সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধ
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ক্লাসে এক ছাত্র প্রশ্ন করেছিল, স্যার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলা হয় কেন? বুঝলাম, বিষয়টা ওদের কাছে একটু গোলমেলে মনে হতেই পারে। কারণ এ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সময় থেকে ওরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলোর বাড়বাড়ন্ত দেখেছে। নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ-লোভের উদ্দেশ্য সামনে রেখে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিভেদ তৈরি করতে দেখেছে। ধর্মীয় সংঘাত ছড়াতে দেখেছে। দীর্ঘদিনের হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আড়াল করে বাংলাদেশকে ‘মুসলমানের দেশ’ বলে ইতিহাসকে খণ্ডিত করে বিভ্রান্তি ছড়াতে দেখেছে। সম্প্রতি নামগোত্রহীন দলের ব্যানারে দুর্গাপূজার আগে ১৬ দফা শর্তজুড়ে নিজেদের সংকীর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। দুর্গপূজাকে কেন সার্বজনীন বলা হয়, এ ইতিহাস না জেনে কেউ কেউ নিজেদের মূর্খতা প্রকাশ করছে। এসব কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুন্দর ক্যানভাস ওদের কাছে অচেনা লাগবেই।
আমি বাঙালির উৎসব পড়াতে গিয়ে ঈদুল ফিতরের কথা বলি। ওরা কৌতূহল নিয়ে তাকায়। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে আমাদের ছেলেবেলার কথা বলি। মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের পরিবারগুলোর সাধারণ চিত্র অনেকটা একই রকম ছিল। ঈদের একদিন বা দুদিন আগে অনেক কিছুর সঙ্গে কটি মোরগ কিনে আনতেন আব্বা। তা থেকে দুটো আলাদা করে রাখা হতো। ঈদের আগের রাতে মোরগ ও খাসির মাংস আলাদাভাবে রান্না করে মিটসেফে রাখা হতো। ওগুলো বোনদের হিন্দুবান্ধবী আর আব্বার হিন্দু বন্ধুদের জন্য। আমাদের জন্য আলাদা করে মোরগের মাংস এবং গরুর মাংস রান্না হতো। এভাবেই আনন্দ ভাগ করে নিত হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। সুলতানি যুগ থেকে মুসলিম শাসক ও সাধক কারও মধ্যেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল না। আল্লাহপ্রেম ও মানবপ্রেমকে একীভূত করে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সুফিসাধকরা। তাতে বাঙালি মানসে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ উপ্ত হয়েছিল। তাই সাম্প্রদায়িকতার কালো কাপড়ে জড়ানো লেবাসধারী ধর্মীয় নেতাদের শত চেষ্টায়ও এদেশের মানুষের মননজুড়ে থাকা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ফিকে করে দেওয়া যায়নি।
শুধু ঈদ কেন, এ প্রসঙ্গ ধরে আমরা আসন্ন শারদীয় পূজার দিকে দৃষ্টি দেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও উৎসবের আমেজ কাটতে আরও কিছুদিন লেগে যায়। এ উৎসবের আনন্দ থেকে প্রতিবেশী মুসলমান যে একেবারে বিযুক্ত থাকে তেমন কিন্তু নয়। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যতটা স্পষ্ট আমি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে কলকাতাতেও তেমনটি দেখিনি। তখন আমি গবেষণার কারণে অনেক দিন কলকাতাতে ছিলাম।
আমার মনে পড়ছে, করোনাকালের আগের কথা। ঈদুল ফিতরের দিন আমাদের একটি টিভি চ্যানেল সাধারণ মানুষের অনুভূতি জানতে চাওয়া নিয়ে অনুষ্ঠান করছিল। উন্মুক্ত লোকালয়ে অনুষ্ঠান। এক পর্যায়ে মাইক্রোফোনের সামনে এক ভদ্রমহিলা এলেন। শাখা-সিঁদুরে বোঝা গেল তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন। সঙ্গে স্বামী ও দুই সন্তান আছে। অফিস ছুটি, তাই আনন্দ করতে বেরিয়েছেন। মুসলমান প্রতিবেশীর মতো ঈদের আনন্দ তাকেও ছুঁয়ে গেছে। জানালেন, রাতে তার স্বামীর বন্ধুর বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে যাবেন। তারা জানেন, এদিন তাদের খাওয়ানোর জন্য ভিন্ন আয়োজন করা হবে। আসলে এটিই আবহমান বাংলার চিত্র, যে কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
আমাদের ছেলেবেলার কথা স্মরণে আনতে পারি; নারায়ণগঞ্জের বন্দরে অনেক হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। এদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ভারত চলে গেছেন। এসব বাড়িতে আমার বোনদের বান্ধবী আমার অনেক দিদি ছিলেন। আদর-স্নেহ পেয়ে তাদের দূর সম্পর্কের মনেই হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা ছোটরা যেমন করগুনে ঈদের অপেক্ষা করতাম, একইভাবে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা আর সরস্বতী পূজার জন্যও দিন গুনতাম। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দেখা, ঢাকির জাদুকরী হাতে মনমাতানো ঢাকের বাদ্যে মাতোয়ারা হওয়া আর প্রসাদ খাওয়ার লোভ তো ছিলই। তখন মুরুব্বি পরহেজগার মুসলমান আর ইমামরা সম্ভবত এমন আচরণকে অভিন্ন সংস্কৃতি হিসাবেই দেখতেন। তাই ধর্ম গেল ধর্ম গেল বলে রে রে করে তেড়ে আসতেন না অথবা ধর্মের নামে কেউ বিভেদ বা হিংসা ছড়াতেন না। তাই সামাজিক সংহতি বজায় থাকত। ঈদের মতো শিয়া মুসলমানদের মহররমের মিছিলেও এক সময় ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে অনেকেরই অংশগ্রহণ ছিল। ইরাক-ইরানসহ অনেক দেশে শিয়া-সুন্নির মধ্যকার দ্বন্দ্ব হানাহানির পর্যায়ে চলে গেছে। এদিক থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আঠারো শতক থেকে ঢাকায় মহররম পালিত হচ্ছে। শিয়া বন্ধুদের সঙ্গে তাজিয়া মিছিলে সুন্নি বন্ধুরাও অনেকের অংশগ্রহণ এদেশে স্বাভাবিকই ছিল। আঠারো-উনিশ শতকের নথিতে দেখা যায়, একটি সাংস্কৃতিক প্রণোদনা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেও শরিক হতো মহররমের মিছিলে। বিশ্বাস ছিল কারবালার স্মৃতিতে দুলদুলের প্রতীক ঘোড়ার পায়ে দুধ ঢেলে মনোবাঞ্ছা করলে তা পূরণ হয়। অনেক হিন্দু নারী ইচ্ছাপূরণের আশায় দুলদুলের পায়ে দুধ ঢালতেন।
মুসলমান পিরের সমাধিতে হিন্দুর যাওয়া, প্রার্থনা করা-এদেশে একটি সাধারণ চিত্র। গ্রামগঞ্জের নানা জায়গায় এখনো ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয়। এ ‘ভেলা ভাসানো’ উৎসবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সুন্দরবনের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন মুসলমান বাওয়ালি, কাঠুরে বা জেলেরা বনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কল্পনায় বনবিবি আর ব্যাঘ্র দেবতা গাজীর নামে শিরনি দিত। অন্যদিকে হিন্দু বাওয়ালি, কাঠুরে ও জেলে একই অধিকর্ত্রী দেবী হিসাবে বনদুর্গা আর ব্যাঘ্র দেবতা হিসাবে দক্ষিণ রায়ের নাম জপ করে।
এসব বাস্তবতা এদেশের দীর্ঘকাল ধরে লালিত সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই প্রকাশ করছে। সমাজ ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে আমি আমার লেখায় বহুবার বলার চেষ্টা করেছি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে এদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অপচ্ছায়া খুব স্বচ্ছন্দে ডানা মেলতে পারবে না। এদেশের সাধারণ মানুষের মানসিক গড়ন সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে না। পাকিস্তান আমল থেকেই ধর্মীয় দলগুলো নির্বাচনে সাধারণ মানুষের তেমন সমর্থন পায়নি। তারপরও এ সত্য মানতে হবে, যেসব স্বার্থান্বেষী ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যে না দেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তারা কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করে। অন্য পক্ষ অতটা বুঝে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও কূপমণ্ডূকতার কারণে ধার্মিক না হয়ে এক ধরনের ধর্মান্ধ হয়ে যায়। ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন না করে অনালোকিত এবং সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ধর্মনেতার বয়ান শুনে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। প্রথম পক্ষের ধর্ম-বণিকদের চেনা যায়, ফলে এদের প্রতিরোধ করাও সম্ভব। কিন্তু অতি ধীরে হলেও দ্বিতীয় পক্ষের সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষদের পক্ষে সমাজ কলুষিত করার ক্ষমতা বেশি বলে আমরা মনে করি। প্রথমে তারা নিজ পরিবারকে প্রভাবিত করে, পরে প্রতিবেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
আমার পরিচিত একজন চল্লিশোর্ধ্ব তরুণের কথা বলব। বছর দশক আগে সরকারি অফিসের মাঝারি কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পন্ন করেছেন। সেই অর্থে শিক্ষিত। কিন্তু তার আলাপচারিতায় মনে হয় আলোকিত নন। নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করেন, সেই অর্থে ধার্মিক। তবে ধর্মচর্চা করেন বলে মনে হয় না। একজন শিক্ষিত মানুষ যদি ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান হন, তবে তার কর্তব্য ধর্মীয় বাণীর তাৎপর্য অনুধাবন করা, নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানা, আর এ জানাকে স্পষ্ট করার জন্য অন্য ধর্মের বাণী উপলব্ধি করা। অর্থাৎ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করা। অন্তত অন্য ধর্ম সম্পর্কে ঈর্ষাভাব জাগার আগেই।
এ বন্ধুটি বেশ কিছুদিন ধরে আক্ষেপ করছিলেন সরকারি দপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের অনেক বড় বড় পদে ‘কেবল হিন্দু কর্মকর্তা’ নিয়োগ পাচ্ছেন বলে। আমি প্রথমে গা করিনি। বর্তমান সময়ের রাজনীতি আমাদের মনুষ্যত্বকে নষ্ট করছে। তাই ভিন্ন রাজনীতির দল ক্ষমতায় থাকলে সেই সরকারকে নানাভাবে সমালোচনা করতে ভালো লাগে। আমি বন্ধুর বিষোদ্গারের কারণ তেমনটিই মনে করেছিলাম। কিন্তু একইভাবে বারবার আক্ষেপ করায় আমি জানতে চাইলাম, যে হিন্দু কর্মকর্তাদের পদায়ন হচ্ছে তারা কি যোগ্যতার বিচারে হচ্ছেন না? তখন তিনি নীরব রইলেন। আমি বললাম, এ দেশের নাগরিক যদি হয়ে থাকেন আর যোগ্যতার কারণে যদি পদ পেয়ে থাকেন, তবে তাদের ধর্ম-পরিচয় খোঁজা তো নিরর্থক। তিনি খুব সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, এ দেশে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান, তাই মুসলমানের অধিকারটি বেশি থাকতে হবে। আমার কাছে কথাগুলো একটু বিসদৃশ লাগল। আমার চারপাশের পরিবেশে অমন করে ভাবতে দেখি না কাউকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অমন সংকীর্ণ চিন্তা কাজ করে বলে আমার বোধ হয় না। অথচ নাগরিক সমাজে বাস করা, সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত এক সরকারি চাকুরে অমন করে ভাবছেন কেন? পরে মনে হলো, এ মানসিকতার মানুষগুলো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হয়তো তেমন আলোকিত নন। তাই ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এদেশে একুশ শতকেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা প্রকাশ করছেন কণ্ঠ উঁচিয়ে। যে সংকীর্ণতার স্থান তার নিজ ধর্মেই নেই।
আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ধরে রাখতে পারলে এ দেশের ধর্ম-বণিক রাজনীতিকদের অপতৎপরতা আর জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এজন্য অনালোকিত জনগোষ্ঠীকে আলোকিত করতে হবে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com