সম্পদের পাহাড়ের চূড়ায় বসে আছেন অনেকে
মো. ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্পদের লোভ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষের এ সহজাত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রেই কঠোর আইনি ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের এ সহজাত প্রবৃত্তিকে বিবেচনা করেই সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় যে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টি করবে, যেন কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ না হয়। রাষ্ট্রীয় এ নীতির প্রতিফলনেই দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক ও দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাও যেন অনুপার্জিত অর্থ ভোগ না করতে পারে, সেজন্য সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিতে চাকরিতে প্রবেশের সময় এবং পরবর্তী প্রতি বছর সরকারি কর্মচারী ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া উক্ত বিধিতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক সম্পদ অর্জন ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়; কিন্তু প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দাখিল বাধ্যতামূলক হলেও সরকারি কর্মচারীদের অনীহা ও সরকারের নজরদারির অভাবে তা কার্যকর করা যায়নি। উপরন্তু প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দাখিলের বাধ্যতামূলক বিধান ২০০২ সালে শিথিল করে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান করা হয়। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তা-ও কার্যকর করা যায়নি। কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেই সদিচ্ছা ও কঠোর নির্দেশনার কারণে কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দাখিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কর্মচারীদের দাখিলকৃত উক্ত সম্পদের হিসাব বিবরণীও যাচাই-বাছাই করে অনুপার্জিত অর্থের সন্ধান করা হয়নি।
সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং উক্ত সংশোধনীতে সরকারি কর্মচারীদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব দাখিলের বাধ্যতামূলক বিধান বাদ দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মচারীরা যেহেতু আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন, সেহেতু তাদের পৃথকভাবে সম্পদের হিসাব দাখিলের প্রয়োজন নেই। যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে এটা হবে অত্যন্ত হতাশাজনক। সত্যি বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়, আয়কর আইন অনুযায়ী আয়কর রিটার্ন দাখিল এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দাখিলের উদ্দেশ্য ও পার্থক্য বুঝতে সংশোধনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা অক্ষম বা বোঝার মতো দক্ষতা তাদের নেই। জনপ্রশাসনের দক্ষতার এতটা অবনমন হয়েছে, এটি বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আয়কর আইন অনুযায়ী, আয়কর রিটার্ন দাখিলের সঙ্গে আচরণবিধি অনুযায়ী সম্পদের হিসাব দাখিলের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া একটা অপরটার পরিপূরকও নয়।
সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান সংশোধনের উদ্যোগ সত্যি হলে তা হবে কর্মচারীদের দুর্নীতিতে উৎসাহিত করা। এছাড়া এরূপ সংশোধনী ‘কোনো ব্যক্তি যেন অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ না হয়, রাষ্ট্র এমন অবস্থার সৃষ্টি করবে’ সংবিধানের এ নীতিরও সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ইতোমধ্যেই দুর্নীতি সহায়ক সরকারি চাকরি আইন এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা জারি করা হয়েছে। সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান থেকে সরকারি কর্মচারীদের অব্যাহতি দেওয়া হলে এটি হবে সততার কফিনে শেষ পেরেক।
বাজেটে কালোটাকা সাদা করার বিধান অনেক বছর ধরেই চলে আসছে, এখনো অব্যাহত আছে। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। সৎ উপায়ে অর্জিত যে অপ্রদর্শিত আয় আছে, তা যৌক্তিক পরিমাণ কর দিয়ে বৈধ করা এবং অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ যৌক্তিক পরিমাণ কর দিয়ে বৈধ করা এক নয়। কালোটাকা সাদা করার আয়কর আইনের বিধানের আওতায় সরকারি কর্মচারীরা যদি অবৈধ উপায়ে অর্র্জিত অর্থ বৈধ করে নেয় এবং যদি তাদের সম্পদের হিসাব দাখিলের বাধ্যতামূলক বিধান থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাহলে তাদের দুর্নীতি রোধ করার কোনো উপায়ই তো অবশিষ্ট থাকল না। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে সরকারি কর্মচারীদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে আরব্য রজনীর আলাদিনের চেরাগ।
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সরকারি কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়, সেই সঙ্গে সম্পদের হিসাব বিবরণীও দাখিল করতে হয়। উদাহরণ হিসাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সরকারি কর্মচারীদের বিষয়টি উল্লেখ করা যায়। আয়কর আইনে ভারতের সরকারি কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। তা সত্ত্বেও ভারতের সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধিতে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও সম্পদের হিসাব দাখিলের কঠোর বিধান রয়েছে। উক্ত আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রত্যেক কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় এবং পরবর্তী প্রতি বছর তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদের হিসাব দাখিল করতে হয়। উক্ত হিসাব বিবরণী তদারকি ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট কর্মকর্তাও রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে সম্পদের হিসাব বিবরণী তদারকি ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ করা নেই। এ কারণে এই বাধ্যতামূলক বিধান অকার্যকর থেকে যাচ্ছে। এছাড়া ভারতে সরকারি কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত যেন সম্পদ অর্জন করতে না পারে, সেজন্য কঠোর বিধান রয়েছে। অনুমতি ছাড়া সম্পদ অর্জন করলে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের সময় জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হয়। আমাদের আচরণবিধিতে কেবল এখতিয়ারাধীন এলাকার মধ্যে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের শিথিল বিধান আছে। এ শিথিল বিধানও সরকারের সদিচ্ছা ও নজরদারির অভাবে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর। যদি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান কঠোরভাবে নজরদারি করা হয়, তাহলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য হবে।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইনসংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক