Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

গুম-খুনের রাজনীতি বন্ধ হোক চিরতরে

Icon

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গুম-খুনের রাজনীতি বন্ধ হোক চিরতরে

প্রতীকী ছবি

গত ৬ ও ৭ আগস্ট ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান, সাবেক সেনা অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা কথিত গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশে গুম-খুনের বিষয়টি আবার সামনে আসে। রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হওয়া ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা দীর্ঘ পাঁচ বছর তিন মাস এবং ব্যারিস্টার আহমেদ বিন কাসেম আরমান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী দীর্ঘ আট বছর পর অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পান। ‘মানবতাবিরোধী’, ‘সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যকলাপে ‘জড়িত’-এ অজুহাতে তাদের বিনা বিচারে তথাকথিত বন্দিশালায় আটক রাখা হয়েছিল। আটক ব্যক্তিরা বিনা বিচারে কদর্য অবস্থায় বন্দিদশা কাটিয়েছেন বলে তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এভাবে কাউকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক রাখা একই সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মনবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং মানবতার পরিপন্থি। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে তৈরি এ ধরনের গোপন বন্দিশালায় রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষকে। আলো-বাতাসহীন কক্ষ, সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে ফ্যান চলে, যার নেপথ্যে যেন থমকে থাকে অবিমিশ্র ঘৃণা ও আতঙ্ক। সদ্যবিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বলপূর্বক গুমের শিকার সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিমের অন দ্য রেকর্ড অ্যাকাউন্টের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজ একটি অনুসন্ধানী হুইসেল ব্লোয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আটক ব্যক্তিরা সেখানে বলেছেন, তাদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগারের ভেতরে রাখা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে কমপক্ষে ১৬টি কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে বলে ভারতের জি নিউজ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও বেশ কিছু নির্যাতন ও আটক স্থান থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

অস্বীকার করার উপায় নেই, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বী নিখোঁজ হন, কোথাও তাদের খোঁজখবর পর্যন্ত ছিল না। নিখোঁজের ওই তালিকা থেকে সেনাবাহিনীর লোকজনও বাদ পড়েননি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হন ৩৪৪ জন। তাদের মধ্যে ৪০ ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আর ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেফতার অবস্থায় পাওয়া গেছে। আইন ও মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০৩ ব্যক্তি এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয়, এসব মানুষকে গুম করে রাখা হতো তথাকথিত সেই বন্দিশালায়। গণমাধ্যম মারফত জানা যায়, মীর আহমদ বিন কাসেম, আবদুল্লাহিল আমান, মাইকেল চাকমা ছাড়াও এ ধরনের গুমখানায় যারা বন্দি থেকেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় প্রমুখ।

দেশে গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা একটা সময় ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করেন। যাদের পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে সরকারি সংস্থা কর্তৃক বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন, তারা ওইসব ঘটনাকে সামনে আনার জন্য সৃষ্টি করেন এ সংগঠন। ২০২৪ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার বছর ২০০৯ সাল থেকে তার পতন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০০টিরও বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, এ ধরনের বন্দিশালা থেকে খুব কমসংখ্যক বন্দিই মুক্তি পেয়েছেন। তবে কিছু বন্দিকে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়। অনেকেই আবার এনকাউন্টারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, এ ধরনের ঘটনার তদন্ত হয়নি বললেই চলে। আবার গোপন বন্দিশালায় রাখা অনেকেই দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে মারা গেছেন, তারপর তাদের লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হতো, তাদের খাতা-কলমে কোনো তথ্যও রাখা হতো না। আর যারা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ছিলেন, তারাই মূলত এ ধরনের বন্দিশালার দায়িত্ব পেতেন। সেখানে বন্দিদের সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখা করা বা যোগাযোগের কোনো উপায়ও ছিল না। এ যেন জার্মানির হিটলারের কনস্ট্রেশন ক্যাম্পের চিত্রকেও হার মানায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম, বিনা বিচারে আটক, নির্বিচারে অবৈধভাবে আটক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন, খুন, সন্ত্রাস, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ইত্যাদি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ এসব ঘটনার জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৎকালীন সরকারকে নিন্দা প্রস্তাব জানালেও তাতে শেখ হাসিনা কর্ণপাত করেননি। বলা বাহুল্য, বিনাবিচারে কাউকে আটক বা বন্দি রাখা বা গুম করা সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। একই সঙ্গে তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনসহ মানবতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, বিশেষ করে মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়, ‘গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’ সংবিধান ছাড়াও জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮-এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না।’ মানবাধিকারের সর্বজনীন ওই ঘোষণাপত্রের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কাউকেই খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার বা অন্তরীণ করা কিংবা নির্বাসন দেওয়া যাবে না’। দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে এবং জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে বিনা বিচারে আটক, গ্রেফতার সম্পর্কে এসব নির্দেশনা থাকলেও শেখ হাসিনার সরকারের আমলে তা মোটেও মানা হয়নি। আর এ কারণেই দেশে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য গোপন বন্দিশালা-যেখানে প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত হতো মানবাধিকার, করা হতো মানবাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা। বর্তমান ও ভবিষ্যতে কোনো সরকারের আমলেই যেন দেশে এ ধরনের কোনো গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব না থাকে, তা সুনিশ্চিত করার এখনই উপযুক্ত সময়। আর তা সুনিশ্চিত করতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই। পাশাপাশি বিনা বিচারে আটক রাখার ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। মানবাধিকার রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থেই (প্রয়োজন হলে পলিটিক্যাল অ্যাক্ট প্রণয়ন করে হলেও) বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুম-খুনের রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে-এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কারণ, মানুষের সমানাধিকার ও অন্যান্য অধিকার এবং সহজাত মর্যাদার স্বীকৃতিই পারে বিশ্বে শান্তি, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি গড়ে তুলতে, কোনো গোপন বন্দিশালা নয়।

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য

kekbabu@yahoo.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম