Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়

Icon

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়

ফাইল ছবি

ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরের রোগ নয়। ডেঙ্গু দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে ডেঙ্গু এখন শুধু ঋতুনির্ভর রোগ নয়, সারা বছরের রোগ। এ থেকে স্পষ্ট, দেশময় সারা বছর আমাদের প্রাণ ঝরাতে যে রোগটি বিস্তার লাভ করছে, তা প্রতিরোধে কতটা সচেতনতা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোতে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ দিয়ে ডেঙ্গু দমনের চেষ্টার ফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা। কথায় আছে, ডেঙ্গু একবার যখন কোনো রাজ্যে বা রাষ্ট্রে প্রবেশ করে, তখন তাকে আর বের করা যায় না। দমন করে রাখতে হয়। কিন্তু দমন পদ্ধতি যদি যথাযথ না হয়, দমনের নামে যদি শুধুই ‘পিলো পাস’ খেলা হয়, তাহলে ডেঙ্গুর বিস্তার আরও ত্বরান্বিত হয়। বাস্তবে হয়েছেও তা-ই। এডিস মশা তার বংশবিস্তার করে মানুষের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে চলেছে।

২০২৩ সাল ছিল এ ভয়াবহতার চরম প্রকাশ, যার রেশ ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ছিল। ২০২৪ সালের মে-জুন মাসে একটু স্বস্তি থাকলেও জুলাই থেকে আবার তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ হাজার ৮২ জন। আর এ সময় পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৬৬ জনের। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ আক্রান্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং তার সংখ্যা ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ৬ হাজার ১৫০। একইভাবে সর্বোচ্চ মৃত্যুহারও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে, যা মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, নগর পিতার স্বেচ্ছাচারিতা কত ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

অনেকবার চেষ্টা করেছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশক দমনে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার পরামর্শ প্রদানের। কিন্তু সবসময়ই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মশক দমন পদ্ধতি কখনোই যেমন একক কোনো পদ্ধতি নয়, তেমনি কখনোই একক কোনো মানুষের সিদ্ধান্ত জোর করে প্রয়োগের বিষয়ও নয়। এ দমন পদ্ধতি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সব অংশীজনের সমন্বিত পরামর্শের প্রায়োগিক বিষয়। বিশ্বের সব দেশ মশাবাহিত রোগগুলো সফলভাবে দমনে সক্ষম। সে দেশগুলোর প্রায়োগিক দিক বিশ্লেষণ করে আমাদের দেশের পারিপার্শ্বিক উপাদানের ভিত্তিতে তার প্রয়োগ কতটা সম্ভব, তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে অবশ্যই বিপরীত ফলাফল দেবে। যে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ রোগের ক্ষেত্রে ইপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডির যথাযথ বিশ্লেষণেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক পরিসংখ্যানিক তথ্য উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং সেই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের সঠিক সম্পর্ক নিরূপণ নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সহায়তা প্রয়োজন। একইসঙ্গে মশক দমন পদ্ধতির কার্যকারিতা, ডেঙ্গুর চিকিৎসার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে যখন সঠিক গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে, কেবল তখনই একটি সঠিক প্রায়োগিক পদ্ধতি নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা।

আমাদের নগরীর কাউন্সিলররা জনগণের প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষের কিসে মঙ্গল, তাই হওয়া উচিত তাদের মূল আরাধ্য বিষয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন করে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েই তারা জনসেবায় নামেন। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। আমাদের দেশে সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যতগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যেমন-বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউনেস্কো, ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন, ইউএসএইড-এ প্রতিষ্ঠানগুলোরও একটি নিজস্ব পলিসি রয়েছে। সে পলিসির সঙ্গে আমাদের পলিসির সমন্বয় ঘটাতে হলে অবশ্যই গবেষণালব্ধ ফলাফলের ব্যাপকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশে যতগুলো গবেষণা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিপসমের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এমওইউয়ের মাধ্যমে গুণগতমানসম্পন্ন জনস্বাস্থ্যবিদ তৈরি করবে, তেমনি গ্লোবালাইজড এ বিশ্বে প্রগতিশীল উদ্ভাবনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত সম্ভব হবে। একইভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিগুলোই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। এজন্য বাড়াতে হবে গবেষণার পরিধি ও বাজেট। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট তৈরি হয় তার সঠিক ও সফল ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। আজ জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত হয়েছে সঠিকভাবে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে গবেষণালব্ধ ফলাফলের সঠিক বিস্তার ও প্রয়োগের অভাবে।

জনস্বাস্থ্য শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি কমপ্রিহেনসিভ কনসেপ্ট, যা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখার সব শাখা-প্রশাখার সমন্বিত একটি বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত মানুষের বসতবাড়ির অবস্থা অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা অর্থাৎ পরিবেশ-বিজ্ঞান, পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর বাহকের উপস্থিতি ও ঘনত্ব অর্থাৎ অ্যান্টোমোলোজি, সেই বাহক কর্তৃক বাহিত রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অর্থাৎ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট ইত্যাদি সংবলিত বিজ্ঞান বা মাইক্রোবায়োলেজি, মাইকোলোজি, প্যারাসাইটোলোজি, পপুলেশন ডিনামিক্স, অ্যানথ্রোপোলজি, বায়োস্ট্যাটিসটিক্স ইত্যাদি। চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে এতগুলো বিষয়ের চমৎকার সমন্বয়ই জনস্বাস্থ্য বা জনগণের সুসাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করে। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সুচিকিৎসার জন্য জনবল ও অবকাঠামোর উন্নয়নই হলো স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। এ ধারাবাহিকতা সুসংহত করাই স্বাস্থ্য খাতের মূল উদ্দেশ্য।

একজন পুষ্টিহীন মানুষ যেমন কখনই সঠিক ইমিউনিটির অধিকারী হতে পারে না, তেমনি একজন মানুষ দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে যত ওষুধই সেবন করুক, অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সুস্থ থাকতে পারে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এডিস মশার প্রজননস্থল বৃদ্ধি করে কখনই একজন মানুষ ডেঙ্গুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারে না। তাই দেশময় এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সবাইকে একসঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আসুন পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে নির্মল পরিবেশ গড়ে তুলি।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম