Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ভারতের সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্ক গড়ে উঠুক

Icon

ড. এম জসিম উদ্দিন

প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতের সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্ক গড়ে উঠুক

পতাকা

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা সুসম্পর্ক ধরে রাখতে চাই। আমরাও চাই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত আমাদের কী দিয়েছে আর ভারতের প্রাপ্তিটাই বা কী-এ প্রশ্নটি আজ নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। একজন মিত্র কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার সাহায্যের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারেন না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করতে পারেন না। বাংলাদেশের মৌলিক মানবাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করে খুন-গুমের যে অভয়ারণ্য তৈরি করা হয়েছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে, তাতে সেই সরকারকে ভারত সরকারের সমর্থন প্রত্যেক বিবেকবান মানুষকে বিস্মিত করেছে।

এরপর মানুষ ভেবেছে, যারা স্লুইসগেট খোলার আগে প্রতিবেশীকে সামান্য তথ্য দিতে চায় না, তারা কি বন্ধু? ফেলানী, স্বপ্নাসহ হাজারও বাংলাদেশি সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছেন। এ জীবনগুলোর কি মূল্য নেই?

আন্তর্জাতিক আইনে আন্তঃদেশীয় নদীর পানির হিস্যা থেকে বহু বছর বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা, আসাম থেকে ব্যাপকসংখ্যক ভারতীয় মুসলিমকে ‘বাংলাদেশী’ বলে বাংলাদেশে পুশ করার পরিকল্পনা করা, ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথের সাম্প্রতিক ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের প্রতি নজর রাখার কথা বলে হুমকি দেওয়া, বাংলাদেশি শরণার্থীরা ব্যাপকভাবে ভারতে এসে নিরাপত্তার সংকট তৈরি করছে, এ রকম মিথ্যাচার করা কি কোনো বন্ধুত্বের পরিচয় বহন করে?

২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবে দেশে এত ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বৈরাচারমুক্ত হলাম, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার পর এরকম বিজয় দেখেনি। তাই তারা ভালোবেসে এ বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা কিংবা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলছে। বাংলার গণমানুষের এই প্রবল অনুভূতিকে ভারতের সরকার সম্মান করেনি। তারা ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবকে স্বীকৃতি দেয়নি।

একটি রাষ্ট্রে সরকার আসবে, সরকার যাবে; কিন্তু জনগণ সবসময় থাকবে। সম্পর্ক হবে ওই রাষ্ট্রের জনগণ এবং তাদের বৈধ প্রতিনিধিদের সঙ্গে, কোনো একটি পরিবার বা দলের সঙ্গে নয়। ভারতের মতো একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণের গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকারকে উপেক্ষা করতে পারে? সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র তো এমন হওয়ার কথা নয়।

ভারতের জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী সমাজ কি তাদের চোখ বন্ধ করে রেখেছিল? তারা কি কিছুই দেখতে পাননি? ভারতের সরকার, বিরোধী দল, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া এবং বাংলাদেশে ভারতের শুভাকাঙ্ক্ষী, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী যারা আছেন, তারা ভারতের এ ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

এ প্রশ্নগুলোর কোনো যৌক্তিক উত্তর থাকলে বাংলাদেশের মানুষ তা সত্যিই শুনতে চায়। তবে একটা কথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট, আর তা হলো, বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসম্মুখে বলেছিলেন, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি, তা ভারত সারাজীবন মনে রাখবে।’ এ জন্যই কি ভারতীয়রা ওই ফ্যাসিস্ট সরকারকে বারবার কারচুপির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসাতে সাহায্য করেছেন?

ভারত এবং ভারতপ্রেমীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দেবেন। বাংলাদেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। কিন্তু কৃতজ্ঞতার অর্থ কি আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেওয়া? আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত যা বলবে, তা-ই করতে হবে? বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান করে তাদের বৈধ প্রতিনিধি যারাই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করে ভারত তার যৌক্তিক দাবি বা চাওয়াগুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারত। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের তো তা বোঝার কথা।

বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, বাংলাদেশ যেমন ১৯৭১-এ স্বাধীন হয়েছে, ভারতও তার চির শত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দুর্বল করেছে। ভারতের এ প্রাপ্তি কি বিশাল নয়? ১৯৭১ সালের পর ভারত তার পূর্বদিককে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে নিরাপদ করেছে। পারমাণবিক ওয়ারহেড সংবলিত ব্যালেস্টিক মিসাইল ভারতের পূর্ব সীমান্ত থেকে ভারতের দিকে তাক করা নেই, যে মিসাইলগুলো পাকিস্তান থেকে ভারতের দিকে এখনো তাক করে রাখা আছে।

বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে ভারত সহজেই তার সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করতে পারত, যদিও বিষয়টি বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য স্পর্শকাতর। কিন্তু জোর করে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সেভেন সিস্টার্সে এক্সেস করার পরিকল্পনা কখনো ভালো পরিণতি আনে না।

ভারতীয়রা বাংলাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনা দেখেন, অথচ ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা মিলে মন্দির পাহারা দিয়েছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেই খবর প্রচারও হয়েছে। কিছু উগ্রবাদী দল যে বাংলাদেশে নেই, তা অস্বীকার করার উপায় নেই, তবে যা আছে তার চেয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য গত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রোপাগান্ডাই বেশি ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

বিজেপির নেতারা সবসময়ই বাংলাদেশে মৌলবাদী দলের উত্থান হচ্ছে বলে প্রচার করছেন। অতিসম্প্রতি ভারতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আমেরিকায় বলেছেন, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ বেড়ে গেছে। এটি দুঃখজনক যে একজন ভারতীয় তরুণ নেতাও বিজেপির লেন্স দিয়ে বাংলাদেশকে দেখছেন। তাদের এই লেন্সকে পরিবর্তন করতেই হবে, যদি বিজেপি কিংবা কংগ্রেস বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চান।

গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের মানুষ কোনো ধর্মীয় দলকে ক্ষমতায় বসায়নি, এটাই বাস্তবতা ও প্রমাণিত। বাংলাদেশের সংসদের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস ও আসন সংখ্যা দেখলেই তা প্রমাণিত হয়। তবে বাংলাদেশের মৌলবাদ এবং ধর্মীয় দল নিয়ে ভারতের প্রোপাগান্ডা, ধর্মীয় রাজনৈতিক দল জামায়াত, হেফাজত এবং বিভিন্ন সময়ে আলেমদের ওপর ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নির্যাতনের ফলে ইসলামিক দলগুলোর প্রতি মানুষের সহানুভূতি নিঃসন্দেহে বেড়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে যার প্রতিফলন ঘটতে পারে।

বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব বেড়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর এর পেছনে কারণ ঘটিয়েছে মূলত ভারতই। ভারতের জ্ঞানী সমাজকে ভাবা উচিত কেন আজকে দক্ষিণ এশিয়ার শেষ রাষ্ট্রটিও (বাংলাদেশ) ভারতের কাছ থেকে দূরে সরে গেল? ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বৃহৎ রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও এখন অনেকটা নিঃসঙ্গ। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান-এই পাঁচটি দেশের সঙ্গে ভারতের বর্তমানে আস্থার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, পাকিস্তান তো ভারতের শত্রু রাষ্ট্র, ভুটানের সঙ্গেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভারতীয় নেতাদের উচিত ছোট প্রতিবেশীদের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নেওয়া।

রাজনাথ সাহেবরা হুমকি দিতে পারেন; কিন্তু বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের নায়করা, যারা জেন-জি বলে খ্যাত, যারা রাজনীতি আর দেশকে নিয়ে তেমন একটা ভাবতই না, তারাই একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, একটি শক্তিশালী ফ্যাসিস্ট সরকারকে ১৫ দিনেই উৎখাত করেছে। তারা জানত ভারতের মতো বৃহৎ শক্তি ফ্যাসিস্ট সরকারের পেছনে ছিল। কিন্তু কোনোকিছুই তাদের থামাতে পারেনি, ছাত্র-জনতা এক হয়ে ফ্যাসিস্টকে উৎখাত করেছে। আশা করব, আগামী দিনগুলোতে ভারতের সঙ্গে আমাদের মর্যাদার সম্পর্ক গড়ে উঠবে।

ড. এম জসিম উদ্দিন : সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ পলিটিক্যাল সাইন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; মেম্বার, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম