ক ঘোচাতে হবে। আবার দেশ পরিচালকদেরও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। এর কোনো বিকল্প আমি দেখি না। সে রকম মানসিকতার জন্ম নিতে হবে।
আমি অল্প পরিসরে কয়েকটা বাস্তব উদাহরণ দেব, যা আইন সংস্কারে দূরীভূত হবে না। যুগান্তরে পড়লাম, ‘ধামরাইয়ে পূজায় বরাদ্দ চাল কালোবাজারে বিক্রি পানির দরে’ (১২.১০.২৪)। এমন ঘটনা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ; যা দিনে দিনে অলিখিতভাবে ‘জায়েজ’ হয়ে গেছে। এর বিস্তার আরও ব্যাপক। থামাবেন কীভাবে? আইনটা একবার বলুন তো? দেশব্যাপী যে কোনো হাট-বাজার, বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ড, নেশার বাজার-রাজনৈতিক বখরা আদায় অবিরাম চলছে। যারা রক্ষক, তারাও ভক্ষক। ঠেকাবেন কীভাবে? যেদিন বিগত সরকারের পতন হলো, তার ৪ দিন পর বাজারে গেলাম। মুরগির দাম কম। দোকানদার পরিচিত হওয়ায় কারণ জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, ‘আগে মুরগির ফার্ম থেকে মুরগি কিনে পথে উঠতে গেলেই পোশাকধারী বাহিনীকে ঝুড়িপ্রতি নির্ধারিত হারে বেশকিছু টাকা দিতে হতো, দোকানে বসে বিক্রি করার আগেই স্থানীয় রাজনীতিকদের পোষা মাস্তানদের নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হতো। সেটাও কম নয়। বেশি দামে বিক্রি ছাড়া পথ থাকত না। আজ কদিন থেকে কোথাও টাকা দিতে হচ্ছে না, তাই কেজিপ্রতি ৩০ টাকা কমে বিক্রি করতে পারছি।’ গ্রামের বাজার থেকে কিনে ট্রাকভর্তি শাকসবজি ঢাকায় আসে। ট্রাক ভাড়া ছাড়াও পথে বাড়তি কত খরচ রাজনৈতিক মস্তান ও পোশাকধারীদের পকেটে যায়, কেউ কোনোদিন হিসাব করে দেখেছেন কি? ব্যবসার প্রায় পণ্যেই সিন্ডিকেট করে দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়। কাকে দোষ দেবেন? সরষের মধ্যে ভূত। টাকা বেশি যাচ্ছে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে; দেখার কেউ নেই। বেশি চ্যাঁচামেচি করলে একদিন অভিযান চালিয়ে ক্যামেরাবন্দি করে টিভিতে দেখিয়ে দেবে, তারা সক্রিয়। দুঃখের কথা বলবেন কাকে?
সরকারি-আধা সরকারি এমন কোনো অফিস চোখে পড়েনি, যেখানে অবৈধ টাকার লেনদেন হচ্ছে না। কোথাও হাজার হাজার, কোথাও লাখ লাখ। সেখানকার মানুষ বাদেও প্রতিটি চেয়ার-টেবিল, এমনকি দেওয়ালও টাকা খাওয়ার জন্য হা করে বসে থাকে। ব্যতিক্রম হয়তো আছে; তা দিয়ে সমাজ চলে না। বরং বলা যায়, ব্যতিক্রমী মানুষগুলো খুব মানসিক চাপে ও কষ্টে আছেন। এই আমার অতি স্বপ্নের সোনার বাংলার দশা! করণীয় কী? লিখতে গেলে এমনই শত শত বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করা যাবে, যা নিয়ে আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপন। এর থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন কিছু নয়, তবে সময়সাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালকদের আগে ভালো হতে হবে; মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নেতা ও কর্মীদের কোনো অন্যায় কাজকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক আদর্শের কথা আপাতত দূরে রেখে নির্বাচনের আগে দফাভিত্তিক কর্মসূচি ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচনের পরও প্রচারিত কর্মসূচি মেনে চলতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেশ পরিচালনা ও দলীয় স্বার্থ ভুলে দেশ উপকৃত হয় এমন সংস্কারের কাজে আন্তরিক সহযোগিতা করতে হবে। সুস্থ চিন্তাভাবনা ও সৎ মনোভাব নিয়ে দেশ পরিচালনা করলে এদেশ উন্নত হতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না বলে আমার বিশ্বাস। তবে এ দেশে দেখানো পথ অনুসরণ করা লোকের বড্ড অভাব; দূরদর্শী সঠিক নেতৃত্বেরও অভাব। শুধু অভাব নেই উটকো মাতব্বরের।
অধ্যাপক ড. হাসনান আহমেদ এফসিএমএ : সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ