Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

‘মব জাস্টিস’ বনাম ‘আইনের শাসন’

Icon

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘মব জাস্টিস’ বনাম ‘আইনের শাসন’

গণপিটুনি এ দেশে অনেকটা ডাল-ভাতের মতো একটা ব্যাপার। চলতি পথে ‘ধর ধর, মার মার’ চিৎকার কানে এলেই হলো, অমনি উত্তেজিত জনতা পঙ্গপালের মতো হুমড়ি খেয়ে চড়াও হয় নিরস্ত্র লোকটির ওপর। সঙ্গে শুরু হয় চড়-কিল-ঘুসির মাধ্যমে দোষী বা নির্দোষ লোকটির বিচার বা ‘জাস্টিস’। শুরু হয় আয়েশ আর খায়েশভরা উত্তম-মধ্যম। আগে ছেলেধরা, চোর-ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহেই মূলত ঘটত গণপিটুনির ঘটনা। হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন এর শিকার হচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাবেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য বা তাদের অনুরাগীরা। এখন হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে কোথাও ‘লীগ’ (যে ‘লীগ’ই হোক না কেন!) পেলেই হলো; অমনি রামধোলাই। এমনকি সীমান্তে, আদালত চত্বরে পুলিশ পরিবেষ্টিত থাকাবস্থায়ও অনেকে এমন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। কোথাও ‘ছাত্রলীগ’ দেখলেই হলো, ছাত্র-জনতা সঙ্গে সঙ্গে খুনে মেজাজে হয়ে যাচ্ছে। এই তো গত ৭ সেপ্টেম্বর আবদুল্লাহ আল মাসুদ নামের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে ছাত্র-জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।

১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে ক্যাম্পাসেই ছাত্ররা দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করে। একই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চোর আখ্যা দিয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে তিন দফায় পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর পোড়ানো, আদালত চত্বরে তাদের চড়-থাপ্পড়, ডিম-জুতা নিক্ষেপসহ বহুমাত্রিক ‘মব জাস্টিসের’ (উত্তেজিত/উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার) ঘটনা ঘটে। তবে দেশের সেরা ও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে গণপিটুনির নামে এমন হত্যাকাণ্ড বা নির্মম ‘মব জাস্টিসের’ ঘটনা বিরল। একই সঙ্গে তা ভয়াবহ বিপজ্জনক। কারণ ছাত্রদের হাতেই এখন দেশের নেতৃত্ব। দুজন ছাত্র উপদেষ্টাসহ ছাত্র-জনতার সরকারের হাতে এখন দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের হাতে দেশে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ভার। অথচ কিছু ছাত্র এখন আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, দিন-দুপুরে মানুষ ‘খুন’ করছে, এটি উদ্বেগজনক। তর্কের খাতিরে ধরলাম, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিগত সময়ে গণপিটুনি বা এমন মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটত। কিন্তু এখন তো ছাত্রদের সরকার। সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে, কর্তৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে কেন আইন-আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো?

প্রকৃতপক্ষে গণপিটুনি ব্যাপারটি কেবল অমানবিকই নয়, সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধও বটে। বিষয়টির ব্যাখ্যা করছি। আইনের আশ্রয় লাভ, আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ, বিচার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ অপরাধী-নিরপরাধ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার [বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১, ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ]। অন্যদিকে অপরাধীকে গ্রেফতার করা পুলিশের আইনগত দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না। তাই ব্যক্তির হাতে কোনো অপরাধী ধরা পড়লে তাকে সরাসরি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে হয়। অন্যথা গুনতে হবে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। চোর, ডাকাত, ছেলেধরা বা অন্য কোনো অপরাধীকে আটক করে, পুলিশের কাছে হস্তান্তর না করে যদি তাকে আটকে রাখা হয়, তাহলে অন্য অর্থে তা পুলিশকে তার কর্তব্য পালনে বাধাদানের মতো অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে; যার শাস্তি অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড [১৮৬, ১৮৭ ধারা, দণ্ডবিধি; ৫৯ ধারা, ফৌজদারি কার্যবিধি]।

কাউকে আটকে রেখে গুরুতর ও আকস্মিক উত্তেজনাবশত যদি তাকে পিটুনি দেওয়া হয়, তাহলে কারাদণ্ডের আগের মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড তো আছেই। সেই পিটুনি দিতে গিয়ে যদি আঘাতটা গুরুতর হয়ে যায়, তাহলে আগের কারাদণ্ডের মেয়াদের সঙ্গে যোগ হবে আরও এক বছর। তখন অর্থদণ্ড হবে অনূর্ধ্ব ২ হাজার টাকা। অবশ্য এক্ষেত্রেও কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড, উভয় দণ্ডও হতে পারে [৩৩৪, ৩৩৫ ধারা-দণ্ডবিধি]।

আবার কেউ একজন অপরাধীকে (বা নিরীহ লোক) পেটাচ্ছে বা অন্য কোনোভাবে আঘাত দিচ্ছে, পেটানোর সময় বা আঘাতদানের সময় তাকে মেরে ফেলবে এমন কোনো চিন্তাভাবনা বা আশঙ্কা তার মনে কাজ করেনি; কিন্তু গুরুতর ও আকস্মিক উত্তেজনায় কাজটি করতে গিয়ে এক পর্যায়ে দেখা গেল লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে-সেক্ষেত্রে আঘাতকারীর শাস্তি হবে অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। আর এক্ষেত্রে যদি মেরে ফেলার চিন্তাভাবনা কাজ করে এবং তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে এই মেরে ফেলার কাজটি হবে দণ্ডার্হ নরহত্যা (Culpable Homicide), যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ড। সঙ্গে যে কোনো অঙ্কের অর্থদণ্ড [৩০৪ ধারা, দণ্ডবিধি]।

আইনে যৌথ দায়িত্বশীলতা (Joint Liability) বলে একটা নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন, যেন অপরাধটি তিনি একাই করেছেন। গণপিটুনিতে কোনো অপরাধী যদি মারা যায়, তজ্জন্য সবাইকে সমভাবে দায়ী করা যাবে [৩৪ ধারা, দণ্ডবিধি]।

অবশ্য গণপিটুনিদানের জন্য বা গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ার জন্য কারও সাজা হয়েছে, এমন নজির আমাদের দেশে নেই। অথচ কাজটি বেআইনি তো বটেই, সেই সঙ্গে পরিপূর্ণ দণ্ডনীয় অপরাধ। স্বীকার করছি, প্রচলিত বিচার কাঠামোতে অপরাধী সাজা পাবে না-এ আশঙ্কা থেকেই মানুষ সাজাদানের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না, এ দায়িত্ব বা ক্ষমতা আইন তাকে দেয়নি। বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা-অশ্রদ্ধা কাজ করলে যে কেউ এর সংস্কারের কথা বলতে পারে। আইন সংশোধনের দাবি উত্থাপন করতে পারে। কিংবা শান্তিপূর্ণ মিছিল-মিটিং-মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে পারে। তজ্জন্য প্রয়োজনে আন্দোলন করতে পারে। কিন্তু নিজে দণ্ডদাতা বা দণ্ড প্রয়োগকর্তা বা বিচারক সাজতে পারে না। একটি অপরাধের মূলোৎপাটন করতে গিয়ে সে পারে না আরেকটি অপরাধের জন্ম দিতে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য সমাজে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও বারবার ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। বলেছেন, ‘কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।’ কিন্তু অবস্থা তো যে লাউ সেই কদু! কে শোনে কার কথা? আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এসব কি তবে কেবল গালভরা ‘ফাঁকা বুলি’?

নতুন শাসনে শাসকের পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু শাসনব্যবস্থায় দৃশ্যমান পরিবর্তনটা কোথায়? গত দেড় মাসে আইনশৃঙ্খলার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। শেষমেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হলো। তারপরও একাধিক জায়গায় ঘটল বিচারবহির্ভূত নির্মম হত্যাকাণ্ড (গণপিটুনিতে হত্যা)। শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়; রাস্তায়, বাজারে, জনপ্রশাসন, অর্থিক খাত, শিল্প বা পোশাক খাত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের প্রায় সর্বত্র যেন বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতার প্রতিযোগিতা চলছে। সেই সঙ্গে ভিন্ন বা বিরুদ্ধমতাবলস্বী সাংবাদিক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মচারী, খেলোয়াড়, রাজনীতিকসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে, দোষী বা নির্দোষ নির্বিচারে গণহারে হত্যা মামলা! প্রত্যেক মামলায় আবার অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি। তবে ছাত্র হত্যায় সরাসরি জড়িতদের হত্যা মামলায় আসামি করা সঙ্গত।

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : প্রাবন্ধিক; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

aftabragib2@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম