কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার কেমন হওয়া উচিত
ড. মো. মহান উদ্দিন
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শহিদ আবু সাঈদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজ একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাল ধরেছেন, সবার সহযোগিতায় চেষ্টা করছেন ঘুণে ধরা, থমকে যাওয়া শাসনব্যবস্থার চাকা মজবুতভাবে চালু করতে। সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান। নাটকীয় পরিবর্তন চলেছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈষম্য লালনকারী নেতৃস্থানীয় পদগুলোয়। ব্যাংকগুলোর অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগে বাধ্য করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গভর্নরও পরিবর্তন হয়েছেন। নতুন গভর্নর একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তি। ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির মূল উৎপাটন চলছে। ব্যাংক কমিশন গঠন করা হচ্ছে। আর্থিক দুর্নীতির শ্বেতপত্রের কাজ শুরু হচ্ছে। ক্রমইে স্পষ্ট হচ্ছে, বেশিরভাগ কুশাসনের মূলে কাজ করেছে আর্থিক দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এতে অংশ নিয়েছে ব্যাংক, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার, রাজস্ব বিভাগ এবং এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। তাই দেশের আর্থিক খাত, বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনের কিছু বিষয় নিয়েই আজ কথা বলা যাক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনের একটি বড় উপাদান হলো স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। প্রথমটি, তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি প্রায়ই আলোচনায় আসে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য এ স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নে আজ পর্যন্ত যা হয়েছে, তা দুই কদম এগিয়ে তিন কদম পেছানোর মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২-এর ১০, ১৫, ৭৭ ও ৮২ ধারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নির্ধারণ করে। এ আদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত হলেও গভর্নরের নিয়োগ, পুনর্নিয়োগ, এমনকি অপসারণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ এবং পর্ষদ বাতিলের ক্ষমতাও সরকারের। সরকারের অনুমোদনেই এর কর্মীদের বাজেট, বেতন, ক্ষতিপূরণ, ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। আইএমএফ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য এর কার্যপদ্ধতি উন্নয়নের সুপারিশ করে। ২০২৩ সালের আগস্টের পরিদর্শনের ভিত্তিতে ২০২৪-এর জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইনি সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় আইনি সংশোধনের সুপারিশ করে। সেখানে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংকগুলোর সুশাসন কেমন, সে ব্যাপারে কম-বেশি আমরা সবাই জানি। নিয়ন্ত্রক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্ধারিত ভূমিকা কতটুকু পালন করতে পেরেছে, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। রিজার্ভ চুরির কেলেংকারি থেকে শুরু করে ব্যাংক মার্জারসহ সরকার-প্রভাবিত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথাও সর্বজনবিদিত। এসবের পেছনে কত শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেছে, তা বলাই বাহুল্য। প্রশ্ন আসতেই পারে, আজ পর্যন্ত কি কোনো গভর্নর অথবা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সরকারের পছন্দ বা ইচ্ছার বাইরে নিযুক্ত, অপসারিত অথবা পুনর্নিযুক্ত হয়েছেন? স্বাধীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ না করায় যেসব অনাচার আমরা দেখেছি, তার মধ্যে রয়েছে দুর্বল ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে না চাওয়া বা না পারা, অপ্রয়োজনীয় ব্যাংক অনুমোদন, দুর্বল ব্যাংকের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা সময়মতো না নেওয়া এবং সরকারের প্রভাবে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো না হলেও সরকারকে অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া। এ প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা উপরোক্ত প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারত, যদি নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা থাকত। তাহলে কি স্বাধীনতা যত বেশি দেওয়া যায়, ততই ভালো? পরম স্বাধীনতা? সেটা আরেকটা বড় আলোচনার বিষয়। তবে এক কথায় উত্তর হলো, পরম স্বাধীনতার প্রয়োজন না থাকলেও দরকার যথেষ্ট স্বাধীনতা। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তুলনামূলক অধিকতর স্বাধীনভাবে কাজ করে, সেসব দেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় থাকে, ব্যাংক খাত অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপ্রবণ হয় এবং অধিকতর অর্থনৈতিক সাম্য বজায় থাকে। স্বাধীনতার এ সুফলগুলো আরও সুসংহত হয় কার্যকর আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের মাধ্যমে।
কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটুকু স্বাধীন তা মাপার জন্য অর্থনীতিবিদরা একটি আন্তর্জাতিক মানের ইনডেক্স তৈরি করেছেন-‘সেন্ট্রাল ব্যাংক ইনডিপেনডেন্স এক্সটেন্ডেড ইনডেক্স’ বা সিবিআইই ইনডেক্স। এর মান ০ (শূন্য) থেকে ১-এর মধ্যে। ০ নির্দেশ করে একেবারেই স্বাধীনতাহীনতা আর ১ নির্দেশ করে পরম স্বাধীনতা। কোনো দেশের ইনডেক্সটির মান যত বেশি ১-এর কাছাকাছি, তত বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করে সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উদাহরণ হিসাবে সর্বোচ্চ সিবিআইই ইনডেক্সধারী কয়েকটি দেশ হলো-ফ্রান্স, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও বেলজিয়াম। এ পাঁচটি দেশের প্রতিটির ইনডেক্সের মান ০.৯১। দেখা যাক সর্বনিম্ন সিবিআইই ইনডেক্সধারী পাঁচটি দেশ কোনগুলো-জাপান, হাইতি, কিউবা, ভিয়েতনাম ও ম্যাকাও; যাদের ইনডেক্সের মান যথাক্রমে ০.৩৭, ০.৩৭, ০.৩৫, ০.৩০ ও ০.২৭। বাংলাদেশের সিবিআইই ইনডেক্সের মান হলো ০.৫৪। র্যাংকিং করলে দেখা যায়, ১৫৫ দেশের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩১তম।
বাংলাদেশ ব্যাংককে যদি আমরা স্বাধীন ও প্রভাবমুক্তভাবে দেশের স্বার্থে কাজ করতে দিতে চাই, তাহলে নিশ্চিত করতে হবে এর বহুমাত্রিক ও টেকসই সুশাসন। এক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হলো এ প্রতিষ্ঠানের গভর্নর ও পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের নিয়োগ/নির্বাচন, মেয়াদ, পুনর্নিয়োগ, অপসারণ এবং তাদের অন্যান্য সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধিবিধান। দরকার বেশকিছু সুদূরপ্রসারী, সুচিন্তিত ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত। প্রথমত, গভর্নর নিয়োগে বা পরিচালনা পর্ষদ গঠনে সরকারের ভূমিকা শূন্য না হলেও নগণ্য করতে হবে। তাতে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকারের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এমন ব্যক্তির হাতে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ এড়ানো সম্ভব হবে। তাছাড়া সরকারের স্বাচ্ছন্দ্যের তুলনায় দেশের সার্বিক স্বার্থকে অগ্রাধিকারে রাখা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদকালের সঙ্গে গভর্নর বা পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদকালের অধিক্রমন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এরূপ অধিক্রমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব সময়ের বিচারে কমাতে সাহায্য করবে। তৃতীয়ত, পুনর্নিয়োগ যথাসাধ্য এড়াতে হবে। পুনর্নিয়োগের সম্ভাবনা বেশি থাকলে স্বার্থের সংঘাত বেড়ে যেতে পারে। তাই খুব প্রয়োজনীয় এবং সার্বিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে না হলে এটা এড়ানোই ভালো। চতুর্থত, গভর্নর বা পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের অপসারণ বস্তুগত বা পক্ষপাতশূন্য মানদণ্ডের ভিত্তিতে হতে হবে, মনোগত বা বিষয়গত মানদণ্ডে নয়। আর এসব মানদণ্ড হতে পারে শুধু সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিগত অসদাচরণ কিংবা কোনোভাবে ওই পদের নির্ধারিত যোগ্যতা হারানো সম্পর্কিত। যদি কোনোভাবে তাদের অপসারণের মানদণ্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতিনির্ধারণের সময় অপসারণের সম্ভাবনা তাদের প্রভাবিত করতে পারে। পঞ্চমত, গভর্নর বা পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের সরকার, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা স্বার্থের সংঘাত উদ্ভব হয় এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকা যাবে না। এসব দিক যদি সংবিধিবদ্ধভাবে মেনে চলা যায়, তাহলে অন্তত গভর্নর ও পরিচালনা পর্ষদের তথা নেতৃত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে পারবে এবং সুশাসনের পাশাপাশি সার্বিকভাবে আর্থিক দুর্নীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
যে কোনো প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্ব নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সংস্কার অগ্রাধিকারযোগ্য। এক্ষেত্রে সফল হলে পরবর্তীকালে এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাধীনতা, জবাবদিহিতা, কার্যপদ্ধতি ও প্রয়োজনীয় কার্যসীমা নির্ধারণেও কার্যকর সংস্কার আনতে হবে। সুশাসন আসবেই আমাদের আর্থিক খাতে। ভবিষ্যতে আমাদের পাচার হওয়া টাকা ফেরতের জন্য অন্য দেশের সহযোগিতা চাওয়ার প্রশ্নই উঠবে না। আর আর্থিক সুশাসন হবে আমাদের অন্যসব খাতে সুশাসনের প্রধান প্রভাবক ও পরিপূরক। এটাই আজ সবার চাওয়া।
ড. মো. মহান উদ্দিন : অধ্যাপক, স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।