শতফুল ফুটতে দাও
স্বাধীন পুলিশ কমিশন আমারও দাবি
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছিল, সেটা হলো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। কোনো দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং নৈরাজ্য দেখা দেয়, তখন সেদেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জানমাল ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। ১৫ বছরের অধিক কাল ধরে এদেশে চলেছে শেখ হাসিনার এক নায়কত্ববাদী স্বৈরশাসন। এ শাসনব্যবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, এর চেয়ে কেন্দ্রীভূত আর কোনো শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। সবকিছু চলত এবং ঘটত ওই এক লৌহমানবীর অঙ্গুলিহেলনে। তার ওপর কথা বলার অধিকার কারোরই ছিল না। তিনি নিজের খেয়াল-খুশি ও মর্জিমতো দেশ চালাতেন। আমি এক বয়োবৃদ্ধ বুদ্ধিজীবীর কথা জানি, যিনি তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে, লেখাজোখায় সবসময় নৈতিকতা, নীতিবোধ, শততা ও শ্রেয়বোধের কথা বলেন। ছাত্রজীবন থেকে তাকে এসব কথা বারংবার আওড়াতে শুনেছি। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের এবং ব্যক্তিস্বার্থের কিছু প্রশ্নে তার মতো সুবিধাবাদী ও নৈতিকতাহীন মানুষ আর দেখিনি। তার সম্পর্কে আমার এই ধারণা এত প্রবল হতো না, যদি না তিনি নৈতিকতা ও শ্রেয়বোধের কথা বলতেন। স্বজনপ্রীতিতে তাকে হার মানাতে পারে এমন লোকের দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাকে এক টিভি টকশোতে বলতে শুনেছি, শেখ হাসিনা নেতৃত্বগুণে তার পিতাকে অনেক দূর অতিক্রম করে গেছেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অনেক উঁচু মানের। শেখ হাসিনার পদস্খলনের মূলে একদিকে যেমন রয়েছে দারুণ আত্মম্ভরিতা, অন্যদিকে রয়েছে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের তোয়াজ-তোষামোদ। এ করণেই তিনি মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। হয়ে উঠছিলেন দুর্বিনীত ও লাগামহীন। ছোটবেলায় বাল্যশিক্ষায় পড়েছিলাম অহংকার পতনের মূল। এ শিক্ষা তো ভুল হওয়ার কথা নয়। আজ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে যে কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে অহংকার এবং ‘কুচ্ পরোয়া নেহি’ মনোভাব।
শেখ হাসিনা যখন পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লেন, তখন দেশকে তিনি রেখে গেলেন এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে। শত শত শহিদের রক্তস্রোত ও মায়ের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আমি আমার ৭৯ বছর বয়সে আর কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, একটা সময় ছিল ব্যতিক্রম, সেটা ছিল ’৭১-এ পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু তার প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উপনিবেশবাদীরা যদি হত্যাকাণ্ড চালায়, তাহলে সেটা উপনিবেশবাদের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে কেন শাসকগোষ্ঠী বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালাবে? মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠেছিল। এক পুলিশ তার কর্মকর্তাকে জানিয়েছিল, একজনকে মারি তো অন্যরা সরে যায় না। বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে। এভাবে মৃত্যুভয়কে যারা জয় করেছে, তাদের কি আর পরাজিত করা সম্ভব?
শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল পুলিশি শক্তিনির্ভর। অনেকে দেশটাকে বলত পুলিশি রাষ্ট্র! শেখ হাসিনার পুলিশ কত রকমের অপকর্ম করেছে! পুলিশ লাখো মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, মামলার অভিযোগপত্রে অজানা শত শত মানুষের কথা বলেছে, যাতে যে কোনো অসিলায় যে কোনো মানুষকে মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে গ্রেফতার করতে পারে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তারা তাদের দৃষ্টিতে অভিযুক্তদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। পুলিশি মামলায় শত-সহস্র পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য রাজধানীতে এসে রিকশাচালক হয়েছে অথবা হয়েছে চৌরাস্তার ফুল বিক্রেতা। শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্যাতন পুলিশবাহিনীর দ্বারা সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল র্যাবের বিভীষিকাময় অত্যাচার ও নির্যাতন। গুম, খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আয়নাঘরকেন্দ্রিক সীমাহীন যাতনাময় দিনযাপন অনেক বন্দির জীবনে অন্ধকার কুঠুরির বিভীষিকা নিয়ে এসেছিল। এ বন্দিদের আপনজনরা জানত না তারা কোথায় আছেন। অন্ধকার গহ্বরে সংকীর্ণ সেলের মধ্যে তারা দিবারাত্রির পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। তাদের দেওয়া হতো পচা-গলা বাসি খাবার। এ খাবার গলাধঃকরণ করা ছিল অসহনীয় এক অত্যাচার! বছরখানেক আগে কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন আয়নাঘরের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। সেই থেকে আয়নাঘরের রহস্য নিয়ে এদেশের জনগণের কৌতূহল বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-তরুণদের আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আয়নাঘরের রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন ক্ষমাহীনভাবে আয়নাঘরের কুশীলবদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা। অন্যথায় মানবতার চরম পরাজয় ঘটবে।
দৈনিক বণিক বার্তার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশে দেড় দশকে নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে ৮৩ হাজার এবং নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার। এ দেড় দশকে শুধু কনস্টেবল, এসআই ও পুলিশ সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জনকে, যা মোট পুলিশ সদস্যের প্রায় অর্ধেক। মাস দুয়েক আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম, পুলিশে আরও ৫০ হাজার রিক্রুট করা হবে। জনশ্রুতি রয়েছে ভুয়া ঠিকানা দেখিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে অনেক ভারতীয়কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে তদন্ত করে দেখা হোক জনমনে বিদ্যমান এ সন্দেহ কতটুকু সত্য।
শেখ হাসিনার বিদায়ের পর পুলিশ বাহিনী ধর্মঘটে গেছে। তারা কর্মস্থল ত্যাগ করে কর্মবিরতি পালন শুরু করেছিল। পুলিশ বিভাগের নতুন আইজি কর্মস্থলত্যাগী পুলিশদের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কাজে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। আইজিপির আহ্বানের পর ধীরে ধীরে পুলিশ কর্মস্থলে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার শাসনামলে যাদের পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের সিংহভাগ অংশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মী ও ক্যাডার। এমন দলকানা একটি পুলিশবাহিনী তাদের সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চরম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চালাবে, এমনটাই তো স্বাভাবিক। আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করতে এদের হাত কাঁপেনি। এরাই নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রাকে কণ্টকময় করে তুলতে ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়েছে। পুলিশ না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পতিত স্বৈরতন্ত্রে ছদ্মবেশী দুষ্কৃতকারীরা রাজধানীতে লুটপাট ও ডাকাতিতে মেতে উঠেছিল। জনরোষের ফলে তাদের সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গেছে। পুলিশবাহিনী ১১ দফা দাবিনামা পেশ করেছে। এগুলোর মধ্যে পেশাসংক্রান্ত কিছু দাবি থাকলেও কিছু অবাস্তব দাবিও রয়েছে। যেমন-বছরে দুই মাস নৈমিত্তিক ছুটি। তারা দাবি জানিয়েছে, ‘পুলিশ বাহিনীকে যেন কোনো দলীয় সরকার তার রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে।’ পুলিশবাহিনীর এ বোধোদয় আওয়ামী দুঃশাসনের গত দেড় দশকে কোথায় ছিল? তারা যখন এ সময়ে দলীয় ঠেঙ্গারে বাহিনী হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিলেন, তখন কেন আপত্তি করেননি? তখন কেন স্বাধীন পুলিশ কমিশনের দাবি তোলেননি? নাকি আওয়ামী শাসকদের বে-আইনি হুকুম তামিল করতে তারা তীব্র আগ্রহবোধ করেছেন। তাদের ভুলের জন্যই তো এতগুলো থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্স আক্রান্ত হলো। তাদের আচরণ জনমনে যে ক্রোধ সৃষ্টি করছিল, তার বলির শিকার হয়েছেন তাদেরই অনেক সহকর্মী। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। পুলিশের মৃত্যুও কাম্য নয়। তবে তারা স্বাধীন পুলিশ কমিশনের যে দাবি তুলেছেন, তা আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়। এই দাবি পূরণ হওয়ার পাশাপাশি তাদের পেশাগত উৎকর্ষ অর্জন করতে হবে এবং ঘুস-দুর্নীতিসহ সব অপকর্ম থেকে মুক্ত হতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ