শতফুল ফুটতে দাও
ডিম সংকটের সমাধান কী?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের অগ্নিমূল্য সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রায় অচল করে ফেলেছে। বাংলাদেশে যে পরিসংখ্যান সরকারের তরফে দেওয়া হয়, তা নির্ভরযোগ্য নয় বলে অনেকেই মনে করে। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রীর মূল্যস্ফীতির তুলনায় বেশি। আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা সূচিত হয়েছিল।
সরকারের কোনো প্রচেষ্টাই এ মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে পারেনি। মানুষকে বোকা বানানোর জন্য পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ডাবল ডিজিট হতে দেয়নি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, মূল্যস্ফীতি অবশ্যই দুই অঙ্কের উপরে অবস্থান করছে। জনজীবনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করছি। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধি পায়নি।
ফলে এসব শ্রেণির মানুষ অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছে। নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি সম্পর্ক আছে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে যদি কোনো ধরনের বড় রাজনৈতিক ইস্যু যুক্ত হয়, তাহলে রাজপথে বিক্ষোভ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সুতরাং যে কোনো সরকারকে দ্রব্যমূল্যের বিষয়টির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সাধারণ মানুষের জন্য বাজারের অভিজ্ঞতা সুখপ্রদ ছিল না। সরকারের কঠোর শাসন মানুষের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত হওয়া থেকে বিলম্বিত করতে পেরেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এমনভাবে সরকারের পতন হয়েছিল যে, সরকারপ্রধানকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। সরকারের অনেক মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্য হয় আত্মগোপনে চলে গেছে অথবা পার্শ^বর্তী দেশে পালিয়ে গেছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ লৌহকঠিন শাসন চালিয়েছিল, সেই পুলিশ বাহিনী ৫ আগস্টের পর লাপাত্তা হয়ে যায়। আমাদের দেশে অতীতেও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সেসব গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনী কর্মস্থল ত্যাগ করে পালিয়ে যায়নি। অথচ এবার আমরা দেখলাম ৫ আগস্টের পর পুলিশ কর্মস্থল থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। এবারের গণঅভ্যুত্থান আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে, নিপীড়ন ও অত্যাচার করে শাসনক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, কিন্তু চিরস্থায়ী করা যায় না। অত্যাচার-নিপীড়নের সঙ্গে যদি মূল্যস্ফীতি যুক্ত হয়, তাহলে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রতিবেশী দেশ থেকে পুলিশ আমদানি করে শেষ রক্ষা হয় না।
ডিম এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে আছে। ডিম আমিষ ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। খাওয়ার জন্য মাছ-মাংস জোগাড় করতে না পারলেও ডিম ও ডাল দিয়ে ক্ষুধা পূরণ করা সম্ভব। অবশ্য ডালের দামও বেড়ে গেছে গত কিছুদিনের মধ্যে, বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম প্রতি ডজনে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। টিসিবির তথ্য থেকে জানা যায়, গত ৮ আগস্ট ডিমের দাম ছিল, ডজন প্রতি ১৫০ থেকে ১৬২ টাকা। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিমের দাম বাড়তে থাকে। ধাপে ধাপে বেড়ে তা ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। কখনো কখনো দাম ওঠে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। ২০২২ সালের আগে বছরজুড়ে ডজন প্রতি ডিমের দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকায় উঠানামা করত। ডিমের দাম কমানোর জন্য সরকার বাজারের অভিযানে নেমেছে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল আসেনি। পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ অথবা কমিয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তবাজারে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাজারে হস্তক্ষেপ করলে হিতে বিপরীত হয়। উৎপাদন পর্যায়ে ডিমের খামার কারও একচেটিয়া ব্যবসা নয়। দেশে শত-সহস্র ডিমের খামার রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে খামারের ভিত্তিতে দেশে ডিমের উৎপাদন শুরু হয় গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের প্রথমদিকে। ডিমের বাণিজ্যিক খামার উদ্ভবের পাশাপাশি গ্রামের গৃহস্থরা ক্ষুদ্র আকারে ঘরোয়াভাবে মুরগি পালন করে ডিমের যে উৎপাদন করত, তা বাণিজ্যিক খামারের অভিঘাতে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে গেছে।
ডিমের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খামারিরা উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধি এবং সরবরাহ সংকটকে দায়ী করছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ দুটি সমস্যা সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি (সূত্র প্রথম আলো)। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ৮ অক্টোবর ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ সংকট বড় কারণ। দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি। আগে দিনে সাড়ে চার-পাঁচ কোটির মতো ডিম উৎপাদন হতো। এখন ৩ কোটির বেশি উৎপাদন নেই। উৎপাদন হ্রাসের ফলে সরবরাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য ভেঙে পড়ায় বাজারে ডিমের দামের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয়। স্বল্পমেয়াদে সরবরাহ বৃদ্ধির একটি উপায় হলো বিদেশ থেকে ডিম আমদানি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ অক্টোবর সাড়ে ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। ডিমের দৈনিক চাহিদার বিচারে সাড়ে ৪ কোটি ডিম আমদানি করে সংকটের কতটুকু হেরফের হবে, তা অনুমান করা যায়। ডিমের মতো পণ্যের খামারিদের স্বার্থে ডিমের আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা হয়। যেহেতু ডিমের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তাই ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমদানি শুল্কের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কথা এখনো জানা যায়নি। আশা করা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে অচিরেই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে সাশ্রয়ী মূল্যে পোলট্রি ফুডের সুলভ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য দেশের ভেতরে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক নীতিকৌশল অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া বিদেশ থেকেও সুলভ মূল্যে পোলট্রি ফিড আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন কেন কমে গেল এবং পোলট্রি ফিড কেন দুর্মূল্য হয়ে উঠল, এসব ব্যাপারে দ্রুত অনুসন্ধান ও গবেষণা করে লাগসই নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে। ডিমের ব্যাপারে শেষ কথা হলো, সরবরাহ বাড়াতে না পারলে ডিমের দাম কমানো সম্ভব হবে না। সরবরাহ কম থাকলে সুযোগসন্ধানীরা বাজারে নানা ধরনের কারসাজি করতে পারে। সেক্ষেত্রে অভিযান চালিয়ে সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়। নির্ধারণ করে দেওয়া দাম অনুযায়ী উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের মূল্য ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ০১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে ১ ডজন ডিমের দাম হওয়া উচিত ১৪২ টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছিল। তবে পোলট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন আলোচনা করাটা যথেষ্ট নয়, দাম নির্ধারণ করতে উৎপাদন খরচ নিয়ে গভীর গবেষণা করতে হবে।
নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে। এসব পদক্ষেপের পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার তেজগাঁওয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ডিম বিক্রি বন্ধ রাখছে আপাতত। এসব ব্যবসায়ীর বক্তব্য হলো, নির্ধারিত দামে কিনতে পারলে নির্ধারিত দামে বিক্রি করা যায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে অভিযান চালানোর প্রতিক্রিয়ায় তারা ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। একই ধরনের খবর পাওয়া যাচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারে ৫টি আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন আড়তদাররা। তাদের সাফ কথা হলো, যতদিন সরবরাহকারীরা সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ডিম সরবরাহ করবে না, ততদিন তাদের আড়তও বন্ধ থাকবে।
অর্থনীতিশাস্ত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে Policing cost বলে একটি কথা আছে। সব পণ্য বাজারের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছায় সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে। সাপ্লাই চেইনে অনেক স্তর থাকতে পারে। সাপ্লাই চেইনের স্তরগুলোর সংখ্যা অনেক এবং সেগুলো বহুধাবিস্তৃত। প্রতিটি স্তরে দেখভাল করতে না পারলে সার্থকভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব হয় না। এ রকম নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, যা নিয়ন্ত্রণের মূল্য উদ্দেশ্যকেই পরাভূত করে। সুতরাং যে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে দামের বিষয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কাম্য লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আড়তে বিক্রি বন্ধ থাকায় কিছু কিছু বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। গত সোমবার দুপুরে দেখা গেছে, ঢাকার কারওয়ান বাজারে বেশির ভাগ দোকানে ডিম নেই। একটি দোকানে কিছু ডিম ছিল, তা তাৎক্ষণিকভাবেই বিক্রি হয়ে যায়। দোকানটির ডিমবিক্রেতা সংবাদপত্রের প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘ফার্মের মুরগির যে ডিম দেখছেন, তা গতকালের (রোববার)। তাও কাঁঠালবাগান বাজার থেকে আনা হয়েছে। তেজগাঁও ডিমের আড়ত থেকে গত দুদিনে কোনো ডিম কিনতে পারিনি।’ জানা গেছে, কিছু আড়তে কেনাবেচা বন্ধ থাকলেও বিকল্পভাবে ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে চড়া দামে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় ডিমের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিম এখন শুধু ধনীদের খাদ্য নয়। এটি এখন গরিব মানুষের খাদ্য তালিকায় বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। এ খাদ্যপণ্যটির দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার ফলে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। ২-৩ বছর আগেও দেশে ডিমের উৎপাদন ও চাহিদা সমানুপাতিক ছিল। ডিমের উৎপাদন বড় অঙ্কে হ্রাস পাওয়ার ফলে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে ডিমের সরবরাহ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। একদিকে সরবরাহ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার জন্য লাগসই নীতিকৌশল গ্রহণ করতে হবে। বাজারে হস্তক্ষেপ নয়, বাজারকে সচল ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করে রাখতে পারলে সমাধান আশা করা যায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ