Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নতুন বাংলাদেশের এক মাস ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি

Icon

এম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন বাংলাদেশের এক মাস ও রাজনীতির গতিপ্রকৃতি

ফাইল ছবি

৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর। অন্ধকার যুগ অবসানের এক মাস। একেবারেই ভিন্নরকম আবহ। সহস্রাধিক জীবনের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতার মাসপূর্তি। দুর্বিনীত নিষ্ঠুর শাসক শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশের প্রথম মাস। দীর্ঘ ষোলো বছরান্তে রাজনীতির বাইরের মানুষরা চালকের আসনে। প্রায় অচল রাষ্ট্রযানের স্টিয়ারিংয়ে হঠাৎ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের। তবু থেমে থাকার সুযোগ নেই। এগোতেই হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের ছাই থেকে সোনা ফলানোর দায় পড়েছে। বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ এরই মধ্যে চোখ রাঙালেও ভড়কে যাননি গণমানুষের আস্থাভাজন মানুষগুলো। বরং দৃঢ়-দৃপ্ত পদক্ষেপে এগোচ্ছেন অদম্য তারুণ্য শক্তির সাহসে ভর করে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন তাদের বাড়তি পাওয়া।

গেল মাসের প্রতিটি দিনই ছিল আশা-নিরাশা আর উৎসাহ-উৎকণ্ঠার দোলাচলে মিশ্র। একদিকে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তির প্রহর গুনতে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সময়। মন খুলে কথা বলা, স্বাধীন চিন্তা ও নির্ভয়ে পথচলার নতুন দিন। অন্যদিকে অভাবনীয় জনবিস্ফোরণের মুখে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জন্য অকল্পনীয় দুঃস্বপ্ন ও অমানিশার সূচনাকাল। নেতাকর্মীদের অকূল দরিয়ার মাঝে রেখে প্রাণভয়ে পালিয়েছেন ক্ষমতাদর্পী কথিত লৌহমানবী। সঙ্গী করেছেন কেবল নিজের সহোদরাকে। কাউকে কিছু বলে যাননি, কয়ে যাননি। মহাবিপর্যয়ের আকস্মিকতায় হতবিহবল সবাই। দলটির প্রথম সারির সব নেতা ডিপ আন্ডারগ্রাউন্ডে। মাঠকর্মীরা আতঙ্কে দিশেহারা।

ছাত্র-জনতার গণবিপ্লব-উত্তর নতুন বাংলাদেশের পালে এখন নতুন হাওয়া। যদিও হিমালয়সম চ্যালেঞ্জ আছে বিশ্বনন্দিত নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। পরাজিত শক্তি নানা রূপে, হরেকরকম বাহানায় হুমকি ও প্রচণ্ড চাপে ফেলতে চাইছে তাদের। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কেবলই যাত্রা শুরু করেছেন। মধুচন্দ্রিমাকাল বলা যায়। এরই মধ্যে দাবির বিশাল বহর নিয়ে হাজির নানা গোষ্ঠী, সঙ্গে আক্রমণাত্মক ও যুদ্ধংদেহী ভাব। পতিতদের নকশায় প্রতিবিপ্লবের অপচেষ্টাও হয়েছে বারকয়েক।

এদিকে আকস্মিক শৃঙ্খলমুক্ত রাজনীতিতেও চোখে পড়ছে নতুন সব উপসর্গ। সহযাত্রী রাজনীতিকরা পা বাড়াচ্ছেন শত্রুতার কণ্টকাকীর্ণ পথে। বিজয় উদযাপনের উপাদানে সংযমের সংকট দিচ্ছে নতুন বার্তা। পার্শ্বক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অভ্যুত্থানে সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখা দলগুলোকে। মাঠ সামলাতে হিমশিমে শীর্ষ নেতৃত্ব। বহুমাত্রিক চাপে সতর্কবার্তা দিয়ে বলতে হচ্ছে-‘এখনই আত্মতুষ্টি নয়, বিজয় কিন্তু এখনো অনেকদূর।’ আরেক দলে ভাব ফুরফুরা। নেতাকর্মীরা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে বেসামাল। ক্ষমতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আভাস দিচ্ছেন তারা।

হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে নতুন সরকার কাজ করছে দিন পঁচিশেক ধরে। এরই মধ্যে লুটেরা ও গণহত্যায় জড়িতদের পাকড়াও করা হয়েছে। দানবিক রাষ্ট্র তৈরির অনেক কারিগর খাঁচাবন্দি হয়েছেন। এখনো চলছে। দুর্নীতির বরপুত্র রাঘববোয়ালরা আটকা পড়তে শুরু করেছে দুদকের জালে। কুখ্যাত আয়নাঘরের অনেক বন্দি নতুন জীবনে ফিরেছেন। কারামুক্ত হয়েছেন আওয়ামী শাসনের রাজবন্দিরা। নিপীড়নমূলক অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বিপর্যস্ত বিচারব্যবস্থা পুনর্গঠন হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বৈরতন্ত্রের লাঠিয়ালমুক্ত হয়েছে।

ভঙ্গুর অর্থনীতিতে গতি ফিরতে শুরু করেছে। দলবাজিতে নাজুক প্রশাসনযন্ত্র মেরামত হচ্ছে। বাজারে খানিকটা হলেও স্বস্তি মিলছে। জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছে। পরিবহণ ও বাজারঘাটে চাঁদাবাজি সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ হয়েছে। ফ্যাসিবাদের খুঁটিগুলো উপড়ে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথনকশা তৈরির কাজ চলছে। রাষ্ট্র সংস্কারের ফর্মুলা আসছে নানা মহল থেকে।

দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারতের পানি আগ্রাসনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার-জনগণ একাট্টা হয়ে নয়া দৃষ্টান্ত রেখেছে। কূটনীতিতে সুবাতাস বইছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সম্মানে আরব আমিরাত মুক্ত করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমর্থনকারী ৫৭ জেলবন্দি বাংলাদেশিকে। বলা যায়, সবকিছু মোটামুটি ইতিবাচক ধারায় এগোচ্ছে। যদিও আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে সংশয় ও শঙ্কা দানা বাঁধছে।

আসলে দেশের মানুষের রাজনীতিজ্ঞান সম্পর্কে কতিপয় রাজনীতিকের ধারণা নিতান্তই সেকেলে হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ যে এখন অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন এবং গণতান্ত্রিক চেতনাবোধসম্পন্ন, তা অনেকেই হয়তো এখনো ঠাওর করে উঠতে পারেননি। কথামালার রাজনীতি এখন আর জনসাধারণকে আকৃষ্ট করতে পারে না। রাজনৈতিক চাতুর্য, গলাবাজি এখন বেশিরভাগ মানুষকে বিরক্ত করে। তারা এখন কথা আর কাজ মিলিয়ে দেখতে চান। অতীত ও বর্তমানকে পাশাপাশি রেখে বিচার-বিশ্লেষণ করতে চান।

ক্ষমতার মোহ এখন জনগণের কাছে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। মসনদে টিকে থাকার তীব্র কামনা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা-এ দুই প্রবণতার আসল রহস্যও এখন জনগণের কাছে একদম ফকফকা। যে কারণে রাজনৈতিক স্লোগান বা চমক এখন আর আগের মতো মানুষকে আলোড়িত করতে পারে না। মানুষ এখন সবকিছু তলিয়ে দেখতে চান, বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করতে চান। এই যে রাজনৈতিক বিবর্তন, তারই ফল ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট বিপ্লব। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ভান-ভনিতা, নাটুকেপনাসহ নানা ছলচাতুরী মানুষ খুব সহসাই ধরে ফেলেছিল। এর ফলে প্রথম সুযোগেই কুপোকাত করে দিয়েছে। দেশ ছাড়ার মতো চরম অবমাননা ও গ্লানিকর পথে হাঁটতে বাধ্য করেছে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতিই কেন্দ্রীয় বিষয়। রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই সবকিছু আবর্তিত হয়ে থাকে। দেশের রাজনীতি যখন ক্ষুদ্র হীনস্বার্থ চরিতার্থের মাধ্যম হতে গিয়ে সন্ত্রাস ও কালোটাকার হাতে জিম্মি দশায় পতিত হয়েছে; ঠিক তখনই জনগণের রাজনীতি-ভাবনায় সূচিত হচ্ছে বিবর্তন। সদ্য-পতিত একনায়কের সময়ে যে একের পর এক নৃশংসতা ও বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে, সারা দেশের মানুষ যে ভীষণ সন্ত্রস্ত-আতঙ্কিত ছিল, তার উৎস খুঁজতে গেলেও দেখা যাবে একদেশদর্শী রাজনীতি। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই এসব হিংসাত্মক ও বীভৎস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা অতি সহজেই নিজেদের আড়াল করতে পারে।

অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পালাবদলের পরও জনমনে স্বস্তির জায়গা তৈরি হতে সময় লাগছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততায় খুনখারাবি, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও নৃশংস ঘটনা আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে। রাজনৈতিক সরকারের সময় সন্ত্রাসের বিস্তৃতির দায় প্রধানত শাসকগোষ্ঠীর ওপর বর্তায়। জনগণের ওপর এর কোনো দায় পড়ে না। কেননা, জনগণ সন্ত্রাসের জন্ম দেয় না, লালনও করে না। সন্ত্রাসকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করেন রাজনীতিকরা, বিশেষত শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু অরাজনৈতিক সরকারের সময়ে যখন সন্ত্রাস চলমান থাকে, তার দায় কাদের? সে দায়ও রাজনীতিকদেরই নিতে হবে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া সন্ত্রাসীদের মাথা তোলার উদাহরণ কম। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোর তো মাঠপর্যায়ে কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। সন্ত্রাসী লালনেরও সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোই পারে সন্ত্রাসের রাজত্বমুক্ত দেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে।

আগামী নির্বাচন কবে হবে, কীভাবে হবে সেটাই সামনের রাজনীতির মূল বিষয়। আদালতের মাধ্যমে কি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে? সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সশরীরে নেই। তবে আছে তাদের কালোছায়া। এ সময় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপির সামনে ক্ষমতার হাতছানি যেমন আছে, তেমনি আছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। আবার জামায়াত ও অন্যান্য দলের ক্ষমতাপ্রত্যাশা বাড়ছে। পতিত আওয়ামী লীগের বিপরীতে এসব রাজনৈতিক দলে নিজেদের মধ্যকার আস্থাহীনতা, বিতর্ক, বিরোধ বা সংঘাতই সামনের দিনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় আঘাত হানতে পারে। সেক্ষেত্রে অস্তিত্ব সংকটে পড়া আওয়ামী লীগের পুনর্বাসিত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি রাজনৈতিক অধিকার হারানোর পটভূমি তৈরি হতে পারে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়।

সবার স্মরণ রাখা দরকার, মানুষের এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সন্ত্রাস, সহিংসতা, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ যেসব বিষয় জনভোগান্তি ডেকে আনে, সেসবের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় অপরাজনীতি। রাজনীতি যখন সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ওপর ছত্রছায়া বিস্তার করে, তখন তা মহামারির রূপ নেয়। করুণ পরিণতি ডেকে আনে। তার প্রমাণ তো তরতাজা।

আবার ব্যক্তিবিশেষের সুন্দর-সাবলীল বয়ান, কৌশলগত দরদি তৎপরতাই ভোটের রাজনীতির একমাত্র উপাদান নয়, সেটাও মনে রাখতে হবে। দেশবাসী বিবেচনা করবে, উদার গণতান্ত্রিক ও উন্নয়নমুখী রাজনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ক্রিয়াশীল গণমুখী রাজনীতি। রাষ্ট্রপরিচালনায় সক্ষমতা, জানমালের নিরাপত্তা, ন্যায়-নীতির প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নতির নিশ্চয়তা কীভাবে মিলবে, সেটাও তারা দেখবে। এসবে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া সবার জন্যই জরুরি।

এম আবদুল্লাহ : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম