কুরবানির হাটে অবিক্রীত পশুর অর্থনীতি
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি ও মো. মজনু সরকার
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রায় একযুগ ধরে কুরবানির ঈদকেন্দ্রিক পশুপালন দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দারিদ্র্য বিমোচনের সম্ভাব্য যত পথ আছে, তার মধ্যে পশুপালন অন্যতম। গবাদিপশু বিক্রি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের হাতে নগদ টাকার উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে একটি পরিবারের সারা বছরের নগদ টাকার চাহিদার একটা অংশ পূরণ হয়ে থাকে। আগে কুরবানি এলেই ভারত ও মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে থাকত বাংলাদেশ। বিশেষ করে ভারতীয় গরু ছাড়া বাংলাদেশে কুরবানির পশুর হাট ছিল অকল্পনীয়। প্রতিবেশী দেশ দুটি থেকে গরু না এলে কিংবা কম এলে বড় প্রভাব পড়ত কুরবানির হাটে। চড়া দামে কুরবানির গরু কিনতে হতো। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বাড়ে পশুপালন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বেসরকারি খাত, বিভিন্ন এনজিও, পিকেএসএফ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোক্তা এবং সংশ্লিষ্ট খামারিদের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১৬ সাল থেকে দেশে উৎপাদিত গবাদিপশু কুরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করে আসছে। দেশে এখন ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০ লাখ খামার রয়েছে। তৈরি হয়েছে অসংখ্য শিক্ষিত উদ্যোক্তা। গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পর্ণূতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গরু-ছাগল ছাড়াও আমাদের দেশে ভেড়া, দুম্বা, গাড়লের খামার গড়ে উঠছে। এ খামারগুলোকে কেন্দ্র করে আরও নানা ধরনের সহায়ক ব্যবসা ও কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ খাতে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। আর এর প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হয়ে উঠছে।
এবারের কুরবানির ঈদে হাটে তোলা পশুর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ অবিক্রীত রয়েছে (যুগান্তর, ২৪ জুন ২০২৪)। বছর বছর অবিক্রীত পশুর সংখ্যা বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই উদ্বৃত্ত পশু নিয়ে ব্যাপারী, ব্যবসায়ী ও খামারিদের কান্না। এ অবস্থা থেকে তাদের স্বস্তি দেওয়ার কোনো উপায় কি নেই? অবিক্রীত পশুগুলো কুরবানির হাট থেকে ফেরত এনে পরবর্তী ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষার মাঝে রয়েছে ব্যাপক ক্ষতির ভয় ও অনিশ্চয়তা। কারণ পরবর্তী সময়ে নিয়মিত হাটেও যথোপযুক্ত দামে এগুলো বিক্রি করা যায় না। অবশেষে সেগুলোর ঠাঁই হয় স্থানীয় কসাইয়ের দোকানে। প্রকৃতপক্ষে গবাদিপশুর ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে চাহিদা ও জোগানবিষয়ক প্রকৃত তথ্যের অভাবের কারণেই এ সংকট। দেশব্যাপী কুরবানির ঈদে কী পরিমাণ গবাদিপশুর চাহিদা রয়েছে, কী পরিমাণ পশু দেশে কুরবানিকেন্দ্রিক উৎপাদিত হচ্ছে, বিভিন্ন জেলার প্রধান প্রধান বাজারে কী পরিমাণ পশুর চাহিদা রয়েছে এবং এসব জেলার কোন হাটে কী পরিমাণ গবাদিপশু বিক্রি হবে, তার প্রকৃত তথ্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে নেই। ফলে উৎপাদনকারীরা কী পরিমাণ গবাদিপশু পালন করলে ঈদে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন এবং ক্রেতারা সঠিক দামে তা কিনতে পারবেন-এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আমাদের ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে নেই।
ডিজিটাইজেশনে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ সেলফোন এবং ১৩ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ সুবিধা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে গবাদিপশুর একটি ডেটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে, যা থেকে মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সহজে জেলা, উপজেলা, এমনকি হাটভিত্তিক কুরবানির সময় গবাদিপশুর চাহিদা ও উৎপাদনবিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ এবং সংশ্লিষ্টদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ডেনমার্কে প্রতিটি গরুর ডেটাবেজ রয়েছে, যা নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় এবং এ থেকে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। ফলে সেদেশে কখনো অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য ব্যবসায়ী ও খামারিদের ক্ষতির শিকার হতে হয় না।
আমাদের দেশে গবাদিপশু, বিশেষত কুরবানির গরু ও অন্যান্য প্রাণী পরিবহণের সার্বিক ব্যবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। গাদাগাদি করে তাদের ট্রাক, মিনিট্রাকে তোলা হয়। যানজটের কারণে ওই অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। প্রখর রোদ ও বৃষ্টির মধ্যে অনেক সময় দীর্ঘপথ হাঁটিয়েও আনা হয়। হাটেও তাদের রাখার ব্যবস্থা ভালো নয়। অনেক গরু অসুস্থ হয়ে পড়ে, গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে মারাও যায়। তাই পশু পরিবহণ ও হাটে থাকার ব্যবস্থা মানসম্পন্ন পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। পশু মৃত্যুজনিত মালিকের ক্ষতি লাঘবে এসব পশুকে বিমার আওতায় আনতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে তাদের গৃহীত কার্যক্রমকে আরও প্রসারিত, বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে পারে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, আমাদের কুরবানির পশুর উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। সাম্প্র্রতিক তীব্র খরা ও প্রচণ্ড রোদে কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পশুসম্পদ খাতে। গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ২০ শতাংশ। দেশে সারা বছর যত পশু জবাই হয়, তার প্রায় অর্ধেক হয় কুরবানির ঈদে। তাই পশু বিক্রি কম হলে ক্ষতিগ্রস্ত হন খামারিরা।
কুরবানির পশু অবিক্রীত থাকার আরেকটি কারণ হলো ফ্রোজেন মিট। একটি গরু উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে মাংস পৌঁছাতে ন্যূনতম ১০ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এটি মূলত প্রান্তিক ও গ্রামীণ পর্যায়ে হয়ে থাকে। তাই ফ্রোজেন মিটের আমদানি অবারিত থাকলে তরুণ উদ্যোক্তাসহ এসব মানুষের দারিদ্র্য আরও প্রকট হবে। আমদানির কারণে খামার বন্ধ হয়ে গেলে কৃষিতেও জৈব সারের সংকট দেখা দেবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। সংকটে পড়বে চামড়া শিল্প।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কুরবানির পশু অবিক্রীত থাকার আরেকটি বড় কারণ হলো চোরাই পথে হাজার হাজার পশুর প্রবেশ। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেনের তথ্য মোতাবেক দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বর্তমানে হাজার হাজার গরু ঢুকছে। দেশীয় গবাদিপশুর মধ্যে নানা রকম রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। দেশজুড়ে অজানা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। চোরাই পথে আসা পশু মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। তাছাড়া লোকসানের আশঙ্কাও রয়েছে। চোরাই পথে অবাধে গরু ঢোকায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন খামারিরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিরা।
এসব বিষয় আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। অবৈধ পথে পশু প্রবেশ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ফ্রোজেন মিটের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে। দেশের পশু খাতকে রপ্তানি উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আরও যত্নবান হতে হবে। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও খামারিরা যেমন রক্ষা পাবেন, তেমনি এ খাত অর্থনীতিকেও কিছুটা মজবুত করবে। ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাতে আমাদের মনোযোগ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারলে বৈশ্বিক গবাদিপশু উৎপাদন ও মাংস রপ্তানিতে আমরা উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারব। অবিক্রীত পশু বিক্রির অনিশ্চয়তা ও আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাবেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও খামারিরা।
হোসাইন মোহাম্মদ জাকি : গবেষক
মো. মজনু সরকার : ব্যবস্থাপক, পিকেএসএফ