গম আমদানি বেড়ে যাওয়ার তাৎপর্য কী
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০২৪ সালে বিশ্বে গম উৎপাদন ১ শতাংশের মতো বাড়বে বলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা যে প্রাক্কলন করেছে, সেটা আমাদের মতো গম আমদানিকারক দেশের জন্য সুখবর। বিশ্ববাজারে জরুরি এ খাদ্যশস্যের দাম সাম্প্রতিককালে কমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
এদিকে আমাদের গম আমদানি নতুন করে বাড়ছে। মাঝে তিন অর্থবছরে এটা অব্যাহতভাবে কমেছিল। গমের দাম অনেক বেড়ে যাওয়াটা ছিল এর একটা কারণ। আমাদের আমদানি সক্ষমতা কমে যাওয়াটাও এর কারণ ছিল বৈকি। গম থেকে তৈরি আটা-ময়দার চাহিদাও কমে গিয়েছিল। দুবছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে দেশে। এ অবস্থায় ভোগব্যয় হ্রাস এবং এর ধরনে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। তবে সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে দেখা গেল, গম আমদানি বেড়েছে লাফ দিয়ে। ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির খবর মিলল। পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় আমদানি বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। আর এটা হলো সর্বোচ্চ!
সরকারি এ তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অবশ্য কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন-সম্প্রতি দেশের রপ্তানি তথ্য ‘সংশোধনের’ যে কাণ্ড হয়ে গেল, সেটা মাথায় রেখে। তবে বিধিবদ্ধ সংস্থা পরিবেশিত তথ্য ধরে আলোচনা করাটাই রীতি। গম আমদানির তথ্য অতিরঞ্জিত হলে সে বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বরাবরই এর আমদানির সিংহভাগ তো হয়ে থাকে বেসরকারি খাতে। বিপুল পরিমাণ গম ব্যবহৃত হয় আটা-ময়দা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোয়। আর আটা-ময়দা বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয় বেকারিশিল্পে। রেস্তোরাঁ খাতেও কম ব্যবহৃত হয় না। রেকর্ড আমদানির বিষয়টি তাদের বেশি অনুভব করতে পারার কথা। গম আমদানি বাড়ার সঙ্গে দেশে আটা-ময়দার দাম কমতেও দেখা যাচ্ছে। খোলা ও প্যাকেটে সরবরাহ করা উভয় আটা-ময়দার দামই কমবেশি হ্রাস পেয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে গমের দাম যে হারে কমেছে, দেশে গম থেকে তৈরি পণ্যের দামে সেটা আনুপাতিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এটি মূলত ঘটছে ডলারের দাম বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত বলে। সম্প্রতি এর দাম আনুষ্ঠানিকভাবেই বাড়ানো হয়েছে একবারে ৭ টাকা। ‘অনানুষ্ঠানিক বাজারে’ দাম আরও বেশি। গমের মতো পণ্যসামগ্রী আমদানিকারদের অনেক সময় এ বাজার থেকেও বেশি দামে ডলার কিনতে হয়। অন্যান্য কারণেও, যেমন জ্বালানি ব্যয় অনেক বাড়ার কারণে শিল্প-বাণিজ্য পরিচালনার ব্যয় বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের দিক থেকে বলা হচ্ছে, এসব কারণেই প্রত্যাশিত দামে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ অবস্থায় ভালো হয় গম উৎপাদনকারী দেশগুলোয় এর আবাদ ও ফলন বাড়লে। দাম কম পাওয়ায় কোনো কোনো দেশে গমের আবাদ অবশ্য কমে যেতে পারে। তখনো হয়তো দেখা যাবে, হেক্টরপ্রতি ফলন বাড়ার কারণে সেখানে গম উৎপাদন অন্তত কমছে না। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা-না থাকাটাও এর উৎপাদনকে প্রভাবিত করে বিপুলভাবে। এদেশে অবশ্য গম উৎপাদন কমই হয়ে থাকে। মাঝে এর উৎপাদন বেড়ে আবার কমে গেছে; যদিও চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। গম তথা আটা-ময়দার ব্যবহার বাড়ছে ঘরে; এমনকি গ্রামাঞ্চলে। এ অবস্থায় ভালো হতো দেশে গমের উৎপাদন বাড়ানো গেলে। ২০ লাখ মেট্রিক টনের মতো গম উৎপাদন আমরা করতে পেরেছিলাম বলে তথ্য রয়েছে। সেটা কমতে কমতে ১০-১২ লাখ মেট্রিক টনে আটকে আছে কেন, তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। এদিকে গেল অর্থবছরে আমদানি করতে হলো ৬৮ লাখ মেট্রিক টন গম। এর সঙ্গে দেশে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে ধরে নিলেও বুঝতে হবে গমের ব্যবহার কত বেড়েছে! এর মানে কি চাল পরিভোগ কমে যাওয়া? সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক। তারপরও চালের বাজারে থেকে থেকে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কেন, এর সদুত্তর পাওয়া কঠিন।
চালের দাম বাড়লেও গম আগের চেয়ে কমে পেলে অবশ্য কিছুটা ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে। আটা-ময়দার দাম হ্রাসের ঘটনায় কি এর সূত্রপাত হয়েছে? আটা-ময়দার দাম কমে এলে বেকারিপণ্যের দাম কিছুটা কমার কথা। বেকারিপণ্যের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতাও দ্রুত বাড়ছে। গত এক দশকে আবার বড় বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে। পুরোনো কিছু কোম্পানিও রয়েছে সক্রিয়। এতে অবশ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যেসব ছোট ও মাঝারি বেকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলোর ওপর। কোভিডের দুই বছরেও এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বেশকিছু বেকারি বন্ধও হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও বেকারিপণ্য উৎপাদন কমেছে বলে খবর নেই। এর অভ্যন্তরীণ বাজার বরং বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। কোভিডের সময়ও বড় বেকারিপণ্য উৎপাদনকারীদের বিক্রি বেড়েছিল। এদের হাত ধরে এ খাতে রপ্তানিও বেড়ে চলেছে। খবর আছে ২০-২৫ কোটি ডলারের বেকারিপণ্য রপ্তানির। এর বিরাট বিশ্ববাজারে এটুকু রপ্তানি অবশ্য কোনো খবর নয়। তবে আমাদের মতো নবীন বেকারিপণ্য উৎপাদকদের জন্য এটা বড় খবর। এটি বাড়িয়ে তোলার সম্ভাব্য সব সুযোগ নিতে হবে। রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের ওপর বিপুল নির্ভরশীলতাও তো কমাতে চাইছি আমরা। তবে ছোট বেকারিগুলোকে রক্ষায় যা যা করার, সেটাও করতে হবে। কর্মসংস্থানের যুক্তিতেও এটা করা প্রয়োজন।
ঘরোয়া উদ্যোগে কেকসহ বেকারিপণ্য উৎপাদন করে অনলাইনে বিক্রির প্রয়াসও বেড়েছে। শহরাঞ্চলে পথের ধারে ‘লাইভ বেকারি’ও মনোযোগ আকর্ষণ করছে। এমন সব ক্ষেত্রেই আটা-ময়দার ব্যবহার বাড়ছে বলে গমের চাহিদা কমার কোনো কারণ নেই। প্রত্যন্ত এলাকার ভাত-মাছ বিক্রি করা রেস্তোরাঁয়ও বাড়ছে আটা-ময়দার ব্যবহার। নুডলস ও সেমাই বিক্রি কতটা বেড়েছে, তা সবাই জানে। মাঝে দাম অনেক বাড়ায় বিক্রি কমলেও এসবের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেড়েছে যে, দাম কিছুটা কমে এলেই বিক্রি আবার দ্রুত বাড়বে। গমের বড় ধরনের ব্যবহার রয়েছে প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয়। প্রাণিখাদ্য তৈরিতে অবশ্য সবচেয়ে বেশি লাগে ভুট্টা। গমও কম ব্যবহৃত হয় না। আশার কথা, গমের উৎপাদন কমে এলেও দেশে ভুট্টার উৎপাদন বাড়ছে। ভুট্টা চাষে ক্রমে উৎসাহী কৃষক এবং ভালো দামও পাচ্ছে। তারপরও ভুট্টার চাহিদা এত বেশি যে, এটা করতে হচ্ছে আমদানি। মাঝে গমের সঙ্গে ভুট্টার দামও বেড়ে গিয়েছিল আর সেটাও যুদ্ধের প্রভাবে।
গম, ভুট্টা দুটোই বিপুলভাবে উৎপাদন করে রাশিয়া, ইউক্রেনসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলো। আমরাও ওখান থেকেই এসব পণ্য বেশি আমদানি করছিলাম বলে পরে নতুন উৎস খুঁজতে হয়েছে। তবে রাশিয়া থেকে গম আমদানি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা যেখান থেকে সম্ভব গম আমাদের আনতে হবে। আর যত কমে আনা যায়, ততই ভালো। গমে অবশ্য মানের ব্যাপার রয়েছে। ভুট্টার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা মানসম্মত ভুট্টা উৎপাদন করছি বলে খবর রয়েছে। সেটা ঠিক হয়ে থাকলে ভুট্টা রপ্তানিতেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আমাদের থাকবে। তবে আপাতত ভুট্টার সঙ্গে গমের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যে জায়গাটায় আমরা পৌঁছেছিলাম, সেটা ধরে রাখা গেলেও অন্তত ১০ লাখ মেট্রিক টন গম কম আমদানি করতে হয়। গত অর্থবছরে চাল আমদানি করতে হয়নি, এটা সুখবর নিশ্চয়। চালের বাজার শান্ত রাখা গেলে সেটা হতো আরও বড় সুখবর। এ অবস্থায় বিশ্ববাজারে গমের দাম কমে আসা এবং এর আমদানি বেড়ে যাওয়াকেও ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তবে রেকর্ড গম আমদানিতে কষ্টার্জিত ডলারও নিশ্চয় কম ব্যয় করতে হয়নি এ সংকটকালে।
ব্যক্তিগত ভোগে যায়, এমন পণ্যের আমদানি কম হওয়াটাও একদিক থেকে ভালো। বেশি বাড়া দরকার উৎপাদনমূলক ভোগে যায়, এমন পণ্যের আমদানি। যেমন, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ। এতে আমাদের মতো জনবহুল দেশে শিল্পের বিকাশ ঘটে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বেকারিশিল্পের বিকাশ ঘটলেও কিন্তু এতে বেশি কর্মসংস্থান হবে না; কেননা এটা বেশি যন্ত্রনির্ভর। আর এতে বেশি লাগে প্রশিক্ষিত জনবল; যার অভাব রয়েছে দেশে। প্রাণিখাদ্য শিল্পও ক্রমে যন্ত্রনির্ভর হচ্ছে। এ অবস্থায় জনবহুল ও স্বল্প দক্ষ মানুষের দেশে শ্রমঘন শিল্পের বিকাশের দিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে আরও অনেকদিন। এই কর্মজীবী জনগোষ্ঠী বাড়ার সঙ্গেও কিন্তু গম তথা আটা-ময়দার চাহিদা বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে। গম এবং এর সঙ্গে ভুট্টাসহ অন্যান্য উপকরণের দাম কমে এলে প্রাণিখাদ্যের দামে যদি এর প্রভাব পড়ে-তাতে মাছ, মুরগি, ডিম ইত্যাদির দাম অন্তত নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ বাড়বে। শ্রমজীবীদেরও পুষ্টি, বিশেষত প্রোটিন চাহিদা পূরণের প্রশ্ন রয়েছে।
শুধু পেট ভরে ভাত বা রুটি খেলে তো চলবে না, প্রতিদিন অন্তত একটা ডিম খাওয়া চাই তাদের। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও এবং চিনিসমৃদ্ধ খাবারের চাহিদা তাদের মধ্যে কমে এলেও বিপুলসংখ্যক মানুষের দেহে কিন্তু চিনি থেকে শক্তির সরবরাহ প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যজনক যে, চিনিতেও আমরা বিপুলভাবে আমদানিনির্ভর এবং এর দাম দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক রকম বেশি। ভারতের তুলনায় চিনির দাম কম করে হলেও দ্বিগুণ এ মুহূর্তে। ভালো হতো, প্রতিবেশী দেশটি থেকে কম খরচে চিনির মতো গমটাও যদি আনতে পারতাম। কিন্তু তারা অনেকদিন ধরেই নিজস্ব বাজার শান্ত রাখার চেষ্টায় এসব খাদ্যপণ্যের রপ্তানি নিরুৎসাহিত করছে। ভারত চালসহ খাদ্যপণ্যের বড় রপ্তানিকারক বলে এক্ষেত্রে তার অবস্থান বিশ্ববাজারকেও প্রভাবিত করে। আবার চীনের মতো বড় অর্থনীতি কোনো পণ্য অধিক হারে কিনতে শুরু করলে বিশ্ববাজারে এর দাম বেড়ে যায়।
চলতি বছরে চীন কি বেশি করে গম কিনে এর মজুত বাড়াবে? তাহলে কিন্তু এর বাজার কিছুটা হলেও অস্থিতিশীল হবে। সেক্ষেত্রে এর মাশুল গুনব আমরা-যারা বেশি বেশি গম আমদানি করছি। বাংলাদেশ আবার বোধহয় গম আমদানিকারকদের তালিকায় সামনের দিকে চলে এসেছে। মাঝে খবর বেরিয়েছিল, পেঁয়াজ আমদানিতে আমরা এক নম্বরে! তাও ভালো, এর সিংহভাগ দেশেই উৎপাদন করি। কিন্তু গম? গম আমদানি বাড়তে থাকলে আর বিশ্ববাজারের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল থেকে গেলে এর অনিশ্চয়তাও আমাদের পাবে। এ নিষ্ঠুর সত্যটাও মনে রাখা প্রয়োজন।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক