স্মরণ
এমএ সামাদ: বিমা পেশার পথিকৃৎ
আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শ্রেষ্ঠ ও উত্তম ব্যক্তি তিনিই, যার কর্মকে আমরা প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। হ্যাঁ, শ্রদ্ধেয় মরহুম এমএ সামাদ সত্যিকার অর্থে আমাদের কাছে এক শ্রেষ্ঠ ও উত্তম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দেখতে দেখতে আজ তার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী চলে এলো, কিন্তু এখনো তার সেই আদেশ, উপদেশ, শাসন, মায়া-মমতা আমাদের মানসপটে সজীব ও অম্লান হয়ে আছে। আজও আমরা আমাদের প্রতিটি কর্মে তার শূন্যতাকে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করি।
এমএ সামাদের অন্তর ছিল বিশাল ও সমৃদ্ধ। তাই তিনি যে কোনো ভালো ও সুন্দর কাজের উচ্চ প্রশংসা করতেন, সেই সঙ্গে ভুল কাজের জন্য কঠোর শাসন করতেন, কিন্তু সেই শাসনে থাকত সফল হওয়ার দিকনির্দেশনা। তিনি তার মোহনীয় ব্যবহার দ্বারা অতি সহজে অপরকে আপন এবং স্বাভাবিক করে নিতেন। আজ আমরা বিমা জগতে যেটুকু পরিচিতি পেয়েছি, তা এমএ সামাদের আদেশ, উপদেশ ও শাসনের দ্বারাই। সত্যিকার অর্থে আমার বিমা কর্মী হওয়ার পেছনে তার প্রেরণা ও উৎসাহ সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে।
চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে তিনি যেসব আদেশ-উপদেশ দিতেন, তা সত্যি ছিল অদ্বিতীয়। তার প্রতিটি সিদ্ধান্তে থাকত বাস্তবতা, যুক্তি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানবতা। তিনি ছিলেন এমনই একজন প্রশাসক, যার কাছে ছিল না সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্বতা, যার ব্রত ছিল যে কোনো কাজ যত দ্রুত সম্ভব সঠিকভাবে সম্পন্ন করা। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যার আদেশ ও উপদেশ আমরা নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে পালন করতাম। এমন একজন ব্যক্তিকে আমরা এত তাড়াতাড়ি হারাব, তা আমাদের কল্পনাতেই আসেনি। এখনো আমাদের চিন্তা-চেতনায় তার সান্নিধ্য আছে এবং থাকবে।
তিনি আমাদের এত অধিকার দিয়েছিলেন যে, আমরা যে কোনো প্রয়োজনে যখন-তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতাম এবং আমাদের একটি বিশ্বাস জন্মেছিল, যে কোনো সমস্যার সমাধান আমরা তার কাছে পাবই। এমন বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। মনে পড়ে কর্মজীবনের শুরুতে সেই অমূল্য উপদেশ-‘যখন তুমি কোনো গ্রাহকের কাছে যাবে, তখন তুমি বিজিআইসির প্রতিনিধি এবং যখন পলিসি পাবে, তখন তুমি বিজিআইসির ব্যবস্থাপনার কাছে গ্রাহকের প্রতিনিধি।’
তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় ১৭ অক্টোবর ২০০৫ সালে, দুপুরবেলা। আমি অফিসের কাজে বাইরে ছিলাম। নাসরিন আপা মোবাইলে ফোন করে বললেন, ‘আপনি অফিসে এসে চেয়ারম্যান স্যারকে ফোন করেন, স্যার আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।’
আমি অফিসে এসে তার সঙ্গে কথা বললাম, তিনি প্রথমে আমার, আমার পরিবারের সবার কথা জিজ্ঞাস করলেন এবং আমার সবাই ভালো আছি কিনা জানতে চাইলেন। আমিও তার শরীর-স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলাম। তিনি বললেন অনেক ভালো আছেন। তারপর বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আলাপ হয়। পরে বলেন ঈদের পরে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে, কিছু অফিশিয়াল বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করবেন। আমি বুঝতে পারিনি তার সঙ্গে সেদিনই ছিল আমার শেষ কথা। তার সঙ্গে আর দেখা হলো না, কিন্তু এখনো তার সেই শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর আমাকে প্রতিনিয়ত আবেগাপ্লুত করে তোলে। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া, মৃত্যুর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাওয়ার্ড উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে কয়েকদিনের জন্য তার সান্নিধ্য পেয়েছিলাম।
জীবনে চলার পথে অনেক সময় ব্যক্তিবিশেষ আদর্শ হয়ে থাকেন, যাকে আমরা অনুসরণ বা অনুকরণ করে থাকি। তার মধ্যে অন্যতম বিজিআইসির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যান মরহুম এমএ সামাদ। একজন সফল প্রশাসক হিসাবে তার যে বৈশিষ্ট্য ছিল, তা এখনো আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে অনুসরণ করি। তার সেই সুচিন্তিত ও দূরদর্শিতাপূর্ণ প্রশাসনিক আদেশ ও উপদেশ আমাদের কর্মে অকল্পনীয় গতি সঞ্চালন করত এবং আমরা উজ্জীবিত হতাম। সফলতার জন্য কর্মে আত্মনিয়োগ ও মনোনিবেশ করতাম। তার প্রশাসনিক আদেশ ও উপদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, ভবিষ্যতে কী সফলতা আসবে তার ওপর ভিত্তি করে তিনি বর্র্তমানের আদেশ ও উপদেশ দিতেন।
মনে হয় সেই দিনের কথা, আমি এবং আমাদের চট্টগ্রাম জোনের দুজন উন্নয়ন কর্মকর্তা জনাব ফরিদ ও জনাব কাশেমকে নিয়ে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে একটি ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে গিয়েছিলাম। তখন গাড়িতেই তারা দুজন তাদের দুটি মোটরসাইকেল প্রদানের বিষয়টি এমএ সামাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য অনুরোধ জানাল। তাদের অনুরোধে তখনই আমি তার সঙ্গে মোবাইলে আলাপ করি। সেসময় তাদের দুজনেরই প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১২ লাখ টাকা। এমএ সামাদ প্রথমেই তাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ জানতে চাইলেন এবং আমিও তাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের কথা বললাম। তারপর প্রশ্ন রাখলেন ‘তোমার কি মনে হয়, মোটরসাইকেল দিলে তাদের ব্যবসা পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে?’ আমি বললাম, ‘স্যার, অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে, কারণ তাদের যোগাযোগ খুবই ভালো।’ তারপর তিনি নানা আলোচনার পর বললেন-‘ঠিক আছে এক্ষুনি তাদের পছন্দ অনুযায়ী দুটি মোটরসাইকেল বুক করে অগ্রিম করে দাও এবং আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আমার অনুমোদন নিয়ে নিও।’
এ আদেশ পেয়ে কর্মকর্তা দুজনের কী যে আনন্দ, তা ওই সময়ে উপস্থিত না থাকলে অনুভব করা খুবই কঠিন। পরবর্তীকালে ওই বছরই ওই দুই কর্মকর্তার প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২২ লাখ টাকায় উন্নীত হয় এবং এরপর প্রতিবছর তাদের প্রিমিয়াম সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপণন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বিপণন হলো মূল ভিত্তি। মরহুম এমএ সামাদ বিপণন ব্যবস্থাপনায় এ ধারণা সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল হক চৌধুরীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিজিআইসি সুদৃঢ় অবস্থানে ছিল। বর্তমান বিজিআইসির উন্নয়নের এ ধারা মরহুম এমএ সামাদের সুচিন্তা, দূরদর্শিতা এবং সফল কর্মপরিকল্পনার ফসল। তার প্রতিটি দূরদর্শিতাপূর্ণ সিদ্ধান্তই আমাদের আজকের এ সফলতার চাবিকাঠি। আমরা প্রতিদিন আমাদের কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি এই মহান ব্যক্তির আত্মার চিরশান্তির জন্য।
আহমেদ সাইফুদ্দীন চৌধুরী : ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, বিজিআইসি পিএলসি