শতফুল ফুটতে দাও
রেখে যাওয়া ঋণের আবর্ত থেকে বের হওয়া যাবে কি?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। যে কোনো দেশের সরকারের জন্য ঋণের উৎস ২ ধরনের-অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক। বিগত বছরগুলোয় আওয়ামী লীগ সরকার যে ঋণ করেছে, তার বেশিরভাগ অংশ এসেছে দেশীয় উৎস থেকে। দেশীয় উৎসের মধ্যে বেশিরভাগ ঋণ করা হয়েছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, পদত্যাগের সময় শেখ হাসিনার সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে। এ ঋণ পরিশোধের দায় বর্তেছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। শুধু যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ ঋণের দায় বহন করতে হবে তা নয়, পরবর্তীকালে যেসব সরকার আসবে, তাদেরও এ দায় বহন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেষ বিচারে এ ঋণের বোঝা দেশের জনগণকেই বহন করতে হবে। ব্রিটিশশাসিত উপনিবেশে ভারতের কৃষকদের সম্পর্কে বলা হতো They are born in debt, live in debt and die in debt. আজ বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, এ দেশে যেসব শিশুর জন্ম হয়, তাদের মাথার ওপর থাকে বিপুল ঋণের বোঝা। জীবদ্দশায় সে ঋণের বোঝা টেনে চলতে হয় এবং মরণেও সম্ভবত এ ঋণের দায় থেকে নিষ্কৃতি মেলে না। একটি প্রাণবন্ত জাতির জন্য এরকম ঋণের বোঝা কতটা অ-বহনযোগ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা ভাবতেও গা-শিউরে ওঠে।
কতটা ঋণ নেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ না থাকার ফলে দেশীয় উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিতে হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বিদেশি মুদ্রায় ঋণ করার পক্ষপাতী। গত ১৫ বছরে বিদেশি ঋণও নেওয়া হয়েছে। বিদেশি ঋণও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি তা প্রয়োজনীয় বিচার-বিবেচনা না করে নেওয়া হয়। শেখ হাসিনার সরকার যেসব বিদেশি ঋণ করেছে, তা অনেকাংশেই ছিল কঠিন শর্তের নিগড়ে বাঁধা। এ ছাড়া যথার্থ দরকষাকষি ও বাছবিচার না করার ফলে সরকারের দায়-দেনা পরিস্থিতি সহন ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার অবস্থায় পড়েছে। অর্থ বিভাগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। এ থেকে দেখা যায়, মোট ঋণের স্থিতি ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ঋণের হিসাব হাল নাগাদ করা হয় প্রতি ৩ মাস অন্তর। সেই হিসাবে মার্চ, জুন শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে ঋণের দেশি অংশ হবে ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, আর বিদেশি অংশ হবে ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১১৮ টাকা দরে হিসাব করলে তা ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়। তবে বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে প্রতি ডলারের মূল্য ১২১ টাকা। সুতরাং, দেশীয় মুদ্রার মূল্যে বিদেশি ঋণ কিছুটা ওঠানামা করবে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের যে স্থিতি ছিল, তা দেশের ৩টি বড় বাজেটের মোট বরাদ্দকৃত অর্থের সমান। এ যখন পরিস্থিতি, তখন বাজেট প্রণয়ন দুরূহ হয়ে উঠবে। বাজেট বরাদ্দের পরিমাণে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে আরও ঋণ করতে হবে, অর্থাৎ বাজেটারি সাপোর্টের প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ঋণসংক্রান্ত এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন থেকে। ২০ আগস্ট ২০২৪ পত্রিকাটিতে ‘১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণ রেখে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ১৫ বছরে ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬ গুণ। এসব ঋণ সরকারি ও সার্বভৌম নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ঋণ হিসাবে পরিচিত। ঋণগুলো চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। ঋণ নেওয়া, ঋণের সুদ দেওয়া, আসল পরিশোধ করা, আবার ঋণ নেওয়া বিষয়টি এমনভাবে চলতে থাকে। তবে এ ব্যাপারে সাবধানবাণী হলো, ঋণ গ্রহণ যদি অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তাহলে খেলাপি অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থাকে ঋণের সংকট বা ডেথ ক্রাইসিস বলা হয়। অতীতে মেক্সিকোসহ বেশকিছু দেশকে ঋণ সংকটে পড়তে দেখেছি। হাল আমলে আমরা শ্রীলংকার সংকটও প্রত্যক্ষ করেছি। স্থিতি হিসাবে উল্লেখ করা অর্থ ভবিষ্যতে পরিশোধ করতে হবে। ডিসেম্বর শেষে ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকার দেশি ঋণের মধ্যে শুধু ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৫ লাখ ২৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। বাকি ঋণ নেওয়া হয়েছে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বিপরীতে। সঞ্চয়পত্র ও সাধারণ ভবিষ্যৎ তহবিলের বিপরীতেও আছে বড় অঙ্কের ঋণ।
অর্থ বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেও দেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। ওই সময় আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল। এরপর ৬ বছরের মধ্যে এ ঋণ বেড়ে ৩ গুণ হয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার যখন লাগামহীনভাবে ঋণ করে, তখন বেসরকারি খাতের ঋণপ্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে। এর ফলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য ঋণ পায় না। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে কয়েকটি অলিগার্ক গোষ্ঠী ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করে। এরা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করে পরিশোধ না করার জন্য। এরা ভালো কিছু ব্যাংক দখল করে ব্যাংকগুলোকে পঙ্গু করে ফেলে। শুধু তাই নয়, রি-শিডিউল করার নামে এমনসব নিয়ম চালু করা হয়, যার ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও ঋণখেলাপি হতে হয় না। এর ফল দাঁড়িয়েছে বেশকিছু ব্যাংকের রুগ্ণ হয় পড়া। অবশ্য আলোচ্য সময়ে পদ্মা ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংক সৃষ্টি হয়েছিল সাধারণ মানুষের জমাকৃত অর্থ লুটপাট করার জন্য। বেশকিছু ব্যাংকের অ্যাডভান্স টু ডিপোজিট রেশিও এতটাই নেতিবাচক অবস্থায় পড়েছে, যার ফলে ডিপোজিটারদের চেকের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ওই সময় দেশি ঋণের তুলনায় বিদেশি ঋণের স্থিতি বেশি ছিল। এক কথায় বলা যায়, রাষ্ট্রীয় ঋণ পরিস্থিতি সন্তোষজনক ছিল। একদিকে মোট ঋণ পরিমাণ কম এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় বিদেশি ঋণ বেশি। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়, তখন গোটা ঋণ পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। বলা হতে পারে, এ সময় জিডিপির আকারও বেড়েছে। তবে সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের এক সময়ের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল পরিসংখ্যান নিয়ে কারচুপি মন্ত্রণাদাতা হয়েছিলেন বলে কোনো কোনো সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ নিয়েও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
বিপুল ঋণ নেওয়ার ফলে আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হার বেড়েছে। দুই বছর আগেও সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদ হার ছিল ১ থেকে ৬ শতাংশ। বর্তমানে গড় সুদ হার ১২ শতাংশ। সঞ্চয়পত্র নতুন করে বিক্রি হচ্ছে কম। তবে এর বিপরীতে আগের নেওয়া ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদের হার আগের তুলনায় কমানো হয়েছে। যারা সঞ্চয়পত্র কেনেন, তাদের একটি বড় অংশ পেনশনে যাওয়া চাকরিজীবী। সুদের হার কমে যাওয়ায় এবং মূল্যস্ফীতির ফলে এদের পক্ষে জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়ছে। এদিকটিও বিবেচনায় থাকা উচিত। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে দেশি ঋণের সুদই ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আসলের হিসাব এখানে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বুঝতে হয়, পরিস্থিতি কত সঙ্গীন হয়ে উঠেছে।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশের ভেতর ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি ঋণ সস্তা, সুদের হার কম এবং পরিশোধের জন্য লম্বা সময় পাওয়া যায়। বিদেশি ঋণের জন্য দরকষাকষির সক্ষমতা থাকতে হয়, অন্যদিকে নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। সেই তুলনায় চাহিবামাত্র দেশি ঋণ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের ঋণ করার এ সহজ পন্থা বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগ সরকার যে ঋণ করেছে, তার সিংহভাগ ব্যয় করেছে বড় বড় মেগা প্রকল্পে। এসব মেগা প্রকল্পের বেশিরভাগই অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত। অবকাঠামোর অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য এমন যে, এ খাতে একসঙ্গে বিরাট অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু এ বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন বা আয় আসে ধীরগতিতে। এর পাশাপাশি রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হলো, প্রতিটি মেগা প্রকল্পে যে ব্যয়ের অংশ দেখানো হয়েছে, তার অর্ধেক কিংবা এক-তৃতীয়াংশ অর্থে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল। প্রকল্পগুলোর ব্যয় অবিশ্বাস্যভাবে বেশি হওয়ার ফলে এগুলো অর্থনৈতিকভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে গাড়ি চলে কম। অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে মেগা প্রকল্পগুলোর পেছনে করা ঋণের সুদ অনেক বেশি পরিমাণে পরিশোধ করতে হবে। কিস্তির পরিমাণও হবে বেশি। যে বা যারা জাতির ওপর এমন ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। অন্যথায় পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসা শাসকরা একই ধরনের সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ করবে। এমনটাই আমাদের অভিজ্ঞতা। একটি বিদেশি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রূপপুর আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা ৫০০ কোটি ডলার বখরা হিসাবে নিয়েছে। কী ভয়াবহ ব্যাপার! এভাবে যদি অন্য প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রের দেউলিয়া হওয়া আর কতদূর? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে রুশ অর্থায়নে। বখরার টাকা রুশরাই দিয়েছে। তবে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত এ খবরটিকে বানোয়াট বলে মন্তব্য করেছেন। তার পক্ষে এমন মন্তব্য করাই স্বাভাবিক। কারণ, এ অন্যায় লেন-দেনের জন্য রুশ জনগণের কাছে তাদের সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। সত্য হোক কিংবা মিথ্যা হোক, বিষয়টি নিয়ে গভীর তদন্ত হওয়া উচিত। জাতি প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ