Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

প্রবাসীদের যথাযথ মূল্যায়ন করুন

Icon

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রবাসীদের যথাযথ মূল্যায়ন করুন

দেশের অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতি লাভ করছে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ২১৬ মার্কিন ডলার, ২০০০ সালে ছিল ৪১৩ মার্কিন ডলার এবং ২০২৩ সালে এসে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ হয় ২,৬২১ মার্কিন ডলার।

অর্থনীতির এ উন্নতিতে বেশি অবদান ছিল তৈরি পোশাকশিল্পের উন্নয়ন এবং প্রবাসীদের মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং প্রবাসীদের মাধ্যমে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা।

এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭৬টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখ। তাদের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ এবং সংযুক্ত আরব-আমিরাতে অবস্থান করছেন প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি।

বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৬৫ শতাংশ এসে থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে পাঠানো দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল সৌদি আরব (১৯ শতাংশ), দ্বিতীয় স্থানে আমেরিকা (১৮ শতাংশ), তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে ছিল যথাক্রমে সংযুক্ত আরব-আমিরাত (১২ শতাংশ), যুক্তরাজ্য (১০ শতাংশ) ও কুয়েত (৮ শতাংশ)। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় অবস্থান করছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় থাকা আমাদের দেশের প্রবাসীদের মধ্যে সিংহভাগই অদক্ষ অথবা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক শ্রেণির। স্বল্পদক্ষ অথবা অদক্ষ শ্রমিকদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসাবে গড়ে তোলা সক্ষম হতো, তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সমগ্র বিশ্বে আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৮.৫৯ শতাংশ অদক্ষ শ্রেণির। যেখানে শ্রীলংকার একজন শ্রমিক একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করে ৩০০ ডলার এবং ভারতীয় একজন শ্রমিক ২০০ ডলার আয় করেন, সেখানে অদক্ষ শ্রেণির শ্রমিক হওয়ার কারণে বাংলাদেশি শ্রমিক আয় করেন মাত্র ১০০ ডলার।

বিদেশ থেকে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে, তার প্রায় ৩৩ শতাংশ খাদ্য অথবা খাদ্যজাত দ্রব্য ক্রয়ে ব্যয় করা হচ্ছে। খাদ্য ছাড়া অন্য খাতে ব্যয় হচ্ছে ৩২.৮২ শতাংশ। জমি ক্রয়ে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭.৫০ শতাংশ। বিভিন্ন বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৩.৪৫ শতাংশ। গড়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা তাদের নিজ নিজ পরিবারকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পাঠাতে পারেন। এ হিসাবে বছরে পাঠাতে পারেন ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অবশ্য কুয়েতে অবস্থানরত প্রবাসীরা তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করতে সক্ষম হন।

অদক্ষ অথবা স্বল্পদক্ষ নিম্নআয়ের প্রবাসীদের প্রেরিত কষ্টার্জিত অর্থের বেশিরভাগই ব্যয় হয় পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে। আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা সাধারণত বেশি পরিমাণ অর্থ পরিবারকে প্রেরণ করতে সক্ষম হন। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশে রয়েছেন তুলনামূলক অবস্থাপন্ন বা ধনী প্রবাসীরা, যারা বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে বড় পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে সক্ষম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ধনী প্রবাসীদের টার্গেট করে প্রবাসী বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের প্রবাসীরা সাধারণত পরিবারকে কম টাকা পাঠাতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এ অর্থ প্রেরণের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। প্রবাসীদের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং বেড়েছে কর্মসংস্থান। ব্যাপারটা একটা সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আলোচনা করা যাক। মনে করি, আব্বাসের পরিবারের মাসিক আয় আগে ছিল ২০ হাজার টাকা। তিনি কুয়েত যাওয়ার ফলে তার পরিবারের আয় বেড়ে হলো মাসিক ৫০ হাজার টাকা। এখন এই বর্ধিত আয়ের ফলে পরিবারটির বিভিন্ন ধরনের চাহিদা (যেমন-কেক, বিস্কুট, দুধ, ডিম, পাউডার, ক্রিম ইত্যাদি) বেড়ে গেল।

এভাবে আব্বাসের মতো আরও অনেক প্রবাসীর প্রেরিত অর্থে তাদের পরিবারের ব্যয় বেড়ে গেল। সুতরাং চাহিদা বৃদ্ধির ফলে সুযোগ হলো গ্রামে ফ্যাক্টরি তৈরির মাধ্যমে কেক, বিস্কুট উৎপাদন করার। ওষুধের দোকান দেওয়ার। সুযোগ তৈরি হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বৃদ্ধির। এভাবেই প্রবাসীদের আয়ে বাড়ছে কর্মসংস্থান, সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধি বাড়ছে এবং বাড়ছে গ্রামাঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রার মান। আবার প্রবাসীরা বাড়ি নির্মাণ করছেন। এতে দরিদ্র জনগণের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং অর্থ উপার্জনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং হ্রাস পাচ্ছে দারিদ্র্য এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে উৎপাদন। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে।

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখার পরও প্রবাসীদের তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। তারা বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক সময় হয়রানির মধ্যে পড়েন। এছাড়া দেশে বিনিয়োগ করতে চাইলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কবলে পড়েন। বস্তুত দেশের এসব সূর্যসন্তানের সামাজিক মর্যাদা তুলনামূলকভাবে কম। অর্থনৈতিক উন্নয়নে রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসীদের অবদান বেশি; কিন্তু মূল্যায়ন কম এবং এটাই বাস্তবতা।

বর্তমান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বিমানবন্দরে ভিআইপি সার্ভিস প্রদানের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। এটি অত্যন্ত আনন্দের খবর। যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধার কারণে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে, তাদের এমন মূল্যায়নই প্রাপ্য। তাদের সম্মান প্রদান করতে আমরা দায়বদ্ধ।

প্রথম পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের টার্গেট করা হয়েছে। পরে অন্যান্য দেশে অবস্থান করা প্রবাসীদেরও যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে আশা করা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে এ সেবা চালু হলে প্রবাসীরা সত্যিই উপকৃত ও আনন্দিত হবেন। প্রতিটি স্তরে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করবেন প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের কর্মীরা।

বিদেশগামীদের মাইগ্রেশন খরচ কমানো অত্যন্ত জরুরি। দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নজরদারিতে আনা প্রয়োজন। বর্তমানে বিদেশ গমনে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হবে না। এতে অনুমোদন প্রক্রিয়ার ভোগান্তি ১৫ থেকে ৩০ দিন কমে আসবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রবাসীদের অবদানের কথা স্মরণ করে বিমানবন্দর, অনুমোদন প্রক্রিয়া ইত্যাদি থেকে শুরু করে সব স্তরে তাদের যথাযথ সেবা প্রদান এবং মূল্যায়ন একান্ত প্রয়োজন। জাতির রেমিট্যান্স যোদ্ধা সূর্যসন্তানদের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং তাদের অবদান স্বীকার করা আমাদের প্রকৃত অর্থেই নৈতিক দায়িত্ব। দেশের উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপে প্রবাসীদের দেওয়া বুদ্ধি ও পরামর্শও আমাদের একান্ত কাম্য।

ড. ফজলে এলাহী মোহাম্মদ ফয়সাল : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম