তিলোত্তমার কপালে কলঙ্কের তিলক!
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
গত ৯ আগস্ট রাতেরবেলা কলকাতার আর জি কর সরকারি হাসপাতালে একটি বীভৎস ঘটনা ঘটে। এমন একটি ঘটনাতে হয়তো বিস্ময় নেই, পৃথিবীতে মানুষ (পড়তে হবে ‘পুরুষ’) পশুর সংখ্যা কম নেই, ফলে নানা দেশে এ রকম ঘটনা ঘটেই থাকে, কাগজে আমরা সেগুলোর খবর প্রায় রোজই পড়ি, অন্য মিডিয়ায় দেখি বা শুনি। আমাদের রাজ্যেও ঘটেছে, পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি আরও অনেক জায়গায়। তার অনেকগুলোর কোনো কিনারা হয়নি এখনো। কিন্তু সেসব রাস্তাঘাটে বা অন্যত্র, যেখানে মেয়েদের চলাফেরা আমরা এখনো যথেষ্ট নিরাপদ করতে পারিনি। কিন্তু এটা ঘটল একটা সরকারি হাসপাতালের সেমিনার রুমে, যেখানে সম্ভবত মেয়েটি ক্লান্তিকর ডিউটির শেষে একটু ঘুমাতে এসেছিল। তারই মধ্যে কেউ বা কেউ কেউ তাকে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করে। এর সবটাতেই আমি ‘সম্ভবত’ ক্রিয়াবিশেষণটি জুড়ে দিচ্ছি, কারণ তদন্তে এখনো সুনিশ্চিত হয়নি খুন ও ধর্ষণের স্থান, কাল, পাত্র। ওই এম-ডির ছাত্রীটির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহটিই ছিল একমাত্র সুনিশ্চিত সাক্ষ্য।
এ ঘটনাটি পশ্চিম বাংলায় কর্মরত মেয়েদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে এক বিরাট প্রশ্ন তুলে দেয়। এর একটা হলো, সরকারি হাসপাতালের মতো জায়গায় যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে মেয়েরা কোথায় নিরাপদ? এমনকি, সরকারি হাসপাতালের মতো জায়গাতেই, মৃতদেহও তো নিরাপদ নয়! তাকে ফেলে রাখা হলো, বাবা-মাকে বলা হলো প্রথমে মেয়েটি ‘খুব অসুস্থ’, তারপর সে ‘আত্মহত্যা’ করেছে, তাদের বসিয়ে রাখা হলো, অবৈধভাবে পোস্ট মর্টেম করা হলো, থানায় ডায়েরি করতে দেরি হলো, তারপর তাড়াহুড়া করে, মা-বাবার দ্বিতীয় পোস্ট মর্টেমের দাবি উপেক্ষা করে মৃতদেহ পুড়িয়ে দেওয়া হলো। যে সেমিনার রুম পুলিশ কর্ডনে নির্জন থাকার কথা, সেখানে দেখা গেল প্রচুর লোকের ভিড়, দূর-দূরান্তের লোকরা এসেছে দেখতে, যেমন করে শবের গন্ধ পেয়ে পক্ষীবিশেষের ভিড় লেগে যায়। তাহলে কি কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যগ্রতা ছিল এই ঘৃণ্য অপরাধকে লুকানোর? এর সঙ্গে শাসকগোষ্ঠীর এবং পুলিশ প্রশাসনের নামও জড়িয়ে গেল, কারণ মুখ্যমন্ত্রীর কিছু উচ্চারণ, পুলিশের স্থানীয় টালা থানার ওসি থেকে লালাবাজারের কর্তাদের আচরণও নানা প্রশ্ন তুলে ধরে।
শাসকের দায় আরও এক দিক থেকে সামনে আসে। তা হলো, এ শাসনে বেশ কিছু ধর্ষণ আর খুনের ঘটনা, কখনো শুধু ধর্ষণ, কখনো দুই-ই ঘটেছে, যার বিচারে কোনো সুরাহা হয়নি। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, ধূপগুড়ি, সন্দেশখালি ইত্যাদি স্থানের নাম ইতস্তত মনে আসছে, তালিকায় আরও আছে। এ ঘটনা বা বিচারের না-ঘটনাগুলো কি এ ধরনের অপরাধকে উৎসাহ বা প্রশ্রয় দেওয়ার একটা আবহ তৈরি করেছে? পুলিশ শাসকের দলদাস হবে, সে হয়তো স্বাভাবিক, কিন্তু শাসকপক্ষেও অপরাধীদের যোগদান ঘটেছে এবং দলের হলেই তার ‘সাত খুন’ আর ধর্ষণও মাপ-এমন মনোরম একটি বাতাবরণ কি তৈরি হয়েছে, যাতে আর জি করের ছবিটি চমৎকার খাপ খেয়ে যায়? তা হলে অপরাধটা কি শুধু ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নয়, অপরাধ শাসকের পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত এ পটভূমিকাও, এমন সন্দেহ কি করা যেতে পারে?
২.
এ থেকেই একটা আন্দোলন শুরু হলো, যা দলমতের সীমানা ডিঙিয়ে সাধারণ মানুষের বিপুল ক্ষোভকে সামনে নিয়ে এলো। তা হয়তো ওই মেয়েটির ধর্ষণ ও খুনের সুনির্দিষ্ট প্রতিবিধানের দাবি থেকে আরও বৃহত্তর একটা সমস্যায় আমাদের সরিয়ে নিয়ে গেল। জুনিয়ার ডাক্তাররা কর্মবিরতি আর ধর্নামঞ্চে অবস্থান শুরু করলেন, আর নিজেদের কর্মস্থলে সুনিশ্চিত নিরাপত্তা দাবি করলেন। সরকারের চিকিৎসা-প্রশাসন সেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে। সরকারের কিছু অসংলগ্ন উচ্চারণ-যেমন মেয়েরা রাতে ডিউটি করবে না, তাও মানুষকে খেপিয়ে তুলল। তবে কি সরকার (বেকার সমস্যা সমাধানে ভারতের দুই সরকারই ব্যর্থ) মেয়েদের কাজের ক্ষেত্রটিকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছে? এ বিষয়টি যেন আমাদের মধ্যবিত্ত গৃহস্থালিকে কাঁপিয়ে তুলল এবং চাকরিরতা, বা স্কুল কলেজের মেয়েরা, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত-সব বয়সের মেয়েদেরও উত্তেজিত করল, তারা বলল, ‘রাত্রি দখল করো, রাস্তা দখল করো’। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, সুকান্তর ভাষায় বলা যায়, ‘এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ।’ এখনো তার শেষ দেখা যাচ্ছে না, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের আলোচনার (১৬ সেপ্টেম্বর) আলোচনার পরেও। এর মধ্যে পশ্চিম বাংলার সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এ প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে, যা খুব স্বাভাবিক। কারণ এত ব্যাপক গণ-আন্দোলনের সঙ্গে সবাই জুড়ে যেতে চায়। নেতৃত্ব দিচ্ছে সাধারণ মানুষ, এইটা হলো এ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। রাজধানী কলকাতা থেকে মফস্বলেও এ আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছে। এর মধ্যে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের ‘অপরাধীর ফাঁসি চাই’ বলে মিছিলগুলো একটু অদ্ভুত রসের সৃষ্টি করেছে। কারণ মানুষের বড় আন্দোলনটি সরকারকে এ অপরাধের আংশিক দায় থেকে অব্যাহতি দিতে প্রস্তুত নয়। মনে রাখতে হবে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশ মন্ত্রী, আর তথাকথিত এক সিভিক পুলিশকে মুখ্য অপরাধী হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ধর্ষণকারীর ফাঁসি দাবি করে একটি আইন পাস করা হলেও। বলা বাহুল্য, তা এখনো রাজ্যপালের স্বাক্ষরে পাকাপাকিভাবে আইনের চেহারা নেয়নি। এর মধ্যেই সমাজকর্মীরা তার নানা ফাঁকফোকর দেখিয়ে দিয়েছেন।
৩.
আগেই বলেছি, এই আন্দোলন তিলোত্তমার বীভৎস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা থেকে আরও বড় একটা দিকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে এনেছে। দুই-ই এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন, সিবিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আমরা আশা করি, দুয়েরই একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার নিজেকে কোন্ অপবাদ থেকে রক্ষা করতে সুপ্রিমকোর্টে কপিল সিবালের মতো বহুমূল্য এক আইনজীবী এবং প্রায় দেড় ডজনের এক আইন-বাহিনী নিয়োগ করেছেন তা বোঝা দুষ্কর। তাতে রাজ্য সরকারের অবস্থানটি একটু রহস্যময় হয়ে উঠেছে, যেন তা এক পরোক্ষ ইঙ্গিত যে, তার এ ঘটনায় কিছু কৈফিয়ত দেওয়ার আছে।
অন্যদিকে এ ঘটনা রাজ্যে ডাক্তারি শিক্ষার এক বিপুল অরাজকতা ও বিপর্যয় চোখের সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা আগে ভেবেছি এবং বলেছি যে, রাজ্য সরকার সাধারণ শিক্ষা বিষয়ে দুর্নীতিকে ব্যাপকভাবে প্রশ্রয় দিয়েছে। সেটা শিক্ষক নিয়োগে বা শিক্ষকের বদলিতে হোক, আরও নানা বিষয়ে হোক। প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক থেকে স্কুল ও কলেজের সর্বস্তরে দুর্নীতি হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকের অভাবে প্রায় আট হাজারের মতো স্কুল উঠে গেছে। বিজ্ঞান শিক্ষক নেই বলে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগও বন্ধ হয়ে গেছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রচুর শিক্ষকের পদ খালি। নামেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
অন্যদিকে গণটোকাটুকি, টাকা নিয়ে পাস করানোর রমরমাও এ আমলে ঘটেছে। কিন্তু তা যে মেডিকেল শিক্ষাতেও বিস্তারিত হয়েছে, তা জেনে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি। ওই আর জি করেই নাকি শাসকদলের ছাত্রদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়, বা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে। কোনো এক উত্তরবঙ্গ লবির বিপুল প্রভাবে এই ব্যাপক দুর্নীতি বিস্তারিত হয়েছে। এ ব্যাধির সংক্রমণ আরও কোথাও কোথাও ঘটেছে কিনা কে জানে! আর জি করের আপাতত জেলবন্দি অধ্যক্ষ ও তার একটি গোষ্ঠী নাকি এই তোলার রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। স্বাস্থ্য দপ্তরও এই গোষ্ঠীটির অঙ্গুলিহেলনে চলত।
এখন আমাদের অনেক প্রত্যাশা। তিলোত্তমার কুৎসিত ধর্ষণ ও খুনে অপরাধীদের চূড়ান্ত শাস্তি হোক, মেয়েদের কর্মস্থলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হোক, আর পশ্চিম বাংলার পুলিশ-প্রশাসনের দুর্বলতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষয়রোগ আর স্বাস্থ্যশিক্ষার বিপর্যস্ত অবস্থার প্রতিকার হোক। এমন একটি সরকার থাকলে তার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত, তা হয়তো আন্দোলনকারীরা বুঝেছেন।
৪.
কিন্তু পৃথিবী থেকে এই অপরাধ কী করে দূর হবে-মানুষের বা পুরুষের এ কুকুরবৃত্তির অপরাধ? জীবনানন্দের ভাষায় ‘মানুষের ক্রমমুক্তি’ কি আদৌ ঘটবে? সে প্রশ্নের আলোচনা কবে শুরু হবে আমরা কি আদৌ জানি? তাতে মেয়েদেরও খোলা মনে যোগ দেওয়া দরকার।
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা