Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে?

Icon

বেলেন ফার্নান্দেজ

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বিশ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে?

ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে ইসরাইল হত্যা করার প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরাইলের মূল ভূখণ্ডে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ইসরাইল বলেছে, এর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, বৈরুতের দাহিয়াহর কাছে এক বিধ্বংসী বিমান হামলায় হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনী বিজয়ের গর্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ জানিয়েছিল, নাসরুল্লাহ ‘বিশ্বকে আর আতঙ্কিত করতে পারবে না।’ অথচ গাজা উপত্যকায় প্রায় এক বছর ধরে যে গণহত্যা চলছে, এর সঙ্গে নাসরুল্লাহ জড়িত ছিলেন না। তাহলে কীভাবে তিনি সন্ত্রাসের জন্য দায়ী হলেন? তিনি কি গত এক সপ্তাহেরও কম সময়ে লেবাননে সাত শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছেন? যদিও নাসরুল্লাহকে হত্যা করার জন্য অসংখ্য আবাসিক ভবন ধ্বংস ও তাদের বাসিন্দাদের হত্যা করার পরও ইসরাইল এ সবকিছুর জন্যই কৃতিত্ব নিতে চায়। এটা ‘বিশ্বকে আতঙ্কিত করা’র যে কোনো উদাহরণ হিসাবে ভালো। যখন নাসরুল্লাহকে হারানো তার সংগঠনের জন্য একটি আঘাত হিসাবে তারা প্রচারণা চালিয়েছে, তখন ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের মূলোৎপাটনের পরিবর্তে এটিকে আশ্চর্যজনকভাবে তীব্রতর করতে কাজ করে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, হিজবুল্লাহর সহ-প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস আল-মুসাভি ১৯৯২ সালে দক্ষিণ লেবাননে ইসরাইলি গানশিপ হেলিকপ্টারের হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় তার স্ত্রী এবং পাঁচ বছরের ছেলেও নিহত হয়। তখনো ইসরাইল তড়িঘড়ি এর কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন লাভের প্রয়াসে কাজ করেছিল, যদিও এমন উদযাপনও দুঃখজনকভাবে অকালপক্ব হিসাবে দৃষ্টিগোচর হয়। আল-মুসাভির হত্যার পর নাসরুল্লাহ হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন এবং সংগঠনটিকে শুধু লেবাননে নয়, পুরো অঞ্চলে একটি শক্তিশালী শক্তিতে পরিণত করেন। তার নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ২০০০ সালে ইসরাইলকে লেবাননের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে। এর ফলে ২২ বছরের নৃশংস ইসরাইলি দখলদারত্বের অবসান ঘটে এবং ২০০৬ সালে লেবাননে ৩৪ দিনের যুদ্ধের সময় সফলভাবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর অপমানজনক আঘাত মোকাবিলায় সক্ষম হয়।

হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার ব্যাপারে ইসরাইলের ক্রমাগত চেষ্টা দলটিকে খুব একটা দুর্বল করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালে সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর সামরিক কমান্ডার ইমাদ মুগনিয়াহকে হত্যায় মোসাদ-সিআইএ’র যৌথ অভিযান সফল হলেও তা হিজবুল্লাহর খ্যাতি আরও বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এরপরও অগণিত ফিলিস্তিনি নেতাকে হত্যা অবশ্যই তাদের কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে, তবে এর কোনোটিই ফিলিস্তিনিদের তাদের বিদ্যমান প্রত্যয় থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।

মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে ইসরাইলি কমান্ডোরা একটি রাতের অভিযানে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) বেশ কয়েকজন নেতাকে তাদের বৈরুত অ্যাপার্টমেন্টে হত্যা করেছিল। এটি ঘটেছিল এহুদ বারাকের নেতৃত্বে, যিনি পরে ইসরাইলের শীর্ষ সেনা কমান্ডার ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এপি’র প্রতিবেদন অনুসারে, বারাকের দল কামাল আদওয়ান, যিনি ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিমতীরে পিএলও অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন; পিএলওর নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ইউসেফ নাজ্জার এবং পিএলও মুখপাত্র ও ক্যারিশমাটিক লেখক ও কবি হিসাবে পরিচিত কামাল নাসেরকেও হত্যা করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর চালানো এসব হত্যাকাণ্ড ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে কমই দমাতে পেরেছে। ১৯৮০ ও ২০০০ সালের দিকে প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদা যখন হয়েছিল, ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিক বা সামরিক নেতাদের সাংগঠনিক নেতৃত্ব ছাড়াই গণঅভ্যুত্থান শুরু করতে পেরেছিল। ইসরাইল যখন প্রথাগত প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সহিংসভাবে পরাস্ত করার চেষ্টা করেছিল, তখন নতুনদের আবির্ভাব ঘটেছে। এমনটি হামাসের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। হামাসও ইসরাইলের হত্যা কৌশলকে ব্যর্থ করে নিজেদের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জনে পথ খুঁজে নিয়েছে।

১৯৯৬ সালে ইসরাইলিরা হামাসের প্রকৌশলী ইয়াহিয়া আয়াশকে তার মোবাইল ফোনে বিস্ফোরক লাগিয়ে হত্যা করেছিল। এটি এমনই এক ঘটনা, যা সম্ভবত ইসরাইলের সাম্প্রতিক লেবাননজুড়ে পেজার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস বিস্ফোরণের মতো সন্ত্রাসী উদ্যোগের সঙ্গে মিলে যায়। এরপর ২০০৪ সালের মার্চে গাজা শহরে হেলিকপ্টার হামলার মাধ্যমে শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে হত্যা করা হয়, যিনি ছিলেন হুইল চেয়ারে আবদ্ধ ধর্মগুরু ও হামাসের একজন প্রতিষ্ঠাতা। তার উত্তরসূরি আবদেল আজিজ রান্টিসিও এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হন। তিনটি সর্বনাশা যুদ্ধ এবং একের পর এক ইসরাইলি সামরিক হামলা ও ক্রমাগত হত্যা সহ্য করেও হামাস গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ওপর হামলা চালানোর জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছিল।

সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহকে হত্যা করা হয়, যিনি ছিলেন গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্যতম প্রধান আলোচক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘মধ্যপন্থি’ হিসাবে পরিচিত। এরপরও তা গণহত্যার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কিছুমাত্র হ্রাস করতে পারেনি। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা এটারই পুনরাবৃত্তি করে। হিজবুল্লাহর অস্তিত্বই ইসরাইলের গণহত্যা প্রবণতার ফলস্বরূপ, বিশেষ করে ১৯৮২ সালে লেবাননে ইসরাইলি আগ্রাসনের ঘটনা, যাতে কয়েক হাজার লেবাননি ও ফিলিস্তিনিকে তারা হত্যা করেছিল। এ আগ্রাসনকে ‘অপারেশন পিস ফর গ্যালিলি’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। স্পষ্টতই তা লেবাননে ইসরাইলবিরোধী প্রতিরোধকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তাতে কেবল উত্তেজনাই বৃদ্ধি পায়নি, নির্যাতিতরা উজ্জীবিত হয়েছিল। ইসরাইলি প্রশাসন কেন চিন্তা করে না যে, আরবদের নিরলস গণহত্যার শিকার হওয়ার পটভূমিতে একজন ব্যক্তিকে হত্যার মাধ্যমে আসলে কী ধরনের প্রতিশোধ নেওয়া যেতে পারে। এটি আশ্চর্যের বিষয়ই বটে।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : খালিদ বিন আনিস

বেলেন ফার্নান্দেজ : মার্কিন লেখক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম