Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর সময়ের দাবি

Icon

খন্দকার আপন হোসাইন

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর সময়ের দাবি

জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে এ বছরের ১১ জুলাই বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে সতেরো কোটির কাছাকাছি হতে চলেছে। এ বিশাল জনসংখ্যার সমস্যাও অনেক। বিশাল জনসমষ্টি মানেই বিপুল শ্রমশক্তি। কথাটি শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু এ জনসমষ্টির কর্মসংস্থান কোথায়? যদি শ্রমশক্তি প্রয়োগের যথোপযুক্ত ক্ষেত্রই না থাকে, তাহলে তো কথাটি ভিত্তিহীন হয়ে যায়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে কাজ পাওয়া সহজ নয়। দেশের কর্মক্ষম জনসম্পদের ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত বা কাজ পেতে সচেষ্ট। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। এ বছরের বেকারত্বের হার ২০২৩ সালের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে এবং নারী বেকারের সংখ্যা কমেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার।

প্রতিবছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয় ১১ জুলাই। এটি জনসংখ্যাসংশ্লিষ্ট একটি বাৎসরিক আয়োজন। এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলে সমগ্র বিশ্বের মানুষের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেই আগ্রহ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা পরিষদ এ দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৯টি দেশে। দেশগুলো হচ্ছে-ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, আমেরিকা, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া। ২০২৪ সালে ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনঅধ্যুষিত দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সবচেয়ে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বর্ধনশীল দেশ হলো নাইজেরিয়া। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রতি মিনিটে ২৫০ জন শিশুর জন্ম হয়।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও জনবিন্যাসের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জনসংখ্যা বাড়া-কমার গুরুত্বপূর্ণ সূচক টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর। সহজ কথায়, একজন নারী তার সমগ্র জীবনে গড়ে যতজন সন্তানের জন্ম দেন, তার হিসাবই হচ্ছে টিএফআর। সাধারণত টিএফআর-এর মান ২ দশমিক শূন্য কিংবা এর নিচে হলে সেটি ‘প্রতিস্থাপনযোগ্য হার’ হিসাবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নারীর সন্তানসংখ্যা গড়ে ২ হলে পরবর্তী প্রজন্মেও দেশের জনসংখ্যা মোটামুটি অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের টিএফআর ছিল ৩ দশমিক ৭। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের টিএফআর হয়েছে ১ দশমিক ৯। প্রতিস্থাপনযোগ্য টিএফআর ২ দশমিক শূন্যের চেয়ে নিচে অবস্থান করছে বাংলাদেশের ফার্টিলিটি রেট, যা আন্তর্জাতিক সূচকে ১১২তম।

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের যত অর্জন হয়েছে, এর মধ্যে টিএফআর নিঃসন্দেহে অন্যতম। তবে বর্তমান বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় ২০৬৪ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়বে। এরপর আবার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যাবিষয়ক এ ভবিষ্যদ্বাণী অতীত ও বর্তমানের জনবৃদ্ধির তথ্য সম্পর্কিত মডেলের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। সাধারণত এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি অনুমান ভবিষ্যৎ অনুমানের তুলনায় অধিক চমক সৃষ্টি করে। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি, রাষ্ট্রীয় নীতি, মানুষের ধ্যানধারণা সবই পালটায়। জনসংখ্যা সম্পর্কিত এসব ধারণাও পালটাতে পারে।

তারুণ্যে ভরা দেশ বাংলাদেশ। এদেশের জনগণের বয়সের মিডিয়ান বা মধ্যমা বিবেচনায় শতকরা অর্ধশত ভাগ মানুষের বয়স ত্রিশের কম। চীনে বয়সের মধ্যমা ৩৯। উত্তর আমেরিকায় ৩৮ দশমিক ৪। গড়ে একজন চীনা বা আমেরিকানের চেয়ে একজন বাংলাদেশি অন্তত ১০ বছরের ছোট। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম বয়সসীমার মধ্যে। সে হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, তরুণরাই বিপুল শ্রমশক্তির জোগান দেবে। তৈরি করবে উপভোক্তার মস্তবড় বাজার। দুনিয়ার বিস্তৃত জ্ঞান ও নেটওয়ার্ক-পণ্যের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণভারও থাকা উচিত এ তরুণ প্রজন্মের হাতে।

কোনো একটি দেশে অর্থনৈতিকভাবে অনুৎপাদনশীল বলা হয় শিশু ও বৃদ্ধদের। এ শিশু ও বৃদ্ধের মোট সংখ্যাকে বাকি জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায় ‘ডিপেনডেন্সি রেশিয়ো’ বা ‘নির্ভরতা অনুপাত’। এ অনুপাত যত কম হয়, অর্থনীতির জন্য ততই ভালো। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ কর্মক্ষম বয়সসীমায় আবদ্ধ। তাই এ অনুপাতটা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কিন্তু আজকের এ বৃহৎসংখ্যক তরুণ ২৫-৩০ বছর পরেই বৃদ্ধ হয়ে যাবে। তাই শিশুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুব একটা না বাড়লেও লক্ষণীয়ভাবে বাড়বে ‘নির্ভরতা অনুপাত’। আর নির্ভরতার অনুপাত বাড়লে অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি হবেই।

এক গবেষণায় এসেছে, দেশের সামষ্টিক আয় বৃদ্ধি হচ্ছে রেমিট্যান্স ও শহুরে ধনীদের হাত ধরে। পক্ষান্তরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সিংহভাগ ঘটছে গাঙ্গেয় অববাহিকার গ্রামীণ অনুন্নত এলাকায়। আবার দেশের উত্তরাঞ্চলের ‘টিএফআর’ ২-এর চেয়ে অনেক বেশি। তবে দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কম। ফলে উত্তরের জেলাগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছেই। আবার দক্ষিণে লক্ষণীয়ভাবে কমছে। এসবের রাজনৈতিক উত্তাপ আমরা এখনো বুঝতে ব্যর্থ, হয়তো ভবিষ্যতে বুঝতে পারব। পরবর্তী কয়েক দশকে দেশের উত্তর ভাগে থাকবে অনেক তরুণ, আর ক্রমেই বুড়ো হয়ে যাবে দক্ষিণ বাংলাদেশ।

ম্যালথাসের তত্ত্ব একটি জনসংখ্যাবিষয়ক তত্ত্ব। এ তত্ত্বের প্রস্তাব হলো খাদ্যশস্যের উৎপাদন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেলে জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায়। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস উনিশ শতকের প্রথমভাগে এ তত্ত্ব প্রচার করেন। এ তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসংকট এমনকি দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। তাই ম্যালথাস মনে করতেন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ মারা যাবে; ফলে জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। ১৭৯৮ সালে ম্যালথাস তার ‘অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন’ গ্রন্থের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর করেন। বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারিত হয়েছে এ ম্যালথাসিয়ান তত্ত্বকে ঘিরে। একসময় কেউই বিশ্বাস করত না যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানবিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু বর্তমানে তা স্পষ্ট দৃশ্যমান।

ম্যালথাসের তত্ত্বের ভিত্তিতে ষাটের দশক থেকেই চীন ও ভারতের ওপর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প গৃহীত হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৮১ সালে চীন ‘এক সন্তান নীতি’র মতো অতি-আক্রমণাত্মক পদ্ধতির প্রচলন করে। চীনের এক সন্তান নীতি সেদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য বর্তমানে চীন জনসংখ্যা বাড়াতেই বরং হিমশিম খাচ্ছে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফপিএবি) নামক একটি সংস্থা দেশে ১৯৬০ সালে সীমিত আকারে এবং ১৯৬৫ সালে সারা দেশে জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে প্রথম জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, আশির দশকে ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগান নিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ আন্দোলন জোরদার করা হয়। ২০০৪ সালে জনসংখ্যা দিবসে ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়। এমনকি সরকার একসময় এক সন্তানের নীতি গ্রহণ করা যায় কি না, সেই চিন্তাও করেছিল। তবে বর্তমান সরকারের অনেকেই জনসংখ্যাকে দেশের জন্য বড় সমস্যা মনে করেন না। বাংলাদেশে জনসংখ্যাকে সম্ভাবনা হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল না কয়েক দশক আগে। যখনই মোট জনসংখ্যার হিসাবে চীনকে টপকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত বিশ্বের সর্বোচ্চ জনবহুল দেশে পরিণত হয়ে উঠেছে, তখনই বাংলাদেশের জনসংখ্যা জনসম্ভাবনা হিসাবে বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বিষয়টি বিপৎসংকেত নাকি জনসম্পদের স্ফুরণ, তা নিয়েও আলোচনার অবকাশ আছে। জনবিস্ফোরণের পাশাপাশি ‘ব্রেন ড্রেন’ নিয়েও ভাবতে হবে।

এ কথা সত্য যে, সামগ্রিক জনসংখ্যার ছবি দেখে এর রূপবৈচিত্র্য, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা এবং বিপদ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা যায় না। তাই সঠিক নীতি নির্ধারণের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারবিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। নারী-পুরুষের অনুপাত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও ভৌগোলিক ক্ষেত্রের মধ্যে জনবিন্যাসের পরিবর্তনে তারতম্য ইত্যাদি বিষয় ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের’ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসবের তত্ত্বতালাশও বেশ কঠিন। জনসংখ্যা বেশি হলে অসাম্যের আশঙ্কাও বেশি। বিশেষত বাংলাদেশের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে এ অসাম্য সর্বত্র বিরাজমান। আর যে কোনো ক্ষেত্রেই অনভিপ্রেত অসাম্য তৈরি হলে প্রভাবিত হতে পারে সামাজিক সুস্থিতি। এজন্য প্রয়োজন নিরন্তর তথ্যবিশ্লেষণ, সঠিক পরিকল্পনা ও এর রূপায়ণ।

জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যয়বহুল নয়, শুধু প্রয়োজন সচেতনতা। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে সহজেই জানার সুযোগ রয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয়। আজকের বিশ্বে বিপুল জনসংখ্যাকে কেবল সংখ্যা মনে করলে চলবে না। কেননা বিপুলসংখ্যক মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিত্যনতুন আবিষ্কার পৃথিবীকে সর্বাত্মক সমৃদ্ধ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের বাংলাদেশও হয়ে উঠুক পরিকল্পিত জীবনযাপনের মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি।

খন্দকার আপন হোসাইন : গবেষক; শিক্ষক, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল, শহিদ সালাহউদ্দিন সেনানিবাস, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল

khandaker.apon@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম