Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সংস্কার তো নিজে থেকেই করার বিষয়

Icon

হাসান মামুন

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার তো নিজে থেকেই করার বিষয়

ছবি সংগৃহীত

রফতানি তথ্য ‘সংশোধন’ নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে গেল, সেটা ধরে লেখার পর দু’সপ্তাহে কোনো নিবন্ধ লিখতে পারিনি যুগান্তরে। অন্য সংবাদপত্রেও। এর একটা কারণ ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা। কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো আংশিক ইন্টারনেট সংযোগেই চলতে হচ্ছে, তা কারও অজানা নয়। তবে এর ভেতর দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছি, নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশও কতখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের ওপর। সংবাদপত্রে দু’একটা লেখা ছাপা না হলে অবশ্য চলে; কিন্তু ইন্টারনেটের ওপর যাদের জীবিকা নির্ভরশীল, তাদের তো চলছে না।

অনলাইনে ব্যবসা করে যারা অন্যদেরও কিছু কাজের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদের ক্ষতি কতখানি? আর ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষতি? রফতানি বাণিজ্যও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ব্যাংকে রেমিট্যান্স অনেক কম এখন। ব্যাংকও বন্ধ ছিল। রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে আবার যোগ রয়েছে উদ্ভূত পরিস্থিতির। ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি চালু হলেও তাই এক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি নাও হতে পারে।

সেটা আরেক প্রসঙ্গ; হয়তো পরে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তবে এই যে নানা ক্ষেত্রে আমরা নেটনির্ভর হয়ে পড়েছি, সেটা কিন্তু এক বড় ধরনের সংস্কার। এখান থেকে কোনো কারণে সরে গিয়ে দীর্ঘদিন ‘অ্যানালগ’ থাকার সুযোগ আর নেই। তাতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও হতে হয় খারাপভাবে আলোচিত।

রফতানি তথ্য সংশোধনের পর ইপিবি (রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো) থেকে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরেও তারা ক’মাস এ সংক্রান্ত তথ্য দেবেন না। তথ্য প্রদানের ‘পদ্ধতি’ যথাযথ করতে হবে তাদের। তবে তথ্য না দিলেও রপ্তানি তো বন্ধ থাকবে না। আমরাও আশা করে থাকব, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ খাতে বড় অভিঘাত আসবে না। এমনিতেই রপ্তানি পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। সেটাকে সুবিধাজনক দেখাতে চাওয়ার কারণেই রপ্তানি তথ্যে বড় গোলযোগ ঘটেছিল কিনা, তা নিয়ে বাড়তি আলোচনার পরিবেশও আর নেই। এখন বরং ভেবে দেখতে হচ্ছে, সামনে ক্রিসমাসের ক্রয়াদেশ কতটা পাব। বাজারে তো প্রতিযোগীরা রয়েছে! অন্যান্য রফতানি খাত নিয়ে আলোচনাও কিন্তু তেমন নেই। আপাতত তৈরি পোশাক খাত নিয়েই আলোচনা। এ খাতে কাঁচামালের আমদানি নির্বিঘ্ন রাখার দাবিও উঠেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্দর ও ব্যাংকে যেন অতিরিক্ত মাশুল গুনতে না হয়, আছে সে দাবিও। তবে ইপিবিসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে এরই মধ্যে স্থির করে ফেলতে হবে, রপ্তানি তথ্যে আর যেন কোনো গোলযোগ না হয়। রফতানিকারকরা একরকম বলবেন আর তারা দেবেন ভিন্ন চিত্র-এটা তো কাজের কথা নয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তথ্যগত গোলযোগ হলে কিন্তু তার প্রভাব পড়ে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের হিসাবে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তেও এর প্রভাব পড়ে। এর পুনরাবৃত্তি রোধটাও হবে একটা সংস্কার।

অবশ্য মুশকিল যে, এসব সংস্কারে আমরা মনোনিবেশ করছি নিজে থেকে নয়; আইএমএফের ‘পরামর্শে’। তাদের সঙ্গে একটা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কর্মসূচিতে ঢুকে পড়াতেও এসব ঘটছে বৈকি। এই যে বছরে দু’বার মুদ্রানীতি গ্রহণ, তিন মাস অন্তর প্রবৃদ্ধির হিসাব জানানো-এসবও আমাদের করা উচিত ছিল নিজে থেকে। কেননা এতে দেশের স্বার্থ নিহিত।

মুদ্রানীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা। এটা অর্জনে মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করতে হলে একটি অর্থবছরে একাধিকবার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তা করাই ভালো। আমরা দীর্ঘদিন যে ধরনের মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করছি, তাতে তিন মাস অন্তরও মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হতে পারে। এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, বিশেষত শ্রীলংকা যেভাবে মূল্যস্ফীতিকে বাগে এনে ফেলেছে, তা নিয়ে আলোচনা তো বন্ধ করা যাবে না।

তিন মাস অন্তর প্রবৃদ্ধির যে তথ্য এখন দেওয়া হচ্ছে, সে সিদ্ধান্তও কিন্তু নেওয়া হয়েছে অনেক পরে এবং আইএমএফের পরামর্শে। তাদের অনেক পরামর্শ নিয়ে অবশ্য সমালোচনা রয়েছে। সব দেশের ক্ষেত্রে একই ‘প্রেসক্রিপশন’ দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে বছরে চারবার প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশে তাদের পরামর্শটি ভালো। বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) এটার অনুসরণ শুরু করায় আমরা জানতে পারছি, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কেমন। নীতিনির্ধারকদের তো এটা জানা একান্ত প্রয়োজন। নইলে প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখা বিভিন্ন খাতের পরিচর্যার সিদ্ধান্ত তারা নেবেন কীভাবে?

এক্ষেত্রে তথ্য অবশ্য সঠিক হতে হবে; খালি যথাসময়ে প্রকাশ করলে হবে না। সরকারি তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তো আজকের নয়। সরকারের ভেতর থেকেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; প্রকাশ্যে তাদের মধ্যে বিতর্কও হয় সংকট দেখা দিলে। সংকট উপস্থিত হওয়ার কারণও তথ্যের নিুমান। আইএমএফের পরামর্শ মেনে তিন মাস অন্তর শ্রমশক্তি সংক্রান্ত যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তার মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

এ বিষয়ক তথ্য দেখলে তো মনে হয়, দেশে বেকারত্ব সহনীয়। কিন্তু চাকরির বিজ্ঞাপনে প্রার্থীরা যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাতে কী মনে হয়? আর কোনো ধরনের সরকারি চাকরি হলে তো কথাই নেই!

এক্ষেত্রে চলে আসা কোটা সংস্কারের দাবিতে থেকে থেকে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার অন্তর্নিহিত কারণও কি চাকরির সংকট নয়? শ্রমজীবীদের কাজের সুযোগও কি বেড়েছে? বছরের পর বছর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে এটা বাড়বে কীভাবে? রপ্তানি তথ্য ‘সংশোধনে’ এ খাতের যে চিত্র মিলল, তাতে বলতে হয়, শিল্পে কাজের সুযোগ বাড়েনি। অনেক ক্ষেত্রে বরং শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। এ অবস্থায় সহজেই বোঝা যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোর কী অবস্থা।

মূল্যস্ফীতির তথ্যও সঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ জোরোলা। এ তথ্য সঠিক না হলে মুদ্রানীতিতে কীভাবে কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক? এনবিআরই বা কীভাবে বিন্যস্ত করবে নীতি? ঘুরেফিরে প্রশ্ন ওঠে, রপ্তানি তথ্য সঠিক না হলে এ খাতে প্রণোদনাই বা কীভাবে পুনর্বিন্যাস করবে সরকার? এ অবস্থায় স্বভাবতই দাবি উঠেছে একটি প্রভাবমুক্ত জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা প্রতিষ্ঠার। সেটা যদি করা যায়, তবে তা হবে এক বড় সংস্কার। এ ধরনের সংস্কার তো নিজে থেকেই করা উচিত।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিতের কথাও কি অনেকদিন ধরে বলা হচ্ছে না? সরকারি, বেসরকারি নির্বিশেষে ব্যাংক খাতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণহীনতা কি দায়ী নয়? সব ক্ষেত্রে তারা সমতাভিত্তিক পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ বলে অভিযোগ এখন জোরালো। রিজার্ভ পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে তাদের ব্যর্থতাও ব্যাপকভাবে আলোচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক আবার অব্যাহতভাবে চাইছে প্রকৃত রিজার্ভ পরিস্থিতি ঢেকে রাখতে। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটেছে এসব তথ্য প্রাপ্তিতে জটিলতা সৃষ্টি হওয়াতেই।

অথচ আইএমএফকে তারা ঠিকই দরকারি সব তথ্য পরিবেশন করেন। নিট রিজার্ভ কেবল ওই বহুজাতিক সংস্থাকেই জানানো হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স আসা নতুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক কী করবে, সেটা তাদের বরং এখন চিন্তা করা প্রয়োজন। খবরে জানা যাচ্ছে, কিছু ব্যাংককে নাকি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বেশি দরে হলেও রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে। এমন সব ‘নির্দেশনা’ আবার দিতে দেখা যায় মৌখিকভাবে। এ নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়।

ঘোষিত অবস্থানে অটল থাকতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক তার মুদ্রানীতি থেকেও বিচ্যুত বলে সমালোচনা রয়েছে। ‘অ্যাডহক ভিত্তিতে’ এমনকি একশ্রেণির ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়াচ্ছেন তারা। মূল্যস্ফীতিতে এর প্রভাব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা কি তাদের নেই? সরকারকেও সময়ে সময়ে টাকা ছাপিয়ে দিয়ে তার অর্থ সংকট দূর করা হচ্ছে! তবে ডলার তো ছাপানো যাবে না। তাই এর আহরণ বাড়াতে এবং রিজার্ভ ধরে রেখে অর্থনীতিকে নিরাপদ করতে হবে। এ কারণেও একটা স্বশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের প্রয়োজন। সে সংস্কারের দাবি সামনে আরও জোরালো হবে।

আর সেটা না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চারিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন গুরুতর অভিযোগও কিন্তু রয়েছে যে, ব্যাংক কোম্পানি আইনে উলটো সংস্কার করে এ খাতে ‘পরিবারতন্ত্রকে’ বরং আরও মজবুত করা হয়েছে। এর বিষময় ফল পেতেও খুব দেরি হয়নি।

রিজার্ভ যথাযথভাবে দেখানো, এমনকি খেলাপি ঋণের ‘প্রকৃত অবস্থা’ জানানো-এসব বিষয়েও আইএমএফকে কেন চাপ সৃষ্টি করতে হবে? এগুলো তো নিজেদেরই এতদিনে করে ফেলার কথা ছিল। বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে কোন কোন ক্ষেত্র থাকবে, সে বিষয়েও কথা বলতে হয় আইএমএফকে!

বরাদ্দ বেশি করে দেখাতেই যে এ খাতে বিধবা ও বয়স্ক ভাতার সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন আর সঞ্চয়পত্রের সুদকে অদ্ভুতভাবে যুক্ত করা হয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়েও চলে আসছে অস্বচ্ছতা। বাজেট প্রণয়নের গতানুগতিক এ ধারায় সংস্কার আনার দাবিও তাই জোরালো হচ্ছে।

এসব দৃষ্টিভঙ্গিগত অস্বচ্ছতার কারণেই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের কাজটি দশকের পর দশক ঝুলে থেকে শেষতক একটা চরম বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এক ধরনের নিষ্পত্তির দিকে গেছে বললে ভুল হবে না। এটা ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তির নতুন সংকট হয়েছে উপস্থিত। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সেটা স্বীকারও করা হচ্ছে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজস্ব তাগিদ থেকে সংস্কারগুলো তাই করে যেতে হয়। হালে অর্থনীতিতে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনেও কিন্তু রয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো না করার মনোবৃত্তি। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম ধরে রেখে স্থানীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী দেখাতে চাওয়ার কথা তোলা যেতে পারে। এ নিয়ে অবশ্য কম আলোচনা হয়নি ইতোমধ্যে। এসব আলোচনাও যেন আমাদের পথ দেখায়। আমাদের দৃষ্টি যেন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।

হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম