সংখ্যা দুটি পালটাতে হবে
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সংখ্যা দুটি পালটাতে হবে
আমাদের এ মাতৃভূমি বাংলাদেশ অঞ্চলে ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে সরকারি অর্থাৎ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এবং সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান (সিএসপি) ছিল ক্যারিয়ার গড়ার সবচেয়ে লোভনীয় চাকরি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সংস্থার চাকরি চলে আসে প্রথম অগ্রাধিকারে; এরপরেই স্থান পায় বেসরকারি করপোরেট বডির চাকরি, সরকারি চাকরির স্থান হয় তিন নম্বরে। কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় সরকারি চাকরি আবার ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলের মতো প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছে। অথচ এ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের ব্যাপারে শুধু বয়সের মারপ্যাঁচ কিছু অবিচার ও অসুন্দর হিসাবে শেকড় গেড়ে বসেছে।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স
প্রথমে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বিষয়টি লক্ষ করা যাক। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বিষয়টি দেশের তরুণদের কাছে অবিচার হিসাবে ধরা দিচ্ছে। পরিণামে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীরা এবার চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। তবে এ বয়সটি অত্যধিক বেশি। ৩৫ বছরে চাকরির বিজ্ঞপ্তি পেয়ে সাড়া দিলে এবং বয়স্কদের অভিজ্ঞতা আরও কিছুদিন কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের অন্তত তিন বছর লাগবে পরীক্ষা নিয়ে চাকরি দিতে। অর্থাৎ, চাকরি শুরু হবে ৩৮ বছর বয়সে। চাকরি শেষের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে ৬০ বছর করা হলেও চাকরি করতে পারবে মাত্র ২২ বছর। যদিও এখন ২০ বছরের চাকরিই পূর্ণ পেনশনের যোগ্য, চাকরি ২৫ বছর পূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
পাকিস্তানের অংশ হিসাবে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ২৫ বছর; স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিক থেকেই এ বয়স ২৭ বছরে উন্নীত করা হয়। ১৯৮০-র দশকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ স্নাতক, বিশেষত স্নাতকোত্তর শিক্ষা ২৭ বছর বয়সের মধ্যে শেষ করতে পারছিল না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের সামরিক-আধাসামরিক শাসনের পর নতুনভাবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এলে এ ধারার প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৩০ বছরে উন্নীত করে।
কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে দিন বদলের ধারায় চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসর দুটোর বয়সই বাড়ানো জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। দেশে এখন পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় একশ। এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরিয়ে আসছে। চাকরির বাজারে চলছে বিরাট প্রতিযোগিতা। তাদের তো প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দিতে হবে! চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর পক্ষে কিছু যুক্তি হচ্ছে : ১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে প্রতি বছর বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা; ২. উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচির সঙ্গে বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষা-কোর্সের বিস্তর পার্থক্য থাকায় তাদের আবার নতুন করে চাকরির পড়াশোনা করতে হয়; ৩. করোনাকালে প্রায় দু’বছর নিয়োগ শূন্যে কোঠায় নেমে গিয়েছিল; ৪. পরিণামে বেকারদের মনোবল ভেঙে গেছে বা যাচ্ছে।
এসব বিবেচনায় তরুণ শিক্ষার্থী/চাকরিপ্রত্যাশীদের মনোবল চাঙা করতে ও রাখতে এবং তাদের আন্দোলন থামাতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বয়স বৃদ্ধির সীমা সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। বিপুল আয়োজনে দেশমাতৃকার তরুণদের লেখাপড়া শিখিয়ে বয়সের মারপ্যাঁচে ফেলে বেকারত্বের গ্লানি উপহার দেওয়া তো কোনো কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না।
চাকরি থেকে অবসরের বয়স
এবার আসা যাক সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স সম্পর্কিত আলোচনায়। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বর্তমান বয়সটি অসুন্দর। স্কুলজীবনে দুলাইন কবিতা পড়েছিলাম: অসুন্দরে নাশবি যদি, গড়বি নব নন্দনে রে। এটি কার কবিতা, শিরোনামই বা কী, তা এখন আর মনে পড়ছে না। কিন্তু সবাই বোঝেন: নতুন নন্দন (বাগান) সৃষ্টি করতে হলে বর্তমানে যা কিছু অসুন্দর, জঞ্জাল রয়েছে তা নাশ (হত্যা) বা দূর করেই এগোতে হয়। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বর্তমান বয়সটি (উনষাট বছর) অসুন্দর ঠেকে। তাছাড়া করোনার কারণে প্রায় দু’বছর নিয়োগ স্থগিত বা বন্ধ থাকায় অনেক পদ খালি পড়ে আছে। তাই তাড়াহুড়ো করে ৫৯ বছরে অবসরে পাঠানো অচিরেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনাসহ সব কর্মে স্থবিরতা তৈরি করতে পারে।
পাকিস্তান আমলে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি থেকে অবসরের বয়স ছিল ৫৫ বছর। দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের প্রায় শুরু থেকেই অবসরের বয়স ৫৭ বছর করা হয়। এ অবস্থা প্রায় ২০ বছর ধরে চলে। ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স একবারে তিন বছর বৃদ্ধিসাপেক্ষে অবসরের বয়সও তিন বছর বাড়ানোর যুক্তি মজবুত থাকলেও নতুন ধারার তৃতীয় গণতান্ত্রিক সরকার ২০০৯ সালে তা মাত্র দু’বছর বাড়িয়ে ৫৯ বছরে উন্নীত করে। এমন বয়সের প্রস্তাবকারী, পাশকারী ও বাস্তবায়নকারীদের আমি নাম দিয়েছি ‘উন-পছন্দ ব্যক্তিবর্গ’।
অবসরের বয়স বাড়ানোর আর বেশি যুক্তি পেশ করার দরকার আছে বলে মনে করি না। তবু কয়েকটি লিখি : ১. স্বাধীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫২ বছর; বিগত ৫৩ বছরে বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৪ বছর; ২. অকালে অবসরে যাওয়া এ মানুষগুলো সুস্থতার বিচারে আরও দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকছেন, কিন্তু কর্ম পাচ্ছেন না (ফলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার প্রচুর আশঙ্কা রয়েছে); ৩. সুস্থ-সবল, দক্ষ ও অভিজ্ঞ এ মানুষগুলোর সেবা না নেওয়া জাতীয় অপচয়; ৪. কয়েকটি দেশে অবসরের বয়স (ভারতে-৬০ বছর, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনে ৬৫ বছর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানে ৬৬ বছর) বাংলাদেশের এ বয়স থেকে ঢের বেশি। বাংলাদেশে আরও একটি অদ্ভুত ঘটনা রয়েছে। একই সরকারি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে বিসিএস ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স ৫৯ বছর; কিন্তু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স ৬০ বছর। এ আজব বৈষম্যের অবসান হওয়াও জরুরি মনে করি।
গণপ্রজাতন্ত্রী একসঙ্গে ‘গণ’ ও ‘প্রজা’ দুটি শব্দের ব্যবহার সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের চিন্তায় আমাদের রাষ্ট্রকে তত্ত্বগতভাবে ‘ডবল গণতান্ত্রিক’ করেছে! আমার চিন্তায় রাষ্ট্রের নাম হওয়া প্রয়োজন ‘জনতন্ত্র’ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম নাকি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ড্রাফটে জনতন্ত্রই লিখেছিলেন; পরে বাংলা একাডেমি মাতব্বরি করে ‘প্রজাতন্ত্র’ লিখে স্বাধীন দেশে আমাদের আবার ‘প্রজা’ বানিয়েছে! বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কল্যাণকামী হওয়ার কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জনের প্রধান উপায় আমজনতার চিন্তা-ভাবনার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং তা সাদরে গ্রহণ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপরিচালনা করা।
শেষ কথা
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমি কল্যাণকামী সরকারই মনে করি। তাই আশা করা যায়, এ সরকার তরুণদের দাবি ও আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে অচিরেই চাকরিতে ‘প্রবেশের বয়স’ ৩২ বছর করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। এ ছাড়া বয়স্কদের অভিজ্ঞতা আরও কিছুদিন কাজে লাগানোর চিন্তা থেকে অবসরের বয়সটি সুন্দর করার জন্য এবং ২০০৯ সালের সরকারি ভুল সিদ্ধান্ত সংশোধনের স্বার্থে অবসরের বয়স পূর্ণ ৬০ বছর করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
আশা করি এবং বিশ্বাস করতে চাই, সরকার সবদিক বিবেচনায় নিয়ে অতিদ্রুত সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর এবং পরীক্ষার জন্য তিন বছর বরাদ্দ ধরে ২৫ বছর কর্মকাল রাখার হিসাবে অসুন্দর সংখ্যা উনষাটকে বর্জন করে অবসরের বয়স অন্তত পূর্ণ ষাট বছরের ঘোষণা দিয়ে, সম্ভব বলে গত জুলাই থেকে তা কার্যকর করবে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার সদস্য
asmolla61@yahoo.com