Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দুর্নীতির দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেছে চতুর্দিক

Icon

ড. হাসনান আহমেদ

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতির দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেছে চতুর্দিক

প্রতীকী ছবি

দেশে সমস্যার অভাব নেই। আমি কতগুলো মূল সমস্যাকে কেন্দ্র করে মাঝে-মধ্যে লিখি। মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলেই উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যেত। কখনো একই সমস্যা নিয়ে বারবারও লিখি। এসব কথা কেউ কানে তোলে কিনা, এ নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ দেশে আমরা অনেকেই কানা ছেলেকে পদ্মলোচন বলে অভ্যস্ত। বলা যায়, রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। এরা সমাজে ভালো আছে। এতে অভ্যস্ত না হলেও বিপদ; পথচলা দায় হয়ে যায়। কানা ছেলেকে কানা বললেও অসুবিধা। কানা ছেলে হাত উঁচু করে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসে। ‘কানাকে কানা বলা যাবে না’; নসিহত করে অপ্রিয় সত্য কথাও বলতে নেই। এগুলোও তো সমস্যা। কানা ছেলের চোখের অসুখটাকে চিকিৎসা করিয়ে নিলেও তো পারে। তা-ও করাবে না। ‘আমি আজীবন কানা থাকব, তাতে তোমার কী? কানা থাকা আমার অধিকার।’ ‘বুঝলাম, কানা থাকা তোমার অধিকার, কিন্তু পথ চলতে-কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে না দেখে গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও কেন?’ এ কথার কোনো উত্তর নেই। উত্তর একটাই, ‘সব কথার উত্তর খুঁজতে হয় না’। চোখের জ্যোতি কম হলেও গলার স্বর উদগ্র। ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’। এরকম উদ্ভট গৌরচন্দ্রিকা দিচ্ছি এ কারণে যে, আমি এ দেশের অতি মূল্যবান একটা বিষয় ‘রাজনীতি’ নিয়ে লিখছি। শুধু তা-ই নয়, একে ‘পচা দুর্গন্ধযুক্ত’ বলছি। রাজনীতি এ দেশের জীবন কিংবা মরণ; আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই জড়িত। এর দশা দেখলে করুণা হয়।

সবে ঈদুল আজহার ছুটি শেষ হলো। গরু ব্যবসায়ী এবং গ্রামবাংলার সাধারণ কৃষক বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাক ভাড়া করে রাজধানীতে কুরবানির গরু বিক্রি করতে আসে। এ আসা যে কী ঝকমারি, ভুক্তভোগীরা আবারও ভুগে এবারের মতো মুক্তি পেল। এত পরিশ্রম করেও লাভ যা হওয়ার কথা, তা হলো না। লাভের মাল পিঁপড়েয় খেয়ে গেল। এ রেওয়াজ অনেক দিনের। বিভিন্ন এলাকায় ঘাটে ঘাটে রাজনৈতিক মস্তানরা তাদের নিদানের সাথী পোশাকধারী বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। গরু ট্রাকে বা নৌকায় পার হতে গেলেই ইচ্ছামতো ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’। এ ছাড়াও সিন্ডিকেট ঘাটে গরুর ট্রাক অপেক্ষা করিয়ে রাখবে, নাকি ছেড়ে দেবে? রাজধানীর গরুর বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করতে গেলে এটা করা লাগে। নইলে রাজধানীর হাটে গরুর দাম বাড়বে কেমনে?

ঘাটে-মাঠে-হাটে সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতির মদদপুষ্ট এলাকাভিত্তিক কুটিল মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জড়িত। যারা সবাই যার যার ধান্দায় মহা-‘জনকল্যাণে’ ব্যস্ত। এরা ‘রাজনীতির মহাবুদ্ধিজীবী’। উড়ো টাকা ধরে নেওয়ার ফন্দি এরা জানে। রাজনীতির আদর্শ থাক বা না থাক, দলে ভিড়ে স্বার্থ আদায় করে খাচ্ছে। রাজনীতির কথা-‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’। এদের নয়া উদ্ভাবনী বুদ্ধির কাছে, নিউটনের উদ্ভাবনী বুদ্ধিও ফেল। নদীর ঢেউ গুনেও এরা টাকা আদায় করবে, সম্পর্ক আছে পোশাকধারী সহ-অংশীদারি বন্ধুদের সঙ্গে। বন্ধুদের সঙ্গে এসব কাজে বড্ড মিল।

সবকিছুতেই দেশব্যাপী বাতাসে পচা দুর্গন্ধ। মহান রাজনীতির দোসরদের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের দুর্গন্ধ। একচোখ দিয়ে তো দেখতে পারি না; যা পত্রিকায় পড়ি, শুনি ও দেখি, তা লিখি। গুরুভক্তি করতে পারি, কিন্তু গুরুর সব সাগরেদের কর্মকাণ্ডকে তো আর মেনে নেওয়া যায় না! এ লেখা কোনো নেতা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এ দেশের আইনের দুর্দশা ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ কার না অজানা!

প্রতিদিন যতবার পত্রিকা পড়ি, বিশ্রী উৎকট গন্ধটা বাড়ে। সেদিন ক্লাসে কোনো একটা বিষয়ে ব্যবহারিক উদাহরণ দিতে গিয়ে এমপি আনারের কিমা করা মাংস ময়লার ট্যাংক থেকে উঠানোর গল্পটা যেই না বলেছি, ক্লাসের সবাই নাক ধরে বসে থাকল। কোনো কোনো মেয়ে অক্-অক্ শব্দ করে বমি তোলার মতো করতে লাগল। বিশ্রী গন্ধটা তখনো যেন তাদের নাকে ভেসে আসছে। এমপি আনারের ভাগ্য বড্ড ভালো যে, তিনি যা-ই করুন, রাজনীতির একটা বড় পদ দখল করতে পেরেছিলেন। নইলে পত্রিকায় এত কভারেজ তিনি নিশ্চয়ই পেতেন না। এত গন্ধও ছড়াত না; পচা রাজনীতির গন্ধ। প্রথমে শুনেছিলাম তিনি একজন সোনা চোরাকারবারি, হুন্ডি ব্যবসায়ী, মাদক ব্যবসায়ী, রাতচরা বাহিনীর গডফাদার, মাদক ও নারীপ্রিয়; টাকা ভাগাভাগির কোন্দলে খুন হয়েছেন। এর সঙ্গে এখন খবরে ভেসে আসছে রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঘরের ভেতরে আরও ঘর, ক্ষমতা ভাগাভাগির কথকতা, ঘরের শত্রু বিভীষণ। এতে রাজনীতির পচা দুর্গন্ধটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কিছু পচতে গেলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে হয়। রাজনীতি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত না হলে পচবে কীভাবে? না পচলে দুর্গন্ধইবা বেরোবে কীভাবে? এ দেশের রাজনীতি ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হতে হতে এখন নিজেই একটা ব্যাকটেরিয়ায় পরিণত হয়েছে, যাকে স্পর্শ করে তাকেই পচিয়ে ছাড়ে, শেষে পচা দুর্গন্ধ বেরোবেই। কিংবা বলা যায়, যে দ্রব্য বা মালামালই ব্যাকটেরিয়ার রাজনীতির সংস্পর্শে আসে, তা পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে বাধ্য হয়।

একই রাজনীতির সংস্পর্শে গিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান বে-নজির সাহেব, বে-নজির যে নজির এ দেশে রেখে গেলেন, অতীতের এ পদে কেউ এমন নজির দেখাতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই। পত্রিকায় প্রকাশ, তিনি নাকি একটা জেলার অর্ধেক ভূস্বামী, হাজার হাজার কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক তিনি নিজে অথবা তার নিকটজন। তিনি দেশ ছাড়ার আগেই নাকি তার ব্যাংক ব্যালান্সের সদগতি হয়ে গেছে। এখন ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে দেওয়ার সময় এসেছে। বোঝা যায়, এমন সুযোগ্য-অনুগত অফিসারের সাহায্য-সহযোগিতা করার লোকের অভাব এ দেশে নেই। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়ার জন্যও তার যথেষ্ট যোগ্যতা রাজনীতিকরা খুঁজে পেয়েছিলেন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে, এ দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অনুগত (নাকি বাধ্যগত) শিক্ষাব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত ‘আমি তোমারি, ভুলনা আমায়’ মার্কা দলীয় অনুচরদের কর্ম দেখে। একজন শিক্ষক হিসাবে এ কষ্ট ও অপমান আমারও। এজন্যই বলছি, তার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। রাজনীতিকরা বলেন, ‘দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’। আবার বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’। কবি বলেছেন, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর, তোমার মাঝে আমার প্রকাশ তাই এত মধুর’। আমিও বেনজীরের মাঝে অসীমকে খুঁজে পাই। তার ভাষার মধ্যেও রাজনীতির ভাষা খুঁজে পাওয়া যেত। মূলত তার ক্ষমতা ছিল অসীম। এর মাঝেও তিনি নিজের সম্পদ গড়ার সুর বাজিয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা বেনজীর সাহেবের মাঝে রাজনীতির মুখস্থ ‘মধুর’ বাণী প্রকাশ পেত, পরিবর্তে এখন বিশ্রী দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। এ দুর্গন্ধ ধামাচাপা দিতে কেউ হয়তো পুলিশ বাহিনীর দুর্গন্ধ খুঁজবে, এ দুর্গন্ধ আসলে পচা রাজনীতির দুর্গন্ধ। শুনছি তার মতো অস্বাভাবিক অবৈধ সম্পদ মজুতের পথ আরও অনুসরণ করেছে তার বাহিনীর অসংখ্য ঊর্ধ্বতন অফিসার। শুনছি তাদের বিষয়টিও দুদক তদন্ত করছে। ফল কী হবে অনুমান করতে পারি। এ দুর্গন্ধ তো একটা বিভাগে নয়; রাজনীতির ব্যাকটেরিয়া এ দেশের যে বিভাগ ও বাহিনীর সংস্পর্শেই এসেছে, সেটাকেই পচিয়ে দুর্গন্ধে পরিণত করেছে।

মনে পড়ে, বর্তমান সরকারি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডিসংক্রান্ত বিষয়ে অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এ কলামেই একবার বাস্তবতা ও ডিগ্রিপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা তুলে ধরেছিলাম। কোনো কিছুই অমূলক নয়। এ দেশে রঙে রঙে এক রং হয়ে মিলে গেলে পাতানো পিএইচডি সার্টিফিকেট দখলে নেওয়া কঠিন কিছুই নয়। অনেক বছর ধরেই এর চর্চা চলছে। সব ক্ষেত্রেই অযোগ্যতা, অন্যায় ন্যায় হয়ে যাচ্ছে। আমার অভিযোগ বেনজীরের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যত্যয় নিয়ে। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কী হবে? এ দেশের শিক্ষার মান কেন কমেছে এবং কারা কমিয়েছে, এতে পরিষ্কার বোঝা যায়। এর জন্য দায়ী দুর্গন্ধযুক্ত রাজনীতি ও দুর্গন্ধে আক্রান্ত সম্মানিত শিক্ষক নামধারী দুর্নীতিবাজরা। আরও বোঝা যায়, ভবিষ্যতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন মর্যাদাহানির বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটিও করবে না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ও রাজনীতির অনন্য পচা দুর্গন্ধে সংশ্লিষ্ট সবার নাকে রুমাল তুলে দিল। বে-নজির নজির স্থাপন করলেন। এ দেশে এমন নজির আর কেউ রাখার কথা নয়। জানি না পত্রিকাগুলো একটু বেহায়ার মতো বাড়িয়ে বাড়িয়ে লেখে কিনা। নইলে ভেতরে ভেতরে এত কিছু হয়ে যায়, তা কোনো কাক-পক্ষী, এমনকি সরকারের অসংখ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানতেই পারে না। বড় আশ্চর্যের ব্যাপার! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিবাজ পালিয়ে যাওয়ার পর সবাই একটু বেশি বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। এর মোজেজা কী? দেখায়, ‘হাম বড়া বীর হ্যায়, যুদ্ধ কবে? আগামীকাল। হাম যায়েগা পরশু’। এসব বিভাগও রাজনীতির সংস্পর্শে এসে কি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে না?

মতিউর রহমান ছেলেকে যতই দোষারোপ করুক না কেন, আমাদের কথা ভিন্ন। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এই দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নির্বাহীদের ওপর বর্তায়। কোনো কারণে তারা শৈথিল্য দেখাচ্ছে বলেই বাহিনীর যারা দুর্নীতি ও অপকর্ম করছে, তারা পার পেয়ে যাচ্ছে।’

যে রাজনীতি খুঁজে খুঁজে এমপি আনার গংদের মনোনয়ন দেয়; তাদের দিয়ে আইন বানিয়ে দেশ চালায়, বে-নজির গংকে নীতি ও আইনের শাসনের সারথি ও নজির বানায়, আমরা সে অপরাজনীতিকে কি মাটিচাপা দিতে পারিনে? বিকট বিশ্রী গন্ধে যে সাধারণ মানুষের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে। মুক্তির পথ কি খুবই কঠিন? উপায় কী বলুন তো?

ড. হাসনান আহমেদ : অধ্যাপক, ইউআইইউ; সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম