Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সুযোগ সন্ধানীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুযোগ সন্ধানীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি দায়িত্বশীল পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। হঠাৎ খুব আনন্দ প্রকাশ করলেন তিনি। জানালেন, তার কাছে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা পতাকা ছিল ‘ইসলামি আকিদার’ প্রতীক। তাই তিনি লাল-সবুজের পতাকায় খুশি ছিলেন না। ইদানীং পতাকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ওঠায় তার ভেতরের মেঘ কেটে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়টিতে তিনি প্রশান্তি অনুভব করছেন। তিনি দেখেছেন, এ পর্বে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বাঙালি যাকে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার অপরাধে মানসিকভাবে বর্জন করেছিল। শোনা যায়, বাংলাদেশ বেতারে বড় কোনো যুক্তি ছাড়াই উর্দু প্রোগ্রাম চালু করার একটি গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ‘হিন্দুর লেখা জাতীয় সংগীত’ বাতিল হলে এবং ‘হিন্দুর ডিজাইন করা জাতীয় পতাকা’র পরিবর্তন হলে তিনি যেন স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তির স্বাদ পাবেন! মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা-এসব ইস্যু নিয়ে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত প্রতিবাদ না থাকায় এ সরকারের প্রতি দমে দমে শুকরিয়া প্রকাশ করছেন এ ভদ্রলোক।

আমাদের ধারণা, সংখ্যায় কম হলেও এ দেশে এখনো এমন চিন্তার মানুষ আছে। এদের জন্য এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বর্তমান সরকার সমালোচিত হচ্ছে, যা আমাদের কাম্য নয়। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার রক্ত দামে বাংলাদেশের মানুষের কাঁধে চেপে থাকা স্বৈরাচারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। মানুষের আশা, এ দেশের মানুষ আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে যথার্থ মুক্তির প্রত্যাশা করেছে, এ সরকার নির্বাচন আয়োজনের আগে সব ক্লেদ পরিষ্কার করে তা পূরণের পথে হাঁটবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কিছুসংখ্যক মানুষ যেন তাদের অব্যক্ত অভিলাষ পূরণের ঠিক সময়টি এখনই পেয়ে গেল।

সুযোগসন্ধানী মানুষই ধর্ম-বর্ণ সামনে এনে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন এবং পতাকা পরিবর্তনের মতো কথা বলতে পারে। এমন ধারার প্রস্তাব যারা রাখেন, তাদের কথার জবাব দেওয়া আমি রুচিসম্মত বলে মনে করি না। কিন্তু নীরব থাকার উপায়ও নেই। এক সময় আমি বাংলাদেশের পতাকা তৈরির ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলাম। অনেক পত্রিকা অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশও করেছিল। সেই সূত্রে অনেকে অনুরোধ করছেন পতাকা তৈরির ইতিহাসটি সবার নজরে আনার জন্য যেন পুনরায় লিখি। আমি বিশ্বাস করি, এ ইতিহাস অনেকেরই জানা। তবু আজকের লেখায় সংক্ষেপে উপস্থাপন করছি।

১৯৭০ থেকেই স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েছিল ছাত্র-জনতা। ছাত্ররা গোপনে নিজেদের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র সিদ্ধান্ত নেন, তারা পাকিস্তানকে বর্জন করার প্রতীক হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করবেন। এ লক্ষ্যে পতাকার একটি নকশা তৈরি করে ফেলেন। সিদ্ধান্ত হয় মূল ক্ষেত্রটি সবুজ বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবে গাঢ় সবুজ রঙের হবে এবং এর মাঝখানে বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে থাকবে লাল সূর্য। সূর্যের মাঝখানে সোনালি বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবে থাকবে সোনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র।

নিঃসন্দেহে ছাত্রদের এ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছিল একটি দুঃসাহসিক কাজ। জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। স্বাধীনতার ঘোষণাও বলা যায়। স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির সঙ্গে রাজনীতিক এবং জঙ্গি হামলায় নিহত কাজী আরেফ আহমেদ যুক্ত ছিলেন। তার বক্তব্য থেকে পতাকা তৈরির আনুপূর্বিক দৃশ্যপট জানতে পারি। তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়। ওইদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে, একটি ‘বাহিনী’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদান করবে।... এবারও ‘নিউক্লিয়াসের’ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এ বাহিনীর নাম দেওয়া হয় ‘জয়বাংলা বাহিনী’। অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় আ স ম আবদুর রবকে। ‘নিউক্লিয়াস’ থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটেলিয়ান ফ্ল্যাগ’ হিসাবে প্রদান করা হবে।... ৬ জুন ৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই। এ ফ্ল্যাগ পরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আ স ম আবদুর রব বলেন, এ পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি-বটলগ্রিন জমিনের ওপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এ নকশা ‘নিউক্লিয়াস’ হাইকমান্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়।

...তখন আমি প্রস্তাব করি, এ পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রঙের মানচিত্র দেওয়া উচিত। কারণ হিসাবে দেখালাম, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘ভারতের হাত আছে’ বা ‘ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে’ অথবা ‘ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ’ বলে প্রচারণা চালায়। তাছাড়া এ সময় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’ নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেওয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এ কল্পিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্র তা বিলি করত। এ ধরনের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালি আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার আমার এ প্রস্তাবে সবাই একমত হন। ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘পতাকা তৈরি’র এসব কাজ করা হয়।

সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালি মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এ সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাশ (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮নং কক্ষে। তার কাছ থেকে এটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হলো বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালি রং কিনে আনা হলো। শিবনারায়ণ দাশ ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালি রং। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের ‘নতুন পতাকা’র জন্ম হলো।

রাতেই এ পতাকার সার্বিক অনুমোদনের জন্য ‘নিউক্লিয়াস’-এর বৈঠক হয় ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে। বৈঠকে পতাকাটি অনুমোদিত হলো। এবার বঙ্গবন্ধুর অনুমোদনের কাজটি বাকি থাকল। রাজ্জাক ভাইয়ের ওপর দায়িত্ব পড়ে অনুমোদন আদায় করার। রাজ্জাক ভাই সে রাতেই (৬ জুন) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুমোদন গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তবে তাকে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

পতাকাটি তৎকালীন ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেনের কাছে রক্ষিত ছিল। পরে ২ মার্চ ’৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় লক্ষাধিক লোকের সামনে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র সভায় আ স ম আবদুর রব কলাভবনের পশ্চিম প্রান্তের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পতাকাটি প্রদর্শন করেন। এ পতাকাই পরদিন (৩ মার্চ) পল্টন ময়দানে শাহজাহান সিরাজের ‘স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ’-এর জনসভায় উত্তোলন করা হয়। ওই মঞ্চে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন।

২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে ‘জয়বাংলা বাহিনী’ আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায়। ওইদিন জয়বাংলা বাহিনীকে ৪টি প্লাটুনে ভাগ করে ৪ জন প্লাটুন কমান্ডারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জয়বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, কামালউদ্দিন (পরে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অফিসার) ও মনিরুল হক (ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি)। পতাকা উত্তোলনের মুহূর্তে কামরুল আলম খান খসরুর হাতের ৭ এমএম রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলি করেন। খসরুর পাশে হাসানুল হক ইনু পতাকাটি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এখান থেকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের ধানমন্ডির বাড়িতে গিয়ে তার হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। তার বাসায় ও গাড়িতে দুটি পতাকা ওড়ানো হয়। এ ‘পতাকা’ই স্বাধীন বাংলাদেশের ‘প্রবাসী সরকার’ অনুমোদন করেন’’ (কাজী আরেফ আহমেদ, বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ৭৭-৭৯)।

আমরা বলতে পারি না, সংশ্লিষ্টজনরা যা লিখেছেন, যা বলেছেন-সবই নির্ভুল। তবে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। আছে নানা তথ্যসূত্র। এসব বিশ্লেষণ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ঘটনা রয়েছে, তা এক্ষুণি সংরক্ষণ করা ও জনসমক্ষে আনা খুবই জরুরি। সবকিছু গবেষকের গবেষণা পুঁথিতে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। এখনই তো দেখতে পাচ্ছি ইতিহাস চর্চা বা অনুসন্ধানের অভাবে পতাকা তৈরির সম্মিলিত প্রয়াস আড়াল করে শিবনারায়ণকে সামনে এনে সুযোগসন্ধানীরা সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম