শতফুল ফুটতে দাও
আয়নাঘরের মানুষ সবাই ফিরে আসুক
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
৫ আগস্ট অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এমন ধরনের অস্থির পরিস্থিতির মূলে ছিল পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সৃষ্ট নানামুখী বিশৃঙ্খলা। প্রফেসর ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণে অনিবার্য কারণে বিলম্ব করায় এবং একই কারণে তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে বিলম্ব হওয়ায় অশুভ শক্তি নানামুখী তৎপরতায় মেতে ওঠে। দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার পর প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনা আর রাজনীতি করবেন না বলা হলেও, দেখা গেল দুয়েক দিনের মধ্যে তিনি যেন কোথাও থেকে বল-ভরসা পেয়ে চাঙা হয়ে উঠলেন এবং তার পুরোনো অভ্যাসে তিনি আবারও প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিতে শুরু করলেন। মনে হলো, সহস্রাধিক শিশু-কিশোর, নারী, যুবক-যুবতি ও কর্মজীবী মানুষকে হত্যা করে এবং কয়েক সহস্র মানুষকে আহত ও পঙ্গু করে ফেলার পরও তার আস্ফালন থেমে নেই। অথচ সংযত আচরণ এবং কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করলে এ দেশের মানুষ একপর্যায়ে তাকে হয়তো ক্ষমা করে দিত। তার মুরুব্বি ভারতের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করে অত্যাচার, নিপীড়নের ভয়াবহ বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলেন। তার অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে ভারতের স্বনামধন্য অধ্যাপক ও শিল্প-সাহিত্যিকরাও রেহাই পাননি। জরুরি অবস্থার নিষ্পেষণে সমগ্র ভারত স্তম্ভিত ও নির্বাক হয়ে পড়েছিল। মনে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটেছে। বয়োবৃদ্ধ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে আন্দোলন ও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। এতসব কিছুর পর পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল কংগ্রেস নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। দলীয় নেতা হিসাবে নির্বাচনি প্রচারে নামতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জোড়হাত করে ভারতবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘ম্যায় মাফি মাংতা হ্যায়।’ তার এ ক্ষমাপ্রার্থনার মহত্ত্ব বিশ্বাস করে ভারতবাসী তাকে ক্ষমা করে দেয়। তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসেন। তার মুরুব্বির কাছ থেকে শেখ হাসিনা কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেননি। ক্ষমাপ্রার্থনা তো দূরের কথা, তার মধ্যে কোমনীয়তার লেশমাত্র নেই। বিদেশের মাটিতে বসে দেশে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির জন্য তিনি তৎপর রয়েছেন। যে দেশে এখন তার আশ্রয়, সে দেশের চক্ষুহীন-কর্ণহীন রাজনীতিক, আমলা ও গোয়েন্দারা অলীক সব বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছেন এবং কলের পুতুলের মতো তিনি আওয়াজ করে চলছেন।
ডিক্টেটরের পতনের পর খুবই অল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। শেখ হাসিনার হাতে পুষ্ট হয়ে ওঠা এবং বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলা পুলিশ বাহিনী ধর্মঘট শুরু করেছিল। আসলে ধর্মঘট নয়, কর্মস্থলে যাওয়ার মতো মনোবল বা সাহসের কোনো কিছুই তাদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না। বস্তুত জনরোষের ভয়ে তারা আত্মগোপনে গিয়েছিল। তাদের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা আইজি আব্দুল্লাহ-আল-মামুনসহ বড় বড় কর্মকর্তা এখনো পালিয়ে আছেন। যাই হোক, নবনিযুক্ত আইজিপি পুলিশদের অভয় দিলে এবং কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসার আহ্বান জানালে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব থানা ও ফাঁড়ি সচল হয়ে ওঠে। অনেক থানার অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং অস্ত্রশস্ত্র খোয়া গেছে অথবা বিধ্বস্ত হয়েছে। এগুলো পুনঃস্থাপনে কিছুটা সময় লাগবে বৈকি। পুলিশ বাহিনীর মনোবল যে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসেনি তার প্রমাণ হলো, থানাগুলোকে এখনো সেনাদের নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে। এক ভয়ানক ধরনের একনায়কত্ববাদী শাসনব্যবস্থা শেখ হাসিনা গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই শাসনযন্ত্র দিয়ে জনগণের ওপর নিষ্পেষণ চালিয়েছিলেন, যার পরিণতি আমরা দেখতে পেয়েছি ক্ষুব্ধ, ক্রুব্ধ জনতার প্রতিরোধ প্রয়াসে। সম্পূর্ণরূপে গণবিরোধী শাসনযন্ত্রের পরিণাম হলো পুলিশ ও আমলাদের, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যসহ অনেক কর্মকর্তা কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মানুষের সামনে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন। পুলিশবহিনী অকার্যকর থাকায় রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ডাকাতির ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রবল জনপ্রতিরোধ এসব ক্রিমিনালদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এদের অনেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হয়েছে, আবার কেউ কেউ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এদের অর্থের বিনিময়ে মাঠে নামিয়েছিল পতিত স্বৈরাচারের দোসররা। বোঝাই যাচ্ছে, এরা পাপাচার থেকে দূরে সরে আসতে পারছে না।
স্বৈরাচারী একনায়কত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী হাসিনা শাসনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর, নির্দয় ও হৃদয়বিদারক অত্যাচার ছিল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার অল্প কদিনের মধ্যে গুম হলেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম। এরপর থেকে একের পর এক গুমের ঘটনা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এসব গুম-খুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসীর মনে ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি করা। যে কোনো মুহূর্তে যে কেউ গুম হয়ে যেতে পারে, এমন আতঙ্কে মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলল এবং নিজেদের গুটিয়ে ফেলল। ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপে সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। ভারতের গণতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী তেলেঙ্গানা ও কাকদ্বীপে কৃষক বিদ্রোহ দমনে চরম নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেন। বিপ্লবী কবি সলিল চৌধুরী তার বিখ্যাত ‘শপথ’ কবিতায় লিখেছিলেন-
‘সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল
সেদিন আকাশে জলভরা মেঘ
বৃষ্টির বেদনাকে বুকে চেপে ধরে থমকে দাঁড়িয়েছিল
এই পৃথিবীর আলো-বাতাসের অধিকার পেয়ে
পায়নি যে শিশু জন্মের ছাড়পত্র
তারই দাবি নিয়ে সেদিন রাত্রে
সারা কাকদ্বীপে
কোনো গাছে কোনো কুঁড়িরা ফোটেনি
কোনো অঙ্কুর মাথাও তোলেনি
প্রজাপতি যত আরও একদিন গুটিপোকা হয়েছিল
সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল।
শেখ হাসিনার আমলে সংঘটিত গুমের আতঙ্কে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, ঝিঁঝিপোকারাও ভাষা হারিয়েছিল, জোনাকিরা আলো না দিয়ে অন্ধকারে লুকিয়েছিল। শুধু ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমকে গুম করে এই গুমের মহড়া থেমে থাকেনি। বেশ কয়েকশ মানুষকে গুম করে রাখা হয়। এদের মধ্যে অনেককেই হয়তো পরপারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোথায় তাদের লাশ পুঁতে ফেলা হয়েছে, কোথায় তাদের লাশ নদীর জলে-সাগরের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথায় তাদের লাশ অ্যাসিডভর্তি ড্রামে ডুবিয়ে দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়েছে, তার হদিস তাদের স্বজনরা এবং দেশবাসী আর কখনো হয়তো জানতে পারবে না। তাদের অপেক্ষায় প্রিয়তমা স্ত্রী নীরবে চোখের পানি ফেলেছে, তাদের অপেক্ষায় সন্তানরা বলেছে বাবা কোথায়, বাবা কেন আসে না-এর চেয়ে মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে!
আপনজনদের জন্য ন্যূনতম দাবি হলো, হারিয়ে যাওয়া মানুষটির লাশ ফিরে পাওয়া, যাতে পূতপবিত্রভাবে দাফন-কাফন করা যায়, জানাজা পাঠ করা যায়। শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া ভয়াল খুনিরা এর জন্য দায়ী। এরা কেউ পুলিশে ছিল, র্যাবে ছিল কিংবা সামরিক গোয়েন্দা সংস্থায় ছিল। এখন আমরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভের পর গুম করা মানুষকে মানবেতরভাবে লুকিয়ে রাখা আয়নাঘরের কথা জানতে পারছি। এ কথা সত্য যে, বছরখানেক আগে আলজাজিরা আয়নাঘরের রহস্য ভেদ করেছিল। তখন স্বৈরাচারের দোসররা বলেছিল, এসব নিছক অপপ্রচার। এখন যখন ব্রিগেডিয়ার আযমী, ব্যারিস্টার আরমানসহ আরও কয়েকজন আয়নাঘর নামীয় অন্ধকূপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের আকাশ-বাতাসে ফিরে এসেছেন, তখন আর মনে হয় না আয়নাঘরের ব্যাপারটা একটা মিথ।
খুবই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জনগণ তাদের ভালোবাসার বাহিনী হিসাবে গ্রহণ করে, সে বাহিনীরই একটি প্রতিষ্ঠান মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর আকাঙ্ক্ষা পূরণে। বাংলাদেশের জনগণের মহান অভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বেড়াজাল ছিন্ন করে আয়নাঘরের নির্মমতার কাহিনি জনসমক্ষে ফুটে উঠেছে। গুম হওয়া মানুষের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ বহুবার সংবাদ সম্মেলন করে গুম হয়ে যাওয়াদের ফিরে পাওয়ার দাবি জানিয়েছে। শুধু তাই নয়, আয়নাঘর যেখানে আছে বলে মনে করা হয়, সেখানে গিয়ে ‘মায়ের ডাক’-এর সদস্যরা সেখানে আটকে থাকা মানুষগুলোর মুক্তি দাবি করে মানববন্ধন করেছে। যাই হোক, কারও না কারও পাপে আমাদের জাতীয় জীবনে এ কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়েছে। এখন সময় এসেছে পাপ ও শাপমোচনের। এখনো যারা আয়নাঘর অথবা অচিহ্নিত বন্দিশালায় কষ্টের দিন পার করছেন, তাদের আপনজনদের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে আশা করি। এ ব্যাপারে আমি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহৃদয় দৃষ্টি আর্দ্রচিত্তে কামনা করি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ